পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
সুপার সাইক্লোন সিডর, আইলা, বুলবুল ও আম্পানের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর প্রভাবে অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে উপকূলীয় এলাকা। এটা উপকূলবাসীর জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। আম্পান আঘাত হানার বছর না ঘুরতেই ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকার বাঁধ ভেঙে গ্রামকে গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে শত শত মাছের ঘের ও খামার। ইয়াস উপকূলের কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ছাড়াও লোনাপানিতে মিঠা পানির অবকাঠামোরও ব্যাপক ক্ষতি করেছে। তলিয়ে যায় সুন্দরবনের অনেক জায়গা। এতে হরিণসহ অন্য বন্যপ্রাণী মারা গেছে। সুন্দরবনের ভেতরে মিঠাপানির পুকুর লোনাপানিতে তলিয়ে গেছে। এতে করে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ফুঁসে ওঠা সাগরের জোয়ারে উপকূলভাগের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নদী তীর রক্ষাবাঁধ ভেঙে উপকূলের বিপুলসংখ্যক চিংড়ি ঘেরসহ বিভিন্ন ধরনের মৎস্য খামারের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। এতে প্রায় হাজার কোটি টাকার মাছ ও মাছের পোনা ভেসে গেছে। কৃষি খাতের ক্ষতি এখনো নিরূপণ করা না হলেও এখাতেও কমপক্ষে শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদরা অনুমান করছেন।
দেশের উপকূলীয় এলাকার ৮ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালে আইলার পর উপকূল এলাকার এসব বাঁধের অনেক জায়গা ভেঙে গিয়েছিল। অনেক জায়গা বানের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল। কিন্তু তার বড় অংশ এখনো যথাযথভাবে মেরামত করা হয়নি। এর পর আম্পানেও উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও এগুলো মেরামত করা হয়নি। এবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেড় হাজার কিলোমিটার বাঁধ। ২৭টি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে নদীতে বিলীন হয়েছে ১৫০ কিলোমিটার। উপকূলবাসী বছরের পর বছর ধরে টেকসই বেড়িবাঁধের দাবি জানিয়ে আসলেও বরাবরই উপেক্ষিত সেই দাবি। এবার উপকূলীয় এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিতে কাফনের কাপড় পরে স্থানীয় বাসিন্দারা মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। ভাঙা বেড়িবাঁধের উপর খালি গায়ে কোমড় পানিতে দাঁড়িয়ে বুক ও পিঠে ‘ত্রাণ চাই না, টেকসই বাঁধ চাই’ লিখে বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় মসজিদ তলিয়ে যাওয়ায় হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে জুম্মার নামাজ পড়েও বাঁধ নির্মাণ না করার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, বছরের পর বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত হচ্ছে উপকূলবাসী। অথচ আজ পর্যন্ত উপকূলে টেকসই বাঁধ নির্মাণ হয়নি এটা আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ যেনতেনভাবে কিছুটা মেরামত করা হয়। এরপর আইলা এসে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। আইলার পর আসে আম্পান, আর এবার ইয়াসের প্লাবনে ভেসেছে উপকূল। তারপর টেকসই বাঁধ হয় না। প্রতিবারই বাঁধ নির্মাণের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়; কিন্তু টেকসই বাঁধ নির্মাণ হয় না, উপকূলবাসীর দুর্ভোগও কমে না। এ বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখতে হবে। উপকূলে নির্মাণ করতে হবে টেকসই বাঁধ। তা না হলে প্রতিবছরই ক্ষতিগ্রস্ত হবে উপকূলীয় অঞ্চল।
ইয়াসের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন জেলার ক্ষয়ক্ষতির সার্বিক বিষয় নিয়ে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে বিশেষ সংবাদদাতা রফিক মুহাম্মদ এ রিপোর্টটি তৈরি করেছেন।
বরিশাল থেকে নাছিম উল আলম জানান, ‘বুলবুল’ ও ‘আম্পান’-এর পরে গত ২৬ মে বুধবার ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ দক্ষিণ উপকূলের কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ছাড়াও পানিসম্পদ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি করেছে। প্রাথমিক হিসেবে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠী জেলায় এসব খাতের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি। ভোলা, বরগুনা ও পটুয়াখালীর বিস্তীর্ণ এলাকা এখনো পানির তলায়। গত ৪ দিন ধরে ভোলার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পনিবন্দি। সাগরের জোয়ারে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নদী তীর রক্ষা বাঁধ ভেঙে উপকূলের বিপুলসংখ্যক চিংড়ি ঘেরসহ বিভিন্ন ধরনের মাছের খামারের কোটি কোটি মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। এ দুটি সেক্টরেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রাথমিকভাবে আড়াইশ’ কোটি টাকারও বেশি বলে জানা গেছে। প্রবল জোয়ার আর স্রোতে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৩ হাজার হেক্টরের ১৭ হাজার ২০৯টি পুকুর, দিঘি ও ঘের থেকে আড়াই হাজার টনেরও বেশি চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ ভেসে গেছে। এছাড়াও ঘের, পুকুর, দিঘিসহ বিভিন্ন ধরনের মৎস্য অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। টাকার হিসেবে কৃষি সেক্টরের ক্ষতির হিসাব নিরুপিত না হলেও, সেটা শত কোটি টাকার কম নয় বলে প্রাথমিকভাবে অনুমান করছেন মাঠপর্যায়ের কৃষিবিদরা। বরিশাল কৃষি অঞ্চলে প্রাথমিকভাবে প্রায় ১ হাজার হেক্টরের আউশ বীজতলা, ৪ হাজার হেক্টরের রোপা আউশ, ৩ হাজার ৩৪ হেক্টরের সবজি, ১৯৯ হেক্টরের পান বরজ, পৌনে ২শ’ হেক্টরের পাট, ২শ’ হেক্টরে কলা, ১২৫ হেক্টরের মরিচ, ৪১ হেক্টরের তিল ও ২১ হেক্টর জমির পেপে বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম থেকে রফিকুল ইসলাম সেলিম জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে প্রবল জোয়ার চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইয়াস ও পূর্ণিমার কারণে প্রবল জোয়ারের উপকূলের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তাতে ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ। মাঠের ফসলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উচ্চতায় জোয়ারে নতুন নতুন এলাকায় প্লাবিত হয়েছে। নগরীর পতেঙ্গা, হালিশহর, কাট্টলীসহ কয়েকটি এলাকায় ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকেছে লোকালয়ে। পানির তোড়ে ভেসে গেছে কাঁচাঘর, দোকানপাট। জেলেপাড়া, আনন্দিপুরের অনেক মানুষ জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলার উপকূলীয় উপজেলা বাঁশখালী, আনোয়ারা, সীতাকুণ্ড, মীরসরাই, দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের অনেক এলাকা অস্বাভাবিক জোয়ারে তলিয়ে যায়। বাঁশখালী ও সন্দ্বীপে ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে ঢুকেছে জোয়ারের পানি। তাতে ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ, ক্ষেতের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কক্সবাজার থেকে শামসুল হক শারেক জানান, কক্সবাজারে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। তবে শক্তিশালী এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সহায় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কয়েক শত কোটি টাকা। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের নিরূপিত তথ্যমতে কুতুবদিয়ায় ৮০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে বলে জানা গেছে। জলোচ্ছ্বাসে মহেশখালী উপজেলায় চিংড়িঘের, বসতবাড়ি, বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, যার আনুমানিক ক্ষতি ১০ কোটি টাকা। মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি, ধলঘাটা, কুতুবজোম ও পৌরসভায় ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে ১৫০ বাড়ি সম্পূর্ণ নষ্ট এবং সাড়ে ৪শ’ বাড়ির আংশিক ক্ষতি হয়েছে। কক্সবাজার সদর উপজেলায় বেড়িবাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়ি ও লবণ মাঠ জোয়ার তলিয়ে কমপক্ষে ৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শহরের সমিতি পাড়া শুঁটকি পল্লি ও কুতুবদিয়া পাড়াসহ নিম্নাঞ্চল জলমগ্ন হয়ে ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষ ২০ কোটি টাকার সহায় সম্পদ। টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনে জোয়ারের তোড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে বেড়িবাঁধ ও জেটি। এতে কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে নিরূপিত হয়েছে।
খুলনা ব্যুরো জানায়, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর প্রভাবে উপকূলীয় জেলা খুলনায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পূর্ণিমার ভরা জোয়ার আর একই সাথে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে নদনদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। খুলনার উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের আঘাতে ১০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, সাত হাজার মৎস্য ঘের ও অর্ধলক্ষাধিক মানুষের ঘরবাড়ি এবং ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। সব মিলিয়ে প্রাথমিকভাবে ৬০ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কয়রা উপজেলার চার ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রাম লোনা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। কপোতাক্ষ, কয়রা, শাকবাড়িয়া নদীর পানি ৬-৭ ফিট বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার ১১ স্থানের বেড়িবাঁধ ভেঙে ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ উপচে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। লোনা পানি ঢুকে ফসলি জমি, মৎস্য, গবাদিপশুসহ প্রায় ৩৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এর মধ্যে মৎস্য ঘের ডুবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। ২ হাজার ৫৫০টি ঘের ও পুকুর ডুবে প্রায় ১৫ কোটি টাকার মৎস্যসম্পদ নষ্ট হয়েছে। দশহালিয়ার তিন কিলোমিটার, মঠবাড়ি, তেতুলতলার চর, আংটিহারা, মঠবাড়ি, গোবরা ঘাটাখালী, কয়রা সদরের তহশিল অফিস সংলগ্ন বেড়িবাঁধ, কাটকাটা, কাশির হাটখোলা, কাটমারচর, ২ নম্বর কয়রা, ৪ নম্বর কয়রা, পবনা, কাশির খালের গোড়া, হোগলা, উত্তর বেদকাশি গাতির ঘেরি, শাকবাড়িয়া, সুতির অফিস, নয়ানি, খোড়লকাটি, জোড়শিংসহ কয়েক স্থানের বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকেছে।
পাইকগাছা উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ১০ ইউনিয়ন ও এক পৌরসভার ৮৬ কিলোমিটার রাস্তা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ এবং ২৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৬৬০ হেক্টর চিংড়ি ঘের তলিয়ে এক কোটি ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। প্লাবিত এলাকায় ভেঙে পড়ে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা। সবমিলে দুই কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১০ হাজার। দাকোপ উপজেলায় ২০০ হেক্টর মৎস্য ঘের ভেসে গেছে। ৩৪ কিলোমিটার সড়ক, ২৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ১৫ মসজিদ, পাঁচ মন্দির, দুই হাজার ৮২৮ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবমিলে ১১ কোটি ২৭ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতির হিসাব করেছে উপজেলা প্রশাসন। ডুমুরিয়ায় প্রায় দেড় হাজার ঘের প্লাবিত হয়। বাঁধ উপচে ও সøুইসগেট দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে মাগুরাখালি, শরাফপুর, শোভনা, সাহস, খর্নিয়া, রুদাঘোরা ইউনিয়নের চিংড়ি ও মাছের ঘের ভেসে গেছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ৫ ইউনিয়নের প্রায় ১ হাজার ৮০০ হেক্টর আয়তনের ২ হাজার ৬৫০ ঘের ভেসে গেছে। এতে প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
বাগেরহাট থেকে এস এম সামছুর রহমান জানান, বাংলাদেশে আঘাত না হানলেও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট ও সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় জেলার নিম্নাঞ্চল। ভেসে গেছে মাছের ঘের ও ফসলি জমি। পানিবন্দি হয়ে পড়ে কয়েক হাজার মানুষ। সুন্দরবন থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৪টি মৃত ও ২টি জীবিত হরিণ। এদিকে টেকসই বেড়িবাঁধের দাবিতে জেলার বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বাগেরহাটের বলেশ^র, পশুর, পানগুছি, দড়াটানা, ভৈরবসহ নদ-নদীর পানি আস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এতে ডুবে যায়, মাছের খামার, পানের বরজ ও শাকসবজির ক্ষেত। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পূর্বসুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৪টি মৃত ও ২টি জীবিত হরিণ উদ্ধার করেছে সুন্দরবন বনবিভাগ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের ১৯টি জেটি, ৬টি জলযান, ১০ অফিস ও স্টেশনে টিনের চালা উড়ে গেছে, ভেঙে গেছে ২টি টাওয়ার, ২৪টি পাটাতনের রাস্তা। ৯টি মিষ্টিপানির পুকুর ডুবে গিয়ে লোনাপানি ঢুকে পড়েছে। প্রাথমিক ভাবে অবকাঠানোগত এই ক্ষতির পরিমাণ ৬০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ।
বরগুনা থেকে জাহাঙ্গীর কবীর মৃধা জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে সাগর উপকূলীয় জেলার বরগুনার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে কৃষি ও মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত জলোচ্ছ্বাসে অনেক এলাকা প্লাবিত হওয়ায় নদী তীরবর্তী এলাকায় নিরাপদ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। বরগুনা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত পায়রা, বিষখালী, বলেশ^র ও খাকদোনের উত্তালতায় উপকূলীয় বেড়িবাঁধের ৩৭টি স্থান বিধ্বস্ত হয়ে আড়াই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে বিপর্যস্ত হয়েছে ১৮ হাজার পরিবার। ভেসে গেছে ৩ হাজারের বেশি পুকুর ও ঘেরের মাছ।
সাতক্ষীরার কলারোয়া থেকে আব্দুল হামিদ জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ৩ দিনের বৃষ্টিপাত ও দমকা হাওয়ায় কলারোয়ায় আম চাষিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঋণে জর্জরিত অনেক ব্যবসায়ী ও আম চাষিরা পাওনাদারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রায় ৫ মাস তীব্র খরার পরে বঙ্গপোসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপজনিত কারণে গত মঙ্গলবার থেকে দমকা ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে কখনো হালকা গুঁড়িগুঁড়ি, কখনো মাঝারি, কখনো ভারি বৃষ্টিপাত হয়। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের সঙ্গে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে গাছের আম সংগ্রহ ও বেচাকেনা বন্ধ হয়ে যায়। এসময় দমকা ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টিপাতে হাজার হাজার মণ আম মাটিতে পড়ে ফেটে নষ্ট হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভয়ঙ্কর গতির ঝড় ‘ইয়াস’ আঘাত হানার খবর প্রচারে। ঝড়ে প্রায় সপ্তাহ খানেক আগে থেকে ভয়ঙ্কর গতির ঘূর্ণিঝড়ের খবর প্রচার হওয়ায় আম ক্ষতির ভয়ে ব্যবসায়ী ও চাষিরা ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি গাছ থেকে আম সংগ্রহ করে বাজারজাত করতে থাকে। এতে সাতক্ষীরার সুমিষ্ট সুস্বাদু হিমসাগর আমের বাজার মূল্য আড়াই হাজার থেকে নেমে ৮শ’ টাকায় বেচাকেনা চলতে থাকে। এতে আম চাষিরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হন।
ভোলা থেকে মো: জহিরুল হক জানান, ঘূণির্ঝড় ইয়াসের প্রভাবে ভোলায় বেড়িবাঁধ, মৎস্য ও কৃষিসহ ভোলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ভোলায় ৫১টি ইউনিয়নের প্রায় ১৬৯২৬০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাণিসম্পদেরে ক্ষতি হয়েছে অনেক। মারা গেছে ৭ হাজার পশু, হাঁস-মুরগি। ঘের ও পুকুরের মাছ বিভিন্ন অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম জানান মৎস্য খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছেÑ যার টাকার অংকে প্রায় ২২ কোটি ৮৪ লাখ টাকার মাছসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছে। পুকুর ২৪৩২টি, মাছের ঘের ৫৫৬টি, মাছ ধরার ট্রলার ৩১৫টি, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ৬৭৫ মে. টন, চিংড়ি ৮ মে. টন, মাছের পোনা ২০ লাখ। এর মধ্যে ১০ কোটি ৯৭ লাখ টাকার মাছ এবং ১০ কোটি টাকার অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পটুয়াখালী থেকে মো: জাকির হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জেলায় বেড়িবাঁধ, গ্রামীণ রাস্তাঘাট, মৎস্য ও কৃষিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রবল পানির চাপে প্লাবিত হয়ে জেলার মোট ২৮৭.৭৫ হেক্টর জমির ৫ কোটি ৯১ লাখ টাকার ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পটুয়াখালীতে ইয়াসের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারের পনিতে ভেসে গেছে ৫৯৩৫টি পুকুর ও ১৬৫০টি ঘের। ক্ষতির পরিমাণ ৫৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালী উপজেলায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাঙ্গাবালী উপজেলার ৮০ ভাগ মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের দুই দিনের তাণ্ডবে জেলায় ৫২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ৬১.৫ কোটি টাকা।
খুলনার কয়রা থেকে মোস্তফা শফিক জানান, ইয়াসের ছোবলে কপোতাক্ষ নদ ও শাকবাড়ীয়া নদীর নোনা পানিতে কয়রা উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টি ইউনিয়নের মানুষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত এবং ৩টি ইউনিয়নে আংশিক ক্ষতিসাধন হয়েছে। সরজমিনে ঘুরে এবং উপজেলা পরিষদের রেকর্ডে জানা গেছেÑ কয়রা উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টি ইউনিয়নের মানুষ এখনো নোনা পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। কয়রা উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পরে গত ২৬ মে ইয়াস এর ছোবলে প্রায় ৪০টি পয়েন্টে নোনা পানি ঢুকে পড়ে। এতে আমাদী ইউনিয়নের ৮ কিলোমিটার, বাগালী ইউনিয়নে ২২ কিলোমিটার, মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নে ১২ কিলোমিটার, মহারাজপুর ইউনিয়নে ১৪ কিলোমিটার, কয়রা সদর ইউনিয়নে ১৮ কিলোমিটার, উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নে ১৭ কিলোমিটার ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে ২২ কিলোমিটারসহ মোট ১২৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ক্ষতিসাধন হয়েছে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া থেকে এএম মিজানুর রহমান বুলেট জানান, উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ২৫টি গ্রামে অন্তত ৩০ হাজার মানুষ এবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সব কিছু হারিয়ে ওইসব গ্রামের মানুষ এখন অন্ধকার দেখছেন। অধিকাংশ গ্রামে দেখা দিয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। বেড়ে গেছে মানুষে দুর্ভোগ। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার অস্বাভাবিক জোয়ারের নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় এ উপজেলা লালুয়া ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম, ধানখালী ইউনিয়নের ৩টি গ্রাম, চম্পাপুর ইউনিয়নের ৪টি ও মহিপুর ইউনিয়নের ৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়। এছাড়াও অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি বেড়িবাঁধ টপকে নীলগঞ্জ, টিয়াখালী ও ধুলাসর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম পানিতে ডুবে যায়। অধিকাংশ গ্রামের মানুষ শেষ সম্বলটুকু ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে বাঁধের উপর। এদিকে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধের ভেতরের মৎস্য ঘের ও পুকুরগুলো তলিয়ে যায়। সরকারি হিসেবে এ উপজেলায় ৩ কোটি ৩ লাখ টাকার মৎস্য সম্পদ ভেসে গেছে বলে জানা যায়।
পিরোজপুর থেকে এস এস সোহেল বিল্লাহ জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস পিরোজপুরে সরাসরি আঘাত না হানলেও নদীর জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার দক্ষিণ অঞ্চল এবং নিম্নাঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নদীর পাড়ের বিভিন্ন এলাকার বাঁধ ভাঙার কারণে প্রাথমিকভাবে ১২ কোটি ৮০ লাখ টাকার ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া মাছের ঘের ডুবে যাওয়ায় জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকার প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির কথা জানিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারে জেলার ৫৯৬ হেক্টরের ২১৫৭টি মাছের ঘের তলিয়ে যাওয়ায় ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। এর ফলে মাছ চাষিদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে।
ঝালকাঠি থেকে মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ জানান, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ঝালকাঠি জেলার সুগন্ধা ও বিষখালী নদী তীরের ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বিভিন্ন স্থান ক্ষতবিক্ষত হয়। মাঝেমধ্যে সংস্কার হলেও বেশিরভাগই অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে বেড়িবাঁধের ৮টি এলাকার প্রায় ৪ কিলোমিটার ভেঙে যায়। ফলে পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে বসতঘর, ফসলের ক্ষেত ও মাছের ঘের। দুর্ভোগে পড়া নদী তীরের বাসিন্দারা দুর্বিষহ রাত কাটাচ্ছেন। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে পানি বেড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঁঠালিয়া উপজেলা বিষখালী নদীর বেড়িবাঁধটি। ৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ৩ কিলোমিটাররের বিভিন্নস্থান ভেঙে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তলিয়ে গেছে ফসলের ক্ষেত ও বসতঘর। পানি ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন স্থাপনায়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।