Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রফেসর আল্লামা ফখরুদ্দীন আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ

প্রফেসর ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া | প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০২১, ১২:০১ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর

হুযুর দুধ চা খুব পছন্দ করতেন। পানেরও এক বিশেষ প্রকরণ পছন্দ করতেন। হুযুরের দুধ চা যেখান সেখান থেকে আনলেই হতো না, যেখানে দুধ অনবরত গরম হচ্ছে, উর্দু গির্দা রোডের শেষ মাথায় সেখান থেকে ফ্লাক্সে করে নিয়ে আসতাম। যদি কোনো দিন কাঙ্ক্ষিত মানের চা না হতো, হুযুর বুঝতেন যে, চা তার সঠিক জায়গা থেকে আনা হয়নি। তখন তিনি বলতেন, যকরিয়া বা মফিয নিয়ে আসুক, আপনারা দোকান চিনেন না। আর পান তা তো আমি কোনোদিনই চিনতে পারতাম না, এটা মফিয খুব ভালো জানত। পান বাঁকা করলে শব্দ না হলে সে পান কেনা যাবে না। সেটা তিনি প্রায়শই বলতেন।

তারপর আমাদের পরীক্ষা হয়ে গেল। ভাইভা পরীক্ষা নেয়ার জন্য তখন আমাদের মাদরাসা-ই আলীয়ায় আসতেন শর্ষিনা আলীয়ার অধ্যক্ষ মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ আব্দুল কাদের। তিনি আমাদের ভাইভা পারফরমেন্সে খুশী হয়ে ফখরুদ্দীন হুজুরের কাছে বললেন, এ কয়েকজনকে আমার ঢাকা নেসারিয়া মাদরাসায় প্রয়োজন। হুজুর আমাদের সাথে শেয়ার করলেন। আমি বললাম, হুযুর এখনো পড়ালেখা শেষ করিনি। তবে আব্বাকে জিজ্ঞেস করব। হুযুর যা বুঝার বুঝে নিলেন।

আমি ৮-৮-৮৮ তারিখে মাদরাসা আলীয়ার ২৪১ নং কক্ষ ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ২২৩ নং কক্ষে আমার নামে বরাদ্দ করা সিটে উঠে পড়ি। কারণ তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের ছাত্র। সেখানে থাকা অবস্থায় আমাদের কামিল পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। আল্লাহর খাস রহমতে আমি ১৯৮৮ সালে কামিলে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলাম। তখনকার সময় যারা কামিলে প্রথম হতো তাদের নাম জাতীয় রেডিও, টিভিতে ঘোষণা করা হতো। রেজাল্ট শোনার পর হুযুরের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলাম, তখন ৮৮ এর বন্যা চলছিল। মাদরাসা ই আলীয়ায় বন্যা দূর্গতরা আশ্রয় নিয়েছে। মানুষের ভীঢ় ঠেলে কোনো রকমে হুযুরের রুমে প্রবেশ করলাম। হুযুর খুশী হলেন। অন্যান্য সংবাদ আলোচনার পর বললাম,
আমি হাদীসের সনদ পেতে আগ্রহী। হুজুর অত্যন্ত আনন্দিতচিত্তে বললেন, যান, এ বইটি ফটোষ্টেট করে নিয়ে আসেন। তাকিয়ে দেখলাম, তার নাম মিন্নাতুল বারী। তাতে বাংলার যমীনেরে গর্ব বায়তুল মুকাররাম মসজিদের খতীব মুফতী আমীমুল ইহসান রাহিমাহুল্লাহর সনদের গ্রন্থ। যাতে তিনি যেসব উস্তাদ থেকে বিভিন্ন গ্রন্থের সনদ লাভ করেছেন সেটা একত্রিত করেছেন।

ফটোষ্টেট করে আনার পর হুজুর নিজে তার নিচের অংশে তাঁর সনদসহ আমাকে সে গ্রন্থে উল্লেখিত সকল সনদের ইজাযাহ প্রদান করেন। জীবনে প্রথম কিতাবের সনদ লাভ করি। যা আমাকে আমার ইলমের মূল শ্রোতধারায় সংযুক্ত করেছে।

তারপর হঠাৎ করে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কবুল করেন। সেখানকার পাঠে ও পড়ালেখায় সবসময় আমরা যারা মাদরাসা-ই-আলীয়ায় পড়েছি, আমি, আমার অনুজ ড. আবুল কালাম আযাদ, ড. আব্দুস সালাম আযাদী আমরা যখনই কোথাও ইলমী কোন মজলিসে বা খাবার কোনো টেবিলে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করতাম তখনই কথায় কথায় আমার প্রিয় উস্তাদজীর কথা স্মরণ করতাম। বিশেষ করে উস্তাদজী যেসব উদাহরণ দিতেন সেগুলো আজও যেন আমাদের চোখের সামনে চিরভাস্বর হয়ে আছে।

মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালীন সময়ের শেষের দিকে থিসিস নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অনেক বছর উস্তাদজীর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু সর্বদা হাদীসের ইলমের কথা কোথাও আলোচনা হলেই তাঁর কথা এসেই যেত। আর যদি ঢাকা আলীয়া বা সিলেট আলীয়ার তাঁর কোনো ছাত্রেরে সাক্ষাৎ হয়ে যেতো তাহলে তো আর কথাই নেই। উস্তাদজীর আলোচনাই তখন আমাদের সকলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যেতো।

মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জনের পর দেশে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ায় চাকুরী নিই। তখন বেশ কয়েকবছর বাংলাদেশের সরকারী মাদ্রাসাগুলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থাকার সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় কামিলের ভাইভা পরীক্ষা নিতে আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন কামিল মাদরাসায় পাঠাতেন। তেমনি এক ভাইভায় আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম সুবহানিয়া আলীয়া মাদরাসায় পাঠান। সেখানে যাওয়ার তার প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা হারূন সাহেবসহ ভাইভা নিচ্ছিলাম, সনদ ও মতনের কথা বলতে আমার উস্তাদজীর কথা এসে পড়ে। তখন আমাকে বললেন, আমিও শাইখের ছাত্র। তাৎক্ষনিক প্রস্তাব দিলাম উস্তাদজীর সাথে দেখা করার।

ভাইভা শেষ করার পর রাত্রিতেই চন্দনাইশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। যেতে যেতে উস্তাদজীর চেহারা শুধু ভেসে আসছিল, এখন জানি কেমন হয়ে গেছেন, আমাকে চিনবেন কি না? ইত্যাদি হাজারো চিন্তা করতে করতে রাত ৯টায় মুহতারাম উস্তাদজীর বাসার সামনে উপস্থিত হলাম। উস্তাদজীর ভাতিজা ও জামাতা আমাদেরকে যথাযথ সম্মান করে উস্তাদজীর কাছে নিয়ে গেলেন। আমার উস্তাদজী আমাকে একটুও ভুলেননি। এমনকি আমাদের সাথীদের কথাও স্মরণ করলেন, তাদের মাঝে কে কোথায় কী কাজে লিপ্ত তাও শুনলেন।

তারপর উস্তাদজী ইলমী আলোচনা শুরু করে দিলেন। মন দিয়ে শুনছিলাম আর মনে হচ্ছিল এরকম কিংবদন্তী আলেমকে আমার দেশ কদর করে না। তিনি জানালেন যে, অবসর নেয়ার পর চুনতি হাকিমিয়া আলীয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসাবে পড়াচ্ছেন। তারপর হাদীসের এমন সব লাত্বায়িফুল ইসনাদ বর্ণনা করলেন, যা আমাকে আমার মাদরাসা আলীয়া জীবনে উস্তাদজীর তাক্বরীরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। আলোচনা পিন-পতন নীরবতায় চলছিল, উস্তাদজী তাঁর জ্ঞানের অংশ আমাদের দিয়ে ধন্য করছিলেন আর আমরা তা শোনার জন্য এতই নিমগ্ন ছিলাম যে, হঠাৎ ঘর থেকে তাগাদা আসলো আমাদেরকে মেহমানদারী করাবেন, আমরা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাতের অর্ধেক গড়িয়ে এখন প্রায় ১টা বেজে গেছে। আমরা তখন উস্তাদজীর স্বাস্থের কথা চিন্তা করে তাড়াতাড়ি চলে আসার চিন্তা করলাম, দেরী হওয়ার জন্য উযর পেশ করলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে উস্তাদজীর ভালোবাসায় শিক্ত শব্দ ‘আমার যকরিয়া আসছে, আজকে আমার অসুবিধা হবে না’। আল্লাহ আপনার দরবারে কায়োমনোবাক্যে দোা‘আ করছি, আপনি আমাদের উস্তদাজীক কবুল করুন, তাঁকে জান্নাতের সুউঁচ্চ মকাম দান করুন। আমাকে যেভাবে ভালোবেসেছেন আল্লাহও তাঁকে সেভাবে ভালোবাসুন।

অনেক রাতে উস্তাদজী থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম। মন পড়ে থাকলো তাঁর সান্নিধ্যের আশায়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে ব্যস্ত থাকায় অনেকদিন আমার শাইখের সাথে সাক্ষাত সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে সেই দুঃখজনক খবর শুনতে হলো, জানতে পারলাম আমাদের প্রিয় মানুষটিকে আল্লাহ তাঁর সান্নিধ্যে ডেকে নিয়েছেন।
তিনি আমাদের হৃদয়ে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। আল্লাহ তা‘আলার কাছে আবারও তাঁর জন্য জান্নাতের দো‘আ করছি। তাঁর পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্তুতি, আত্মীয়-স্বজন সকলকে আল্লাহ দীনের জন্য কবুল করুন। আমাদেরকেও কবুল করুন। আমীন। সুম্মা আমীন।
লেখক : আল-ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রফেসর আল্লামা ফখরুদ্দীন আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ