পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
চলমান বৈশ্বিক পেন্ডেমিকেও আমাদের জাতীয় অর্থনীতির হালহকিকত তেমন মন্দ না। যদিও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে এখন ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট দীর্ঘস্থায়ী সংকটের দিকে চোখ রাঙাচ্ছে। বিশেষত ভারতের নিষেধাজ্ঞার কারণে করোনা ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম পিছিয়ে পড়ায় তৈরী পোশাক রফতানি ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও বিমান যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন করে প্রতিবন্ধকতার আশঙ্কা করছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিনিয়োগকারিরা। এ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তেই পারে। তবে কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, কোভিড-১৯ এর কারণে বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও নাজুক খাত কোনটি? চটজলদি তার উত্তর হবে, দেশের শিক্ষাখাত। করোনা সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের সময় বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা যখন স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দিলাম, তখনো দেশের সবচেয়ে জনবহুল শ্রমঘন শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ করা হয়নি। সারাদেশে লকডাউন ঘোষণার মধ্যেও কোনো এক অদৃশ্য ইশারায় লাখ লাখ গার্মেন্ট কর্মীকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের কারখানাগুলোতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। তবে পরমকরুণাময়ের কাছে শোকরিয়া এজন্য যে, অনেক বিতর্ক ও আশঙ্কা সত্ত্বেও গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ ও খোলার নাটকীয়তার পরও তেমন কোনো অঘটন ঘটেনি। দেশের কোনো ইপিজেড বা গার্মেন্ট কারখানায় করোনা সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব দৃশ্যগোচর হয়নি। করোনা পেন্ডেমিকের প্রথম ধাপ শেষে সংক্রমণ খুব কমে এসেছিল। এরপর দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার আগের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় দেখা দেয়ার সাথে সাথে বিধিনিষেধ জোরদার, দেশের সীমান্ত জেলাসহ বিভিন্ন স্থানে নতুন করে লকডাউনসহ কড়াকড়ি আরোপ করা হলেও গার্মেন্ট কারখানা একদিনের জন্যও বন্ধ করা হয়নি। অন্যদিকে প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ থাকা স্কুল-কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দিয়ে শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা এবং অনিশ্চয়তা থেকে উত্তরণে কোনো অভিপ্রায় বা পদক্ষেপ সরকার ও শিক্ষামন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে নেয়া হয়নি। বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকবার স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার সম্ভাব্য তারিখ ঘোষিত হলেও সেসব ঘোষণা ও তারিখ নিয়ে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে ‘যদি’ ‘কিন্তু’ দিয়ে শুরুতেই এক ধরনের দ্বিধাগ্রস্ততার জন্ম হয়েছে, অতঃপর সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং নতুন ভ্যারিয়েন্ট বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার মধ্যেও সবকিছুই প্রায় স্বাভাবিক গতিতে চললেও চলছে না শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মাসখানেক গণপরিবহন বন্ধ রাখার পর শতকরা ৬০ ভাগ ভাড়াবৃদ্ধি করে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনা জারি করা হলেও ঢাকার লোকাল গণপরিবহনগুলোতে ভিন্নচিত্র দেখা যাচ্ছে। কিছু রুটে নির্দেশনা অমান্য করে হাউজফুল যাত্রী বোঝাই করে চলাচল করলেও ভাড়া দেড় থেকে দ্বিগুণের বেশি আদায় করা হচ্ছে। এ হিসেবে করোনা বিধিনিষেধে গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আয় বেড়ে গেছে। ঢাকার রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা যানজটে নাকাল অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
করোনা পেন্ডিমিক শুরুর আগে বেসরকারি স্কুল-কলেজে সম্মানজনক চাকরি বা শিক্ষকতা করতেন, এমন হাজার হাজার নারী-পুরুষ এখন বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের অনিশ্চিত জীবন পার করছেন। এমন হাজার হাজার মানুষ এখন শিক্ষকতা ছেড়ে পানবিড়ির দোকান অথবা রিক্সার পেডেলে পা রেখে স্ত্রী-সন্তানদের ভরণ-পোষণের জীবন সংগ্রাম শুরু করেছেন। পেন্ডেমিকের সময় কিছু সংখ্যক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের আয় ও টার্নওভার বেড়ে গেলেও দেশের শতকরা আশিভাগ মানুষের আয় কমে গেছে বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নিয়ে মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার আদর্শিক জায়গায় থাকা মানুষগুলোর একটা বড় অংশ এখন বেকারত্ব, অধ:পতিত ও ভাগ্যবিড়ম্বিত শ্রেণীতে পরিনত হয়েছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ভারত থেকে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে ভারতের সাথে তিন দিকের সীমান্তঘেরা বাংলাদেশের সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার দাবি উঠেছিল শুরুতেই। কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার কথা বললেও বাস্তবে ছিল ‘বজ্রআঁটুৃনি ফস্কা গেরো’র মতো। একশ্রেণীর ব্যবসায়ী ও আমলার ভারতপ্রীতি আমাদেরকে সবদিক থেকেই ডুবিয়েছে। বিভিন্ন সীমান্ত পথ ও স্থল বন্দরে ভারত থেকে আমদানী হওয়া পণ্যের বাণিজ্য ঠিক রাখতে গিয়ে ভারতীয় ট্রাক ও কভার্ডভ্যান ড্রাইভার চালক-হেল্পারদের অবাধ যাতায়াতে দেশের সীমান্ত জেলাগুলোতে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। নিজেদের স্বার্থে ভারত যখন তখন সীমান্ত বন্ধ করে দিবে, নিত্যপণ্যের চালান থেকে শুরু করে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ ভোক্তা ও রোগীদের বিপদে ফেলে দিবে, অযৌক্তিক এন্টি-ডাম্পিং ট্যাক্স বসিয়ে বাংলাদেশের বাণিজ্য সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত করতে তাদের বন্ধুত্বের হাত এতটুকুও কাঁপে না। তবে আমাদের একশ্রেণীর আমলা ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ভারতে ভয়াবহ ডেল্টা ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার পরও ভারতের সাথে স্থল বাণিজ্য চালু রাখতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন, তবে সেক্ষেত্রে যে ধরণের কড়াকড়ি, সতর্কতা, নজরদারি, শর্ত ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা প্রয়োজন ছিল, তা যথাযথভাবে আরোপ করা হলে সীমান্ত জেলাগুলোতে এখন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। দেশের মানুষের জন্য এখনকার সবচেয়ে বড় আশঙ্কা ও আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, সীমান্ত জেলা থেকে প্রাণঘাতী ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট করোনাভাইরাস ঢাকায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। গত কয়েকদিন ধরে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে। এই নিবন্ধ লেখার সময় গত ২৪ ঘন্টায় ৮২ জনের মৃত্যু এবং সাড়ে তিন হাজারের বেশি নতুন সংক্রমণের তথ্য প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ঢাকায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়লে অবস্থা কি হতে পারে তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে যথেষ্ট উদ্বেগ দেখা গেলেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। গণপরিবহন, কলকারখানাসহ সবকিছু ঠিকমত চললেও করোনা পেন্ডেমিকের বিধি-নিষেধ শুধুমাত্র স্কুল-কলেজ, মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয় তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাইেন যেন বেশি নিবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
দেড় বছর ধরে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় এমপিও বহির্ভুত হাজার হাজার শিক্ষক ও তাদের পরিবার যেমন সীমাহীন অর্থনৈতিক সংকট ও দুর্ভোগে পড়েছে। তার চেয়েও গভীর সংকটে পড়েছে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কলকারখানা চালু রাখার ঝুঁকি নিলেও হাজার হাজার শিক্ষক পরিবার, কোটি কোটি শিক্ষার্থীর পরিবারের বিপর্যস্ত অবস্থার দিকে কোনো নজর নেই সরকারের! দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কোটি কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে এক ধরনের মনোবৈকল্য ঘটে চলেছে বলে সমাজত্বাত্ত্বিকরা আশঙ্কা করছেন। ইতিমধ্যে সমাজে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করেছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, করোনার পেন্ডেমিকের আগে থেকেই শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের স্কুল-কলেজে পুড়ুয়া সন্তানদের একটা বড় অংশ ডিজিটাল ডিভাইসের দ্বারা আসক্ত ও প্রভাবিত হয়ে পড়েছিল। সেসব সন্তানদের একটি অংশ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের গ্রুপ গড়ে তোলার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে, তারা টিকটক-লাইকি, ইউটিউব ভিডিও নির্মাণের মাধ্যমে যেমন এক ধরণের অনৈতিক ও অশ্লীল প্রতিযোগিতায় যোগ দিচ্ছে, তেমনি কিশোর-তরুণদের আরেকটি গ্রুপ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহর থেকে মফস্বল পর্যন্ত কিশোর গ্যাং গড়ে তুলছে। এই করোনা পেন্ডেমিকে শহরের কিছু স্কুল-কলেজ শিক্ষার বিকল্প প্ল্যাটফর্ম হিসেবে অনলাইন ক্লাস চালু করে। এতদিন যেসব তথাকথিত নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের জন্য স্মার্টফোন নিষিদ্ধ করেছিল, সে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন অনলাইন ক্লাস চালুর নামে সব শিক্ষার্থীর হাতে একটি এন্ড্রয়েড ফোন তুলে দিতে বাধ্য হয় অভিভাবকরা। অনলাইন ক্লাস চালু রাখার অজুহাতে তারা শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি আদায়ের পূর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। অথচ কে না জানে এই করোনা পেন্ডেমিকে অনেক অভিভাবক চাকরি হারিয়েছেন, অধিকাংশ অভিভাবকের আয় অর্ধেক কমে গেছে। অন্যদিকে স্কুলগুলোর অধিকাংশ শিক্ষক কাজের বাইরে থাকায় তাদের পূর্ণ বেতন দেয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও একশ্রেণীর স্কুল-কলেজের পরিচালক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পূর্ণ টিউশন ফি আদায় করছে। তবে অনলাইন ক্লাস বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ও পরিবারের জন্য বিশৃঙ্খলা ও সামাজিক সংকট তৈরী করছে। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার চেয়ে দেশের ভবিষ্যত নাগরিকদের মনোবিকলন ও অবক্ষয়ের সংকট থেকে রক্ষার উদ্যোগ কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সর্বশেষ ঘোষণা অনুসারে, ১৪ জুন দেশের সব স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার কথা ছিল। এরই মধ্যে সীমান্ত জেলাগুলোতে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের অতিমারী এবং তা ক্রমশ ঢাকার দিকে ধেয়ে আসার আশঙ্কা, সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির বাস্তবতায় স্কুল-কলেজ খোলার সম্ভাবনা আবারো তিরোহিত হল। আগে বলা হয়েছিল, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের করোনা ভ্যাকসিনেশন সম্পন্ন করার পর বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হবে। সেরাম ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিন চুক্তি লঙ্ঘিত হওয়ার পর দেশে করোনা ভ্যাকসিনেশন অনিশ্চয়তা ও দীর্ঘায়িত প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করেছে। এখনো যদি ভ্যাকসিন দেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চিন্তা থাকে, তাহলে একথা হলফ করেই বলা যায়, আগামী আরো এক বছরের মধ্যে বিদ্যালয় খোলা সম্ভব হবে না। তবে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চরম আশঙ্কার মধ্যেও গত সোমবার প্রথম দফা স্থানীয় নির্বাচনে দেশের ২ শতাধিক ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মানব পাচারের দায়ে মধ্যপ্রাচ্যের আদালতে দণ্ডিত এমপি শহিদুল ইসলাম পাপুলের সদস্যপদ শূন্য হওয়ায় লক্ষীপুর-২ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনও একইদিনে অনুষ্ঠিত হয়। এক মত বিনিময়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, করোনার চেয়ে নির্বাচন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে করোনার ভয়ে গত দেড় বছরে একদিনের জন্যও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়নি, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগাছা-পরগাছার দখলে পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়িতে পরিনত হয়েছে, সেখানে আমাদের সরকার, ব্যবসায়ী ও আমলাতন্ত্রের নানা কর্মকাণ্ডের দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, করোনার ঝুঁকি মোকাবেলার চেয়ে অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সামাজিক-রাষ্ট্রীয় বিবেচনায় সবচেয়ে গুরুত্বহীন বিষয় সম্ভবত: সন্তানদের শিক্ষা ও তাদের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা। ব্যক্তিগত বিনিয়োগে গড়ে ওঠা হাজার হাজার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাজার হাজার শিক্ষক এবং কোটি কোটি শিক্ষার্থীর জীবনকে অগ্রাহ্য করে কিছু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ভাগ্যন্নোয়নের অর্থনৈতিক তৎপরতা জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কিশোর অপরাধ বৃদ্ধিসহ ইতিমধ্যে সমাজে যে ধরণের অবক্ষয়, সহিংসতা ও বিভৎসা দেখা যাচ্ছে তা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খুবই উদ্বেগজনক।
আঞ্চলিক ও আন্তজার্তিক মানদণ্ডে এই করোনাকালে দেশের অর্থনীতির গতি সন্তোষজনক। তবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিছু সংখ্যক পুঁজিপতি ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের স্ফীতির নির্দেশক হলেও কিছু মেগা প্রকল্পের সুফল ছাড়া দেশের সাধারণ মানুষের জন্য তেমন কোন কল্যাণ বয়ে আনছে না। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়ে তুলেছে। আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষ, বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখন অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক গজিয়ে ওঠা একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী অনৈতিক, ভোগবাদী অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে। তারা দেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছে, বিদেশে অর্থ পাচার করছে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রভাবিত করে সম্পদের সুষম বন্টন এবং সাধারণ মানুষের সামাজিক ন্যায়বিচারের অধিকারকে কুক্ষিগত করছে। এদের দ্বারা গড়ে ওঠা দুর্নীতির দুষ্টচক্র সমাজকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। সর্বগ্রাসী দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলতে হলে প্রথমেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসেও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জাতির জন্য প্রয়োজনীয় ও কাক্সিক্ষত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলতে পারেনি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, ইমান-আক্বিদা, নীতি-নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থা জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারেনি, পারবেও না। নতুন প্রজন্মকে আত্মিক উন্নয়ন ও সত্যিকারের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার মত শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরী হয়ে পড়েছে। শিক্ষা নিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ ও মুনাফাবাজির লাগাম টেনে ধরতে হবে। শিক্ষা খাতে সরকারের বাজেট বরাদ্দ ও বিনিয়োগে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষা বিভাগে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও অনৈতিক প্রতিযোগিতা ও রাজনৈতিক দখলবাজির পথ রুদ্ধ করতে হবে। চলমান ও আগামীদিনের বিশ্বব্যবস্থায় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জসমুহ মোকাবেলা করে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে টিকে থাকতে হলে শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্ষীণ দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও আমলাতান্ত্রিক এক্সপেরিমেন্ট এখনো অব্যাহত আছে। একদিকে দেশের লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ বেকারত্বে ধুঁকে মরছে অন্যদিকে প্রতিবেশি দেশের লাখ লাখ তরুণ এখানে এসে চাকরির বাজার দখল করছে। এতেই বোঝা যাচ্ছে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কাদের স্বার্থ রক্ষা করছে। এ থেকে উত্তরণের প্রতিবন্ধকতাগুলো শক্ত হাতে দূর করতে না পারলে জাতির এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন কখনো সফল হবে না। এসবের পেছনের কুশীলবদের মতলববাজি ধরতে না পারলে সরকার ও রাষ্ট্র ব্যর্থ হবে। এ ব্যর্থতার দায়ভার জনগণ নেবে না। গত বছরের শেষদিকে করোনাভাইরাস পেন্ডেমিক দ্বিতীয় বছরে পর্দাপণ করার সন্ধিক্ষণে জাতিসংঘের ইউনিসেফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, করোনা সংক্রমণ অব্যাহত থাকলেও আরেক বছর স্কুলের বাইরে থাকার ধকল শিশু-কিশোররা বহন করতে পারবে না। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে স্কুল খুলে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সেখানে আমাদের দেশে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, গণপরিবহন চালু রাখা হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য পরিত্যক্ত করা হয়েছে। আমাদের আমলাতন্ত্রের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী চিন্তা করলেই বুঝা যায়, কারা আমাদের করোনা ভ্যাকসিনেশনকে পরিকল্পিতভাবে রুদ্ধ করেছে, তারাই আবার বলছে ভ্যাকসিন না দিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলা যাবে না, দেশের অন্য সব সেক্টর খুলে দেয়া হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অনির্দ্দিষ্টকাল পর্যন্ত বন্ধ রাখার পক্ষে ওকালতি করছে কারা? তাদেরকে চিহ্নিত করে ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।