দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
প্রফেসর আল্লামা ফখরুদ্দীন রাহিমাহুল্লাহ, যাঁর মাধ্যমে আমার ইলমে হাদীসের জ্ঞানচর্চার সূত্রপাত। যাঁর ইলমের কথা বলতে গেলে আমার জিহবা আড়ষ্ট হয়ে যায়, যার ভালোবাসার কথা মনে হলেই অন্তরে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। যার আন্তরিকতার কথা আমি কোনোদিন বলে শেষ করতে পারবো না। আসলে কিছু জিনিস আছে, যা কখনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, শুধু অন্তরের অন্তঃস্থলে নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রেরণা যোগায় ও দো‘আর সঞ্চার করে। আর তাহচ্ছে আমার শাইখ, আমার মুরশিদ, আমার হাদীসের উস্তাদ, আমার জীবনের মোড় পরিবর্তনকারী, জনাব আল্লামা ফখরুদ্দীন রাহিমাহুল্লাহ। যাঁর নেক দো‘আ আমি আমার জীবনে সর্বত্র কাজে লাগিয়েছি, আজও সেটার প্রভাব আমার জীবনেরে প্রতিটি পরতে পরতে অনুভব করি।
১৯৮৬ সালে আমি নিজ গ্রাম ধনুসাড়া ইসলামিয়া মাদরাসা থেকে ফাযিল পাশ করি। আমার আব্বা মাওলানা মুহাম্মাদ ছিদ্দিকুর রহমান উক্ত মাদরাসার তখন অধ্যক্ষ। তাঁর হাতে গড়া হাজারো ছাত্রের মধ্যে আমি একজন। সেখানে আর পড়ার সুযোগ না থাকায় আমাকে এ প্রথম বাড়ির বের হতে হলো। উদ্দেশ্য ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো, আরো উদ্দেশ্য কোনো ভালো কামিল মাদরাসায় বাকী পড়া শেষ করবো। গায়ে ছিল শর্ষিনার নিসফে সাক্ব জামা।
১৯৮৬ সালের শেষের দিকে কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে তৎকালীন বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ মাদরাসা-ই-আলীয়ায় এসে প্রথমে ভর্তি ফরম পূরণ করে জমা দিই। পরের দিন সকাল বেলা ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। সে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে। মাদরাসা আলীয়ার ছোট গেট দিয়ে ঢুকছি, এমন সময় একজন বললো, “ওই তুই ছিদ্দিকের পুত নিরে?” আমি তো আশ্চর্য, এ লোক কীভাবে আব্বাকে চিনল? বললাম, জী, আপনি কার কথা বলছেন? বললেন, তোর বাপের নাম কী? আমি বললাম, মাওলানা মুহাম্মাদ ছিদ্দিকুর রহমান। তিনি বললেন, “আমি দেখেই বুঝছি, তুই ছিদ্দিকের ছেলে। তোর চেহারার সাথে অনেক মিল আছে। তোর বাপরে সালাম বলিস। আর বলিস আমি প্রফেসর মোতাহার হোসেন। ছিদ্দিক আর আমি একসাথে পড়েছি শর্ষিনায়।
যথারীতি পরীক্ষা দিলাম, ভালোই নম্বর পেলাম। ভর্তি হলাম। ভর্তি পরীক্ষার নম্বরের উপর সীট বণ্টন করা হলো। সীটও পেয়ে গেলাম। ক্লাস করতে আরম্ভ করলাম। আমাদের ক্লাস টিচার হলেন, মাওলানা আব্দুর রহীম (ইমাম সাহেব হুযুর)। কিন্তু তখনই শুনতে পাচ্ছিলাম যে, মাদরাসা-ই-আলীয়াতে দুই বিখ্যাত শিক্ষক আছেন, একজন হচ্ছেন, মাওলানা ফখরুদ্দীন সাহেব, যিনি উর্দুতে তাকরীর করেন, আরেকজন হচ্ছেন মাওলানা ওয়াজীহুদ্দীন সাহেব। যিনি হাদীসের ইলমুর রিজাল সম্পর্কে অনন্য জ্ঞানের অধিকারী। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই প্রথম বর্ষের পড়া শেষ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতেই আমরা জানতে পারলাম যে, আমাদের ক্লাস টিচার হচ্ছেন ফখরুদ্দীন হুযুর। শুনে অত্যন্ত ভালো লাগলো। হুজুর উর্দুতে তাকরীর করতেন। মাঝে মধ্যে উর্দুতে সুন্দর করে ‘লতীফা’ (ছোটগল্প) বলতেন। আবার হেসে বলতেন, ‘এটা তোমাদের আব্দুল লতীফ হুযুরের মুওয়ান্নাস না’। আমরা হুযুরের অসাধারণ সে গল্পগুলো আজও মাঝে মধ্যে স্মরণ করি।
ক্লাসে সাধারণত অল্প কয়েকজন ইবারত পড়তো, হয়, আমার দোস্ত মাওলানা মুফিজুর রহমান, (বর্তমান প্রিন্সিপাল, লাউড়ী আলিয়া মাদরাসা) অথবা আমি পড়তাম, কখনো কখনো কাজী সিরাজ পড়তো, কখনো (মাদ্রাসার আলীয়ার বিশেষ ছাত্র) ময়নুল হক পড়তো (বর্তমানে প্রফেসর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া), আবার কখনো কখনো হারূন তা পড়তো। উস্তাদের তাকরীর লেখার ক্ষেত্রে আমি, ময়নুল হক আর মুফিজ অগ্রণী থাকতাম।
একদিন কোনো এক কাজে আমার দোস্ত মুফিজুর রহমান ক্লাসে অনুপস্থিত। আমি সেদিনের দারসের তাকরীরটি লিখলাম। রাতে রুমে এসে মুফিজ সেই লিখা খাতাটি নিয়ে যায়। পরদিন আমাকে বললো, আপনাকে তো ফখরুদ্দীন হুজুর স্মরণ করেছে, বলতে তার সেখানে যেতে। ভয় পেয়ে গেলাম, বললাম, কেন? বললেন, ভয় নেই। খাতার অনেক কথা বুঝা যাচ্ছে না তাই আমি হুজুরের কাছে নিয়ে গেলাম, হুজুর বললেন, কার লেখা? আমি বললাম, আপনার কথা, হুজুর খুশি হলেন এবং আপনাকে তার একান্ত দারসে থাকতে বলেছেন।
একান্ত দারসের সাথে আমার পরিচিতি ছিল না। পরে জানলাম, কাজী সিরাজ, মুফিজ, হারূন, আরও কয়েকজন হুজুরের সাথে বিশেষভাবে বুখারী পড়ছেন। সেটার সুযোগ সবাই পায় না। যাদেরকে হুজুর ভালোবাসেন তাদেরকেই শুধু পড়ান।
পরে বুঝতে পেরেছি হুজুর কেন আমাকে ডেকে নিলেন। কারণ উর্দু জানা থাকা সত্তে¡ও হুজুর উর্দুতে তাকরীর করলেও আমি সেটা উর্দুতে না লিখে সাথে সাথে আরবীতেই লিখে নিতাম। আমার দোস্তের হাতে আরবীতে তাকরীর লেখা দেখে হুজুর খুশী হয়েছিলেন তাই ডেকে নিয়েছিলেন। এটা একান্তই আল্লাহর রহমত ও ফযল, আসলে উস্তাদদের নেক নজর ও দো‘আ না থাকলে মানুষ কখনও শিক্ষায় ভালো করতে পারে না।
সেই থেকে হুজুরের বাসায় আসা যাওয়া করতাম। তিনি তখন খাজে দেওয়ান রোড বা উর্দু গির্দা রোডের ছোট একটি রুমে অবস্থান করতেন। সেখানে আমরা আলাদা করে সহীহ বুখারীর তাকরীর শুনতাম। শুধু যে তাকরীর শুনতাম তা নয় সেটা আমাদের বৈকালিক আসর ছিল। সেখানে না গেলে আমাদের একটুও ভালো লাগতো না। আমার বন্ধুরা দু’ একদিন না গেলেও আমি আর দোস্ত মুফিজ কখনো যাওয়া বাদ দিতাম না।
একদিনের ঘটনা বলি, আমরা গিয়ে দেখলাম, কাজী সিরাজ নাই, হারূন বললো, স্যার কাজী সিরাজ অসুস্থ। পরের দিন আবার হারূন নাই, কাজী সিরাজ বললো, স্যার হারূন অসুস্থ। হুজুর হাঁসলেন এবং বললেন, ‘মান তোরা কাযী গুওয়াম তো মোরা হাজী বগু’। অর্থাৎ তোমরা একে অপরের জন্য ওযর নেয়ার বুদ্ধি করেছ।
কুরআনের আয়াতের দলীল দেয়ার ক্ষেত্রে হুজুর মাঝে মধ্যে ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করতেন। খুব কম ছাত্রই সময়মত আয়াতটি উপস্থিত করতে পারতো। কিন্তু ছোটকাল থেকেই প্রতি আব্বাজানের নির্দেশে সকাল বেলায় কুরআন পড়ার বাধ্য-বাধকতা থাকায় অধিকাংশ আয়াত আমার মুখেই থাকতো। তাই হুজুর জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথে উত্তর দিতে সক্ষম হতাম, যেখানে হাফেয সাহেবদের সময় লাগতো। হুজুর একদিন রসিকতা করে বললেন, ‘হাফেযের বাপ’। আমি মনে করি হুযুরের দোআ কাজে লেগেছে আল্লাহ আমাকে চার হাফেযের পিতা হওয়ার তৌফিক দিয়েছেন।
মাদরাসা আলীয়া পড়া অবস্থায় একবার ইমাম সাহেব হুযুর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইমাম সাহেব হুযুরের রুমে সাদেকুল্লাহ (মুফতি সাহেব) হুযুরও থাকতেন। সাদেকুল্লাহ হুযুর একসময় আমাদের ধনুসাড়া মাদরাসায় কিছুদিন ক্লাস নিয়েছিলেন। সেজন্য তিনিও আব্বাকে ভালো করেই জানতেন। ইতোমধ্যে আব্বাও ঢাকায় তাঁর কাজে আসলেন। আমি ইমাম সাহেব হুযুর ও সাদেকুল্লাহ হুযুরের কথা জানালাম। তিনি দেখতে গেলেন। আর সেখানে তখনই ফখরুদ্দীন হুযুর ইমাম সাহেব হুযুরকে দেখতে এসেছিলেন। ফলে ইমাম সাহেব হুযুরের রুম আলেমগণের মিলন-মেলায় পরিণত হয়। আব্বার সাথে ফখরুদ্দীন হুযুরের সেখানেই পরিচয় হয়। এরপর হুযুর মাঝে মধ্যেই আব্বার কথা জিজ্ঞেস করতেন।
একবার ছাত্র রাজনীতির কারণে মাদরাসা ই আলীয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। হুযুরকে বললাম, হুযুর বাড়ী যেতে চাচ্ছি। হুযুর বললেন, আমিও যাব, ‘আপনি আমার সাথে যাবেন, আপনারে পথে নামিয়ে দিব।’ (হুযুর নিজ শরাফতের কারণে ‘আপনি’ করে বলতেন) হুযুরের সাথে সফর করার আনন্দই ছিল আলাদা। কত ইলমী বিষয় যে আলোচনা করলেন তা বলে শেষ করতে পারবো না। পথিমধ্যে চৌদ্দগ্রামে আমি নেমে নেমে গেলাম, মন পড়ে রইলো হুযুরের সান্নিধ্যের আশায়।
দীর্ঘ বন্ধের পর মাদরাসা আলীয়া খুললো, হুজুর একদিন ডেকে বললেন, আপনি কি চান না মাদরাসা ই আলীয়ার বৃত্তি পেতে? আমি বললাম, হুযুর কীভাবে? হুযুর বললেন, ভালো ছাত্রদের জন্য মাদরাসা আলীয়ায় বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে। আপনাদের প্রিন্সিপ্যালকে বলেছি যেন ব্যবস্থা করে দেয়, আপনি একটি ফরম পূরণ করে জমা দেন। তারপর সে বৃত্তির ব্যবস্থা হয়েছিল। এটাও হুযুরের নেক নজর ও দো‘আর কারণে সম্ভব হয়েছিল।
এর মধ্যে সিদ্ধান্ত হলো যে, এভাবে মাদরাসা ই আলীয়ার শিক্ষকরা বাইরে থাকলে তাদের নিরাপত্তা থাকে না, তাই তাঁকে ভিতরে আনার ব্যবস্থা করা হলো। তাঁকে মাদরাসা ই আলীয়ার একটি বড় রুমে রাখা হলো। এতে আমাদের আরও বেশি সুবিধা হলো। প্রতিদিন হুযুরের কাছে বিকাল বেলা বসে থাকা বেড়ে গেল। (চলবে)
লেখক : আল-ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।