দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
পূর্ব প্রকাশিতের পর
একজন ভাল শিক্ষক শুধু পড়ায় না, বরং পড়তে শিখায়, কিভাবে পড়াতে হবে তা শিখায়। কিভাবে পড়তে হয়, কিভাবে পড়ানোর প্রস্তুতি নিতে হয় এক্ষেত্রে আজও তিনি আমার অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি আমাকে স্নেহবশে ‘নসরত’ বলে ডাকতেন। চট্টগ্রামের ভাষায় বলতেন, নসরত কোন জিনিস ‘রেডিমেট’ পড়বেনা, তার অর্থ ক্ষণিকের জন্য বা ভাসা ভাসা পড়বে না, বার বার পড়বে, এমনভাবে পড়বে যাতে স্মৃতিতে স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত থাকে। এ মর্মে বিখ্যাত প্রাবন্ধিক আবু সায়িদ আইয়ূবের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তার উক্তি ছিল ‘ষোলটি বই না পড়ে, তার পরিবর্তে চারটি বই, চারবার করে ষোলবার পড়া উত্তম’। আল্লামা ফখরুদ্দীন আমাকে বলেছেন, যখন তুমি কোন বিষয়ে গভীর অধ্যয়নের পরিকল্পনা করবে, তখন সংশ্লিষ্ট সকল গ্রন্থাদি ও গবেষণাধর্মী লেখনীসমূহ যোগাড় করবে এবং সবকিছু অদ্যোপান্ত পড়বে এবং প্রয়োজনীয় নোট রাখবে। মনে রাখতে হলে, বারবার পড়বে ও ভালভাবে বুঝবে। কোন বিষয়ে পরিষ্কারভাবে না বুঝে সামনে অগ্রসর হতে নিষেধ করতেন। এজন্যে তাঁর সাথে ক্লাসের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় মনে হতো সবকিছু তাঁর সামনে আয়নার মত স্বচ্ছ।
মাদ্রাসার ফাজিল-কামিল শ্রেণীর সিলেবাসভূক্ত মা’কুলাতের কিতাবসমূহ তুলনামূলক ধ্রুপদী ভাষা সম্বলিত। শুধু আরবী ভাষা জ্ঞান থাকলে এ কিতাবসমূহ সঠিকভাবে বুঝা যায় না। কিভাবে একটি কঠিন বাক্যকে বিশ্লেষণের স্বার্থে ভাঙ্গতে হয়, বিভিন্নমুখী ব্যাখ্যা করতে হয় সে বিষয়ে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এ কারণে আলীয়া মাদ্রাসায় পড়াকালীন সময়ে আমি ঢাকার কয়েকটি কওমী মাদ্রাসার দাওরাহ হাদীছের সবকে বসেছি, অধিকাংশ আলোচনা আমার কাছে অনেকটা অগভীর ও দায়সারা গোছের মনে হয়েছে। অবশ্য উস্তাদরা অনেক মুহাক্কিক ছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মূল সত্য হলো, উস্তাদ ফখরুদ্দীনের কাছে কোন বিষয়ে সবক গ্রহণের পর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অন্য কারো কাছে সমভাবে তৃপ্ত হওয়া অত্যন্ত কঠিন ছিল।
একজন ভাল ও আদর্শ শিক্ষকের আরও একটি গুণ হলো রহঃবৎফরংপরঢ়ষরহধৎু শহড়ষিবফমব ও সমসাময়িক বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকা। মাদ্রাসায় কোরআন ও হাদীছে বুৎপত্তি অর্জন করতে হলে অবশ্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয় তথা ফিক্হ, উসুল ফিক্হ, বালাগাত ও মানতিকে স্বল্প বিস্তর ধারণা থাকা আবশ্যক। আল্লামা ফখরুদ্দীনের উপরিক্ত বিষয়সমূহে গভীর পান্ডিত্য ছিল। ইসলামের জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার বিচরণ ছিল ঈর্ষনীয়। পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ও প্রয়োজনীয় ধারণাও রাখতেন। যার কারণে তুলনামূলক আলোচনা করতে সক্ষম ছিলেন। নিজে রাজনীতি করতেন না, তবে সম-সাময়িক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে বেশ ভাল ধারণা রাখতেন। নিয়মিত একটি দৈনিক পত্রিকা খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন।
তিনি ছিলেন একজন সত্যবাদী, তাওহীদপন্থী শিক্ষক। প্রত্যেকটি বিষয়কে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। বাতিল ও ভুয়া পীর ও তথাকথিত সুফীবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন। যা তার দরসের মাধ্যমে প্রকাশ পেত। তবে হাদীছ নির্ভর সুন্নত পন্থী ছিলেন।
ছাত্র-শিক্ষকের সুসম্পর্ক আবহমানকাল ধরে উন্নত শিক্ষা অর্জনের একটি স্বীকৃত মাধ্যম। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায়ও ছাত্র-শিক্ষকের সুসম্পর্ককে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে আল্লামা ফখরুদ্দীন ছিলেন এক নজীরবিহিন ব্যক্তিত্ব। ছাত্রদের জন্য তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহজগম্য, যেকোন বিষয়ে ছাত্ররা তাঁর সাথে মত বিনিময় করতে পারত। ছাত্রের কল্যাণই তাঁর কাছে ছিল মূখ্য বিষয়। ভাল ছাত্রদের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা হয়তো সবারমত একটু বেশী ছিল। আমার মনে পড়ে আমাদের সময়ে কামিল শ্রেণীর প্রশ্নপত্রের ধরণে অনেকটা পরিবর্তন ঘটে। রচনামূলক প্রশ্নের পরিবর্তে হাদীছ ও তাফসীর বিষয়ে অধিক সংখ্যক ছোট প্রশ্নের সংযোজনের পূর্ব বিজ্ঞপ্তি আমাদের দেয়া হয়। আমাদের কাছে তখন কোন মডেল প্রশ্ন ছিলনা এবং কি ধরণের প্রশ্ন হতে পারে সে বিষয়ে অতটা ধারণাও ছিলনা। ফখরুদ্দীন হুজুর আমাদের রাত্রে ক্লাস নেয়ার ব্যবস্থা করলেন এবং কি ধরণের প্রশ্ন হতে পারে এজন্য গুরুত্বপূর্ণ হাদীছ ধরে ধরে প্রশ্ন তৈরী করতেন। সম্পর্কের দিক দিয়ে অনেকটা কাছের ছিলাম বলে হুজুর অনেকদিন নিজে ডেকে নিয়ে আমাকে পড়িয়েছেন।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি খুবই মজার লোক ছিলেন। গল্প করতে খুবই পছন্দ করতেন। অধিকাংশ গল্পের পিছনে প্রায়শঃ শিক্ষণীয় বিষয় থাকত। আমরাও গল্প করতাম, আমাদের গল্প শুনে মাঝে মাঝে হৃদয়জোড়া অট্ট হাসি দিতেন। তিনি ভোজন রসিকও ছিলেন বটে। পুরানো ঢাকার লালবাগের মোড়ের তেহারী, চকবাজারের খাওয়া-দাওয়ার বিরিয়ানী তাঁর খুব প্রিয় ছিল। আমি তার সাথে অনেকবার এসকল হোটেলে খেয়েছি। প্রায়ই হেটে হেটে গল্প করতে করতে যেতাম। তখনতো এরকম রিকসার ও গাড়ীর ভীড় ছিলনা। মাঝে মাঝে আমাকে বলতেন, “আমার বিশ্বাস তুমি মাদ্রাসা শিক্ষায় থাকলে অনেক বড় মুহাদ্দিছ হবে, আমি তোমাকে সেভাবেই প্রস্তুত করতে চাই”। ছাত্রদেরকে আর্থিকভাবেও সাহায্য করতেন যেটা আমার ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। আমার হয়তো ওভাবে দরকার হতো না। আমি কোন কিতাব কিনব বলে সিদ্ধান্ত নিলে উনি বলতেন, টাকার দরকার হলে আমার কাছ থেকে নিও।
ছাত্রদেরকে সবসময়ই জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করতেন। পরিচিতদের কাছে নিজের ছাত্রদের ভূয়সী প্রশংসা করতেন। পূর্ববর্তী ছাত্রদের প্রশংসা করতেন পরবর্তীদের কাছে। আমার এখনও মনে পড়ে, একবার রিয়াদের মহম্মদ বিন সউদ ইউনিভার্সিটির রেক্টরের সম্মানে ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার মিলনায়তনে এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে আমি ছাত্রদের পক্ষ থেকে আরবীতে বক্তৃতা দিয়েছিলাম। হুজুর তখন সামনের সারিতে বসা ছিলেন। বক্তৃতার পর মহামান্য অতিথি আমাকে ‘খতীবে আজীম’ বলেছিলেন। ফখরুদ্দীন হুজুর আমার এই বক্তৃতার প্রশংসা কতজনের কাছে করেছেন তার অন্ত নেই। এভাবে তিনি সবার ক্ষেত্রে যার যার বিশেষ গুণের প্রশংসা করতেন। আমাদের সালাহউদ্দনি আইয়ূব যে এখন মিচিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, তার অসম্ভব লিখনী শক্তির প্রশংসা হুজুর আমিসহ অনেকের কাছে করেছেন। একজন সফল শিক্ষকের পাশাপাশি তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সৎ, দায়িত্বনিষ্ঠ ও সিদ্ধান্তে দৃঢ়চেতা, আদর্শবাদী ও সাহসী ব্যক্তিত্ব।
ছাত্র হিসেবে তার প্রতি আমার দায় আমি কখনও শোধ করতে পারব না। আমার শিক্ষা জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক তিনি, তিনি এখনও আমার অনুকরণীয় আদর্শ। আমি প্রতিনিয়ত আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা দান করেন। আমীন।
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।