Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গঙ্গা যখন পরিণত হলো লাশের ভাগাড়ে

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২০ মে, ২০২১, ১২:০১ এএম

ভারতে গঙ্গায় সম্প্রতি উদ্ধার করা হয়েছে কয়েক শত লাশ। স্থানীয়দের ধারণা, এসব মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এখন পর্যন্ত ভারতে সরকারি হিসাবে করোনায় মারা গেছেন কমপক্ষে দুই লাখ ৭৫ হাজার মানুষ। কিন্তু স্থানীয়রা এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৃতের এই সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। যেমন নদীতে ভাসিয়ে দেয়া এসব মৃতের তথ্য সরকারি হিসাবের সঙ্গে যোগ হয়নি। এসব লাশ সম্প্রতি উজান থেকে ভেসে যায় উত্তর প্রদেশে। সেখানে দেখা যায়, একেবারে তীরে এসে আটকে আছে লাশগুলো। এ যেন লাশের ভাগাড়। তা কুকুর, কাক ছিড়ে খাচ্ছে। এ দৃশ্য নিয়ে ভিডিও রিপোর্ট হওয়ার পর টনক নড়ে প্রশাসনের। তারা এখন গঙ্গায় নেট বা জাল স্থাপন করেছে। কোনো লাশ ভেসে গেলে যাতে আটকা পড়ে। এসব নিয়ে অনলাইন বিবিসিতে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন লিখেছেন গীতা পান্ডে। তিনি লিখেছেন, কয়েক সপ্তাহে করোনা মহামারি বিধ্বস্ত করে দিয়েছে ভারতকে। এ পর্যন্ত কমপক্ষে দুই কোটি ৫০ লাখ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। লাশ নদীর তীরে নিয়ে যাওয়া হয়। অনবরত জ্বলছে চিতা। তারপরও লাশের স্তূপ জমে যাচ্ছে। এ ছাড়া অনেক মানুষ আছেন, যারা চিতায় লাশ দাহ করার খরচ বহন করার ক্ষমতা রাখেন না। তারা লাশ ভাসিয়ে দেন নদীতে। এসব নিয়ে গীতা পান্ডে কথা বলেছেন স্থানীয় সাংবাদিক, কর্মকর্তা এবং উত্তর প্রদশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে। এতে দেখা গেছে অনেকে প্রচলিত ধারণার ওপর ভিত্তি করে লাশ ভাসিয়ে দিয়েছেন। আবার অনেকে দারিদ্র্যের কারণে এটা করেছেন। উত্তর প্রদেশে প্রথম এই ভয়াবহতার খবর প্রকাশ পায় ১০ই মে। এদিন বিহার রাজ্যের সীমান্তবর্তী গ্রাম চৌসায় গঙ্গার তীরে ভেসে যায় ৭১টি লাশ। বক্সারের এসপি নীরাজ কুমার সিং বলেছেন, তারা এসব লাশের বেশির ভাগের ময়না তদন্ত করেছেন। ডিএনএ নমুনা নেয়া হয়েছে। তারপর দেহগুলো তুলে নদীর তীরে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, অনেক সময় মৃতদের দেহের বিভিন্ন অংশ ভেসে গিয়েছে ওই এলাকায়। ধারণা করা হয়, দাহ কাজ সম্পন্ন করে এসব নদীতে নিক্ষেপ করা হয়েছে। একদিন পরে চৌসা গ্রাম থেকে ৬ মাইল দূরে উত্তর প্রদেশের গাজিপুরের গাহমার গ্রামে নদীর তীরে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় কয়েক ডজন গলিত, অর্ধগলিত লাশ দেখা যায়। এসব লাশ কুকুর এবং কাকে ঠুকরে খাচ্ছিল। স্থানীয়রা বলছেন, কয়েকদিন ধরেই এসব লাশ নদীর তীরে ভাসছে। কিন্তু এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে বিহারে উদ্ধার হওয়া লাশগুলো নিয়ে যখন সংবাদ শিরোনাম হয়, তখনই ঘুম ভাঙে কর্তৃপক্ষের। এসব লাশের বেশির ভাগই ফুলে উঠেছিল। কোনোটায় পচন ধরেছে। কোনটা গলিত অবস্থায়। এ দৃশ্য দেখে পাশের বাল্লিয়া জেলার বিভিন্ন গ্রামবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা সকালে গঙ্গাস্নান করে পবিত্র হন প্রতিদিন। কিন্তু ওইদন গঙ্গায় গিয়ে এ দৃশ্য দেখে গা শিউরে ওঠে তাদের। দ্য হিন্দুস্তান পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে সেখান থেকে ৬২টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কান্নাউজ, কানপুর, উন্নাও এবং প্রয়াগরাজে নদীর পাড়ে দেখা যায় বেশ কিছু অগভীর কবর। কান্নাউজের মেহন্দিঘাটের তীর থেকে ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মানবআকৃতির মাটির স্তূপ। এমন অনেক। এর প্রতিটিতে রাখা হয়েছে লাশ। পাশেই মহাদেবীঘাটে কমপক্ষে ৫০টি লাশ পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা সাধারণত লাশ দাহ করে। আবার কোনো কোনো মহল ‘জলপ্রবাহ’ রীতি অনুসরণ করে। এ প্রথার অনুসারীরা শিশু, অবিবাহিত মেয়ে, সংক্রামক রোগে মৃত অথবা সাপের কামড়ে মৃতদের দেহ পানিতে ভাসিয়ে দেয়। অনেক গরিব মানুষ আছে, তারা লাশ দাহ করার সামর্থ রাখে না। তারা সাদা কাপড়ে লাশ মুড়িয়ে তা পানিতে ভাসিয়ে দেয়। অনেক সময় এসব মৃতদেহের সঙ্গে ভারি পাথর বেঁধে দেয়া হয়, যাতে তা ডুবে থাকে। সাধারণ সময়ে গঙ্গায় যেসব লাশ ভেসে যায় তা অস্বাভাবিক কোনো দৃশ্য নয়। এখন অল্প সময়ের ব্যবধানে, যখন করোনা সংক্রমণে বিপর্যস্ত ভারত, তখন এত লাশ একসঙ্গে গঙ্গায় ভেসে যাওয়া এক বিরল ঘটনা। শুধু তা-ই নয়, গঙ্গার বিভিন্ন স্থানে নদীর তীরে এসব লাশ পাওয়া গেছে। কানপুরের একজন সাংবাদিক বলেছেন, করোনায় মৃত্যুর সরকারি হিসাব এবং প্রকৃত হিসাবের মধ্যে কি পরিমাণ ব্যবধান তা এসব লাশ উদ্ধারই বলে দেয়। তিনি বলেন, ১৬ই এপ্রিল থেকে ৫ই মে পর্যন্ত কানপুরে সরকারি হিসাবে মারা গেছেন ১৯৬ জন। কিন্তু সাতটি শ্মশান থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, তারা প্রায় ৮০০০ লাশ দাহ করেছে। এপ্রিলে বৈদ্যুতিক চুল্লিগুলো দিনরাত ২৪ ঘন্টা জ্বলেছে। তারপরও তারা সামাল দিতে পারছিল না। ফলে প্রশাসন বাইরে নিয়ে কাঠ ব্যবহার করে লাশ পুড়িয়ে ফেলার অনুমতি দেয়। ওই সাংবাদিক আরো বলেন, ওই বৈদ্যুতিক চুল্লি বা শ্মশান শুধু ওইসব লাশ গ্রহণ করেছে, যেগুলো হাসপাতাল থেকে করোনায় মারা যাওয়ার সনদসহ তাদের কাছে গিয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে বিপুল পরিমাণ মানুষ মারা যাচ্ছেন। তাদের কোনো পরীক্ষা হচ্ছে না। তাদের পরিবার লাশ শহরের বাইরে অথবা উন্নাওয়ের মতো এলাকায় নিয়ে যাচ্ছে। যখন তারা কাঠ বা কোনো শ্মশান খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন, তখন নদীর বুকে মাটি খুঁড়ে সেখানে চাপা দেন লাশ। প্রয়াগরাজের একজন সাংবাদিক বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন বাড়িতে যেসব মানুষ মারা যাচ্ছেন তার বেশির ভাগই করোনায় আক্রান্ত। কারণ, তাদের কোনো পরীক্ষা হচ্ছে না। এসব মানুষ লাশ দাহ করার সামর্থও রাখে না। তিনি বলেন, বিষয়টি হৃদয়বিদারক। এসব মানুষতো কোনো না কোনো মানুষের হয় ছেলে, না হয় মেয়ে, ভাই, পিতা বা মা। তারা তো মৃত্যুর পরে একটু সম্মানের অধিকারী। কিন্তু মৃতের পরিসংখ্যানে তাদের নামটাও উঠছে না। তারা অজ্ঞাত হিসেবেই মারা যাচ্ছেন এবং সেভাবেই মাটিচাপা দেয়া হচ্ছে। নদীতে এভাবে লাশ মাটিচাপা দেয়া এবং পানিতে পচে যাওয়া লাশ থেকে স্থানীয়দের ভয়, এসব লাশ করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দেবে। তাই সংশ্লিষ্ট গ্রামগুলো জুড়ে আতঙ্কের এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। গঙ্গার উৎস হিমালয়ে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদীগুলোর অন্যতম এই গঙ্গা। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন একে খুব পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করেন। তারা বিশ্বাস করেন, গঙ্গায় স্নান করলে সব পাপ মুছে যায়। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় এর পানি ব্যবহার করা হয়। কান্নাউজের জগমোহন তিওয়ারি (৬৩) বলেন, তিনি ১৫০ থেকে ২০০ কবর দেখেছেন নদীর বুকে। সকাল ৭টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত এসব লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়েছে। এসব কবর আবিষ্কার হওয়ায় এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। লোকজনের আশঙ্কা, নদীর বুকে মাটিচাপা দেয়া এসব লাশ বৃষ্টি বা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলে আবার ভেসে উঠবে। এ অবস্থায় গত বুধবার রাজ্য সরকার ‘পানিপ্রবাহ’ রীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যারা লাশ সৎকার করতে অক্ষম তাদেরকে অর্থ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অনেক স্থানে লাঠি ব্যবহার করে, বোটম্যানদের ব্যবহার করে নদী থেকে পুলিশ লাশ তীরে আনছে। তারপর সেগুলো মাটির গর্তে চাপা দেয়া হচ্ছে অথবা দাহ করা হচ্ছে। বাল্লিয়ার এসপি বিপিন তাড়া বলেছেন, সচেতনতা সৃষ্টিতে তারা গ্রাম কাউন্সিলের নেতাদের নিয়ে কাজ করছেন। গাজিপুর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মঙ্গলা প্রসাদ সিং বলেছেন, তাদের টিম নদীর পাড় দিয়ে টহল দিচ্ছে। কেউ লাশ নদীতে ফেলতে গেলে তাদেরকে বাধা দিচ্ছে। এখনও তার টিম নদীতে প্রতিদিন একটি বা দুটি মৃতদেহের সন্ধান পাচ্ছে। বিবিসি, দ্য হিন্দুস্তান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ