Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আল্লামা ফখরুদ্দীন : একজন মহান ও আদর্শ শিক্ষকের প্রতিকৃতি

ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ৩০ জুন, ২০২১, ১১:৪৬ পিএম

মাদ্রাসা শিক্ষা জীবনে দ্বীনি ও ইল্মে প্রখর বুৎপত্তি সম্পন্ন অনেক শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ ও তাঁদের কাছে শিক্ষা গ্রহণের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, যাদের অধিকাংশ ইতোমধ্যে এ পৃথিবী ছেড়ে আখেরাতের পথে পাড়ি জমিয়েছেন। শিক্ষক হিসেবে তাঁদের জ্ঞান ও যোগ্যতা মূল্যায়নে আমি স্বভাবতঃ কাউকে প্রাধান্য দিব না, বা তুলনা করে কাউকে ছোট করব না। কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই ইসলামী তথা কোরআন, হাদীছ ও ফিকহের জ্ঞানের রাজ্যে ছিলেন প্রাতিস্বীকতাপূর্ণ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, নিজস্ব অঙ্গনে সমহিমায় ভাস্বর অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। তবে আমাকে যদি সার্বিক মূল্যায়নের প্রশ্ন করা হয়, যদি বলা হয় কাকে আমি শ্রেষ্ঠত্বের অভিধায় অভিসিক্ত করতে চাই, তাহলে নির্ধিধায় আমি বলব, আমার সর্বাধিক প্রিয় উস্তাদ আল্লামা ফখরুদ্দীনকে। তিনি ছিলেন হাদীছ শাস্ত্রে এক উচ্চ মর্গীয় বিদ্বগ্ধ পন্ডিত। ইসলামী জ্ঞানের সব অঙ্গনে ছিল তাঁর স্বদর্প বিচরণ। তাঁর মত ইসলামী জ্ঞানের আলোকে উজ্জ্বল ও দীপ্তমান একজন মহান শিক্ষকের কাছে কামিল শ্রেণীতে ইলমে হাদীছের শিক্ষা গ্রহণ আমার জীবনের চরম ও পরম পাওয়া। ছাত্র হিসেবে তাঁর কাছ থেকে অফুরন্ত স্নেহ ও ভালবাসা পেয়েছি। ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসায় তাঁর চাকুরী জীবনে যে কয়জন ছাত্র তার ইল্মি জগতের ঘনিষ্ট দ্বারে উপনীত হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার অবস্থান একেবারে নীচে নয়, আমাকে নিয়ে তিনি দ্বীনি ইলমের খেদমতের অনেক বড় স্বপ্ন দেখতেন, কেন দেখতেন তাঁর যথার্থ উত্তর আজও আমার কাছে নেই।

আমার এই প্রিয় শিক্ষকের জীবনের উপর যত বারই কিছু লিখার প্রয়াস চালিয়েছি বেশীদূর কলম যেতে পারিনি, বার বার স্মৃতি আমাকে তাড়িত করে ফিরেছে, অশ্রুসিক্ত হয়েছি, স্মৃতিপটে ভেসে উঠেছে আলীয়া মাদ্রাসার শ্রেণীকক্ষ, হুজুরের দরস, চলন-বলন ও হাঁটার স্টাইল, কথা-বার্তার আভিজাত্য, যুক্তির বলিষ্ঠ উপস্থাপন, আরো কত কিছু।

আল্লামা ফখরুদ্দীন হুজুরের অনেক ছাত্রের মত আমিও বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তাই চিন্তা করলাম, একজন মহান ও আদর্শ শিক্ষকের যে গুণাবলী আমি তাঁর মধ্যে অবলোকন করেছি, যা এখনও আমার শিক্ষক জীবনের অনুপ্রেরণা, সে বিষয়ে সামান্য কিছু আলোকপাত করব। কারণ বিস্তারিত লিখতে গেলে, নিঃসন্দেহে বিশাল গ্রন্থে পরিণত হবে। আমার নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন একজন পূর্ণমাত্রিক শিক্ষক, জ্ঞানের সাধন ও পাঠ দানের ক্ষেত্রে এক আদর্শ ও মহান শিক্ষকের উজ্জ্বল প্রতিকৃতি। এ বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে আমি কয়েকটি উদাহরণ পেশ করব।

একজন আদর্শ শিক্ষকের অন্যতম গুণ হলো তাঁর প্রধান ঝঃধশবযড়ষফবৎ তথা ছাত্রদের কাছে আলোচ্য বিষয় বস্তুকে সহজ ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা ও বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করা। এ গুণটির চমৎকার প্রতিফলন দেখেছি আল্লামা ফখরুদ্দীনের দরসে। তিনি আমাদের শ্রেণী শিক্ষক হিসেবে হাদীছের গ্রন্থ মুসলিম শরীফ পড়িয়েছেন। আল্লামা উবাইদুল হক জালালাবাদীর অবসর গ্রহণের পর কিছুদিন বোখারীও পড়িয়েছেন। ‘মুকাদ্দিমা’-এ মুসলিম বাংলাদেশের মাদ্রাসা ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছে কঠিন বাক্য সম্বলিত অনেকটা দূর্বোধ্য আলোচ্য বিষয়। আমারও প্রাক-ধারণা তাই ছিল। আলোচ্য বিষয় হিসেবে যতটা না কঠিন, তার চেয়ে অধিক কঠিন তার প্রকাশভঙ্গি। এ বিষয়টি তিনি আমাদেরকে অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জলভাবে পড়িয়েছেন, যা তুলনাহীন। বাক্য চমৎকারভাবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে অর্থ বের করে আনার অসাধারণ পারদর্শিতা ছিল তাঁর। কোন বিষয়ে গোঁজা-মিলের আশ্রয় নিতেন না। হাদীছ পাঠদানের ক্ষেত্রে প্রশ্ন করলে এত রেফারেন্স সমৃদ্ধ উত্তর দিতেন, শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম, মনে মনে সুবহানাল্লাহ পড়তাম। শ্রেণীকক্ষে তিনি ছিলেন একজন সরলমনা অনুপম মাধুর্যপূর্ণ ছাত্র বান্ধব আলোচক। কোন বিষয়ের প্রশ্নে তিনি ভাসা ভাসা উত্তর দিতেন না, প্রয়োজন হলে সময় নিয়ে পরের ক্লাশে বিস্তারিত আলোচনা করতেন।

হাদীছের দরসে বিভিন্নমুখী বিশ্লেষণ, বিশেষ করে ফিকহী মাসয়ালার অনুপুংখ বিশ্লেষণ, আমাদেরকে নিয়ে যেতো জ্ঞানের অতল্যান্ত সাগরে। হাদীছের সনদের বর্ণনায় তিনি ছিলেন অসম্ভব রকম পারদর্শী। ‘বাহরুল উলুম’ শব্দটি মাদ্রাসা শিক্ষা-জীবনের শুরু থেকে শুনে এসেছি আলীয়া মাদ্রাসায় এসে আল্লামা ফখরুদ্দীনের ক্লাস করার পর ‘বাহারুল উলুমের’ প্রকৃত অর্থ খুঁজে পেয়েছি। আমি পৃথিবীর তিনটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। অস্ট্রেলিয়ার মাকুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিসহ education-এ একটি diploma ও করেছি। Ideal Teaching এর essential features এর উপরও অনেকগুলো workshop ও করেছি। সে বিবেচনায় আমি আজকে শুকরিয়াস্বরূপ বলছি, আমার উস্তাদ ফখরুদ্দীন হয়তো পৃথিবীর আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে Teaching Methodology এর শিক্ষা গ্রহণ করেননি। কিন্তু স্বভাবগতভাবে এ বিষয়ে তার innovative চিন্তা-চেতনা ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। যার কারণে আর দশজন থেকে তিনি ছিলেন অনেকটা স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রমী। তাঁর পাঠদানের চমৎকার কৌশল ও জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ হয়ে প্রথম দিন থেকেই তাঁর মত শিক্ষকের ছাত্র হওয়াকে অত্যন্ত গৌরব, অহংকার ও সৌভাগ্যের বিষয় মনে হত। মনে হতো, মাদ্রাসা শিক্ষা জীবনের সমাপনী বর্ষে তিনি আমাদের জন্য রহমতস্বরূপ। আমার মত প্রত্যেকটি ছাত্রেরই এই ধারণা ছিল। প্রত্যেকদিনই অপেক্ষা করতাম পরের দিনের দরসের জন্য।

একজন আদর্শ শিক্ষকের আর একটি গুণ হলো পূর্ণমাত্রিক ক্লাস প্রস্তুতি। ক্লাসে যাওয়ার পূর্বে প্রস্তাবিত বিষয়ে গভীর ও ব্যাপক অধ্যয়ন থাকলে ছাত্রদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করা যায়, বিষয়ীর উপস্থাপনাও সহজ হয়। শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে এটা বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত বিষয়। আমার গোটা শিক্ষক ও শিক্ষা জীবনের অভিজ্ঞতায় তাঁর মত ক্লাস প্রস্তুত শিক্ষক আমার চোখে পড়েনি। শিক্ষাদান কালে মনে হতো সব জিনিস তাঁর চোখের সামনে ভাসছে, অন্তর চোখে উদ্ধৃত্ত গ্রন্থের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা দেখছেন। আমি অনেকদিন ক্লাস শুরু হওয়ার আগে তাঁর রুমে গিয়ে দেখেছি তিনি অধ্যয়নে ব্যস্ত। তিনি আমাকে বলতেন, ঘুম, অজু-গোসল ও খাওয়া ছাড়া আমি সবসময় পড়ি। প্রস্তুতির আর একটি নমুনা ছিল, উনি সবকিছু ডায়েরীতে নোট রাখতেন। উনার ডায়েরী মাঝে মাঝে পড়ার সুযোগ হয়েছে। তিনি সব কিছুর স্বল্প বিস্তারে চমৎকার নোট রাখতেন। মুসলিম শরীফে ‘কিতাবুল বুয়ু’ উপর পাঠদান কালে এত ব্যাপক ও বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করেছেন যা আজও আমার স্মৃতি ধারণ করে আছে। কোন শরয়ী মাসয়ালা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে ইজতিহাদের পূর্ণমাত্রিক যোগ্যতা আমরা দেখতে পেতাম। আমি মাঝে মাঝে শ্রেণীকক্ষে নিজের ব্যক্তিগত অভিমত পেশ করতাম, বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করতাম, কোন বিষয়ে দ্বিমতের ভাব প্রকাশ করতাম, উনি সহজভাবে সেটাকে গ্রহণ করতেন। এসব কারণে রসিকতার ছলে মাঝে মাঝে আমাকে ফিকহী ইমামদের নামে ডাকতেন। আমার দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে একজন গবেষণাধর্মী শিক্ষক যা মাদ্রাসা শিক্ষকদের ক্ষেত্রে অনেকাংশে অনুপস্থিত। কোন বিষয়ে রেফারেন্স ছাড়া কথা বলতেন না, কোন বিষয়ের ব্যাখ্যা ও যুক্তি উপস্থানকালে গবেষণার পদ্ধতিগত নিয়মের ব্যবহার করতেন। ফিকহী মাসয়ালা বর্ণনায় সংশ্লিষ্ট কোরআন ও হাদীছের বক্তব্যকে উছুলে ফিক্হের মানদন্ডে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতেন। আলিম/ফাজিল শ্রেণীতে নুরুল আনওয়ার, মানতিক, আকায়িদ পড়েছি, তবে যথার্থভাবে প্রায়োগিক জ্ঞান লাভ করেছি আল্লামা ফখরুদ্দীনের দরসের মাধ্যমে। (চলবে)

লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ