Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে আমলের গুরুত্ব

প্রকাশের সময় : ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
॥ এক ॥
“তোমরা ভাল কাজের আদেশ কর, মন্দ কাজের নিষেধ কর” এই হচ্ছে কালামে পাকের একটি সর্বজন পরিচিত আয়াতাংশ। মূলত এই আয়াতাংশের নিহিত দু’টি কথাই হলো সুখী সমাজ গঠনের মূল প্রাণশক্তি।
যে কোন কাজ তা হয় ভাল নয় মন্দ, হয় কল্যাণকর না হয় ক্ষতিকর, অর্থাৎ প্রত্যেক কাজই এই দু’দিকে প্রসারিত। পৃথিবীতে এমন কোন লোক পাওয়া যাবে না যে ভালোর পরিবর্তে খারাপ কাজকে পছন্দ করবে, যদি কেউ খারাপ কাজকে পছন্দ করেই থাকে তবে সে ভাল মনে করেই করে, যদিও তা অজ্ঞতা সত্ত্বেও তার ফলাফল খারাপ হতে বাধ্য।
যেহেতু কেউ খারাপ চায় না, খারাপ পছন্দ করে না, সেহেতু সারা দুনিয়া তো স্বর্গ রাজ্যই” হওয়ার কথা ছিল কিন্তু আমরা কি দেখছি? পুরো বিপরীত চিত্রই, কিন্তু কেন? হ্যাঁ, এরই আলোচনা করার প্রয়াসী হব।
উপরোক্ত আয়াতে কারিমায় দু’টি অংশ রয়েছে, “ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ” কেউ যদি কাউকে ভাল কাজের আদেশ নয় অন্তত পরামর্শ দিতেও হয় তবে তাকে আগে ভাল কাজ করতে হয়, নচেৎ তার পরামর্শ কার্যকর বা ফলপ্রসূ হয় না, মানুষ তা গ্রহণ করতে আগ্রহী হয় না কিন্তু যখন কেউ আরেক জনকে ভাল কাজের আদেশ করবে তখন সে নিখুঁতভাবে ভাল হতে হবে বা ভাল কাজ করতে হবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই, আর তার নিজের ভাল কাজের মধ্যে যদি সামান্যতম ও ঘাটতি থাকে তবে তার ভাল কাজের বুলি উপেক্ষিত হতে বাধ্য। আর এদের সকলকেই বোধ হয় কালামে হাকীমে বলা, “তোমরা নিজেরা যা কর না তা অন্যদের করতে বল কেন?” আয়াতাংশের দ্বিতীয়াংশ হলো, “মন্দ কাজের নিষেধ” করা, যেহেতু ব্যাপারটা ঘবমধঃরাব তাই এটা প্রথমটার চাইতে অনেক কঠিন। কেননা একজন লোককে ভাল কাজের আদেশ করা যত সহজ মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা তত সহজ নয়, এটা করতে গেলে যত সব সমস্যা দেখা দেয়।
সত্য এবং মিথ্যার দ্বন্দ্ব যখন পৃথিবীর আদিকাল হতে সহাবস্থানে সেহেতু এগুলোর প্রতি মানুষের আকর্ষণ বা বিকর্ষণও তখন থেকেই। একজনের নিকট যা ভাল তা অপর জনের নিকট মন্দ আবার তার নিকট যা সুন্দর তা অপর জনের নিকট কুৎসিত। মূলত রুচিশীলতার ব্যত্যয়ের কারণেই এমনটি ঘটে থাকে। তারপরও চিরন্তন ও সার্বজনীন বলে যে একটা কথা রয়েছে সেটাও হচ্ছে বির্তকের নিরোধক। একেবারে নিরপেক্ষ মন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করলে যেটা বেরিয়ে আসে তা হল মানুষের দ্বারা নিখুঁত ভাল বা মন্দ নির্ণীত হতে পারে না। কেননা তার জ্ঞান, অনুভূতি, দৃষ্টিশক্তি সবই সীমিত। যে যা ভাল মনে করে হয়ত তাতে মন্দ বা যাকে মন্দ বলে প্রত্যাখ্যান করে তা-ই ভাল হতে পারে যা তার ধারণা বা বিবেচনার বহির্ভূত। তাই এই ক্ষেত্রে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য মাপকাঠিই এই সমস্যার সমাধান করতে পারে আর সেই চিরন্তন বা এবং সার্বজনীন মাপকাঠি পাওয়া যেতে পারে ধর্মীয় বিধি-বিধানে যা ¯্রষ্টার নিকট হতে প্রাপ্ত। এই ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ বলতে কেবল আল-কোরআনই ধর্তব্য। কেননা এটা প্রামাণ্যের মর্যাদায় সমাসীন। অন্যান্য যতসব গ্রন্থ রয়েছে তাতে রূপকথার নানা গল্প থাকলেও তা সন্দেহের ঊর্ধ্বে স্থান পায়নি শুধু তাই নয় দিন দিন সন্দেহ বাড়তেই থাকছে তাই প্রামাণ্য ঐশী গ্রন্থ হিসেবে “আল কোরআনই” ভাল মন্দ নির্ণয়ের নিখুঁতের মাপকাঠি।
আর এরই সহযোগী হিসেবে আল-হাদীসই বর্তমান যা কোরআনের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ। তৃতীয় যে মাপকাঠি তা হচ্ছে জাতির মহামানবদের সু-চিন্তিত ঐক্য আর চতুর্থ এবং সর্বশেষ যে মাপকাঠি তা হলো কিয়াস বা ধারণা যা পুরোপুরিভাবে পূর্বোক্ত ৩টির উপরই ভিত্তিশীল। এই মাপকাঠি চতুষ্ঠয়ের মধ্যেই কেবল ভাল মন্দ নির্ণীত হতে পারে এর বাইরে নয়। যদি কেউ এই মাপকাঠির বাইরে গিয়ে ভাল-মন্দ যাচাই করতে চায় তবে তা অবশ্যই সু-লক্ষণ নয় কু-লক্ষণই যা কোন মানুষ বিশেষতঃ কোন মুসলমান করতে পারে না।
যেহেতু আমরা সবাই মুসলমান তাই সবাই মুমিন ও আর একজন মুমিনের ঈমানের পর অত্যাবশ্যক কর্মটি হলো নামাজ যা নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব। হাদিস শরীফে বলা হয়েছে মুমিন ও কাফিরের মধ্যকার পার্থক্য হচ্ছে নামাজ ছেড়ে দেয়া। মানে নামাজ তরককারীর প্রতি রয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারি যা অন্য কোন ব্যাপারে বলা হয়েছে কিনা সন্দেহ। নামাজ সংক্রান্ত ব্যাপারে এত বেশি কঠোরতা প্রদর্শন করার কারণ হলো যে এটাই ঈমানের পরিচায়ক। কেননা কোরআনে বলা হয়েছে, “আমি জ¦ীন এবং ইনসানকে কেবলই আমার এবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি আর এবাদতের সর্বোত্তম প্রকাশ হচ্ছে নামাজ। হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, নামাজের চেয়ে উত্তম আর কোন এবাদত নেই। শুধু কি তাই? না, আরও বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন মানুষকে পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে নামাজ সংক্রান্ত ব্যাপারে আর যে ব্যক্তি নামাজ সংক্রান্ত মানে প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না তার পক্ষে আর কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব হবে না। আরো বলা হয়েছে, নামাজ অবহেলাকারীদের জন্যই রয়েছে জাহান্নাম। ভেবে দেখুন, নামাজের ব্যাপারে কেমন অনমনীয়তা প্রদর্শন করা হয়েছে। আর নমনীয়তারই বা কী থাকতে পারে? এটার উপরই যে মানুষের যাবতীয় মান-অভিমান জড়িত? কেননা একজন ব্যক্তি যদি “আল্লাহু আকবর” বলে তার মাথাটিকে মাটিতে অবনত করে তখন তার ভিতর আর কিছু থাকতে পারে না। সেখানেই সবকিছু শেষ আর এ জন্যই কপাল তথা সিজদা আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য দেয়া হারাম। এটাই মানুষের মূল্যবান অঙ্গ। এতক্ষণ যা বলা হলো তা তো কেবল নামাজের আবশ্যকতা নিয়েই বললাম, নামাজের নগদ ফলাফল নিয়েই বলি। নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অশ্লীল ও খারাপ হতে বিরত রাখে।
এটাই হচ্ছে নামাজের ফল। একজন মানুষ যখন সত্যিকার অর্থে নামাজ আদায় করে তখন সে কোন খারাপ কাজ করতে পারে না, পারে না কোন অশ্লীল কর্ম করতে। একজন নামাজী যখন নিয়মিত নামাজ আদায় করে তখন সে তার যাবতীয় কার্যাদি আল্লাহর বিধান মোতাবেক করতে সচেষ্ট হয়। আর প্রত্যেকেই যখন ভাল কাজের প্রতি আগ্রহী এবং মন্দ কাজের প্রতি বিরাগী হয় তখন সমাজ ভাল হতে বাধ্য। একজন মানুষ যখন নিয়মিত নামাজ আদায় করবে তখন তার পক্ষে সম্ভব নয় সুদ, ঘুষ খাওয়া ঠিক একইভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া, তেমনি তার পক্ষে সম্ভব নয় কোন বেগানা নারীর প্রতি লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করা। আর নারী ঘটিত যাবতীয় কেলেংকারীর মূলই হলো প্রাথমিক দৃষ্টি নিক্ষেপ। নামাজের কারণে যেহেতু প্রাথমিক দৃষ্টিই নিক্ষিপ্ত হতে পারলো না তাহলে কেলেংকারীর প্রশ্নই আসছে না। নারীঘটিত ব্যাপারটি যখন চুকে যাবে তখন সমস্যার অধের্কেই মিটে যাবে। আর বাকি অধের্কের ব্যাপারে আসুন জেনে নেই।
সুদ, ঘুষ এক কথায় দুর্নীতি হচ্ছে বর্তমান সমাজের মূল সমস্যা আর এ সমস্যা যদি চুকে যায় তা হলে বাকি অর্ধেক সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে, তখন সমাজ শান্তির আকরে পরিণত হওয়ার কথা। এবার আসুন মিথ্যা প্রসঙ্গে, যাবতীয় দুর্নীতির মূলেই হলো মিথ্যা বা (কুটকৌশল) যা একজন নামাজী করতে পারে না। কেননা একজন নামাজী ভালভাবে জানে যে “মিথ্যাই পাপের মূল”। যতদিন পর্যন্ত মিথ্যা ছাড়া যাবে না ততদিন নামাজ ফলবাহী হবে না। একটা ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘ একটা চালকবিহীন মেষ পালকের জন্য যতবেশি ক্ষতিকর নয় একজন মিথ্যাবাদী মানুষ একটা মনুষ্য সমাজের জন্য এর চেয়ে শত সহ¯্র গুণ বেশি ভয়ানক। কেননা মিথ্যাবাদীদের জন্য সবই সহজ ও সম্ভব। রোজাদার নিয়ে বলি, একজন সত্যিকার রোজাদার কখনো মিথ্যা বা দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারে না। দীর্ঘ এক মাসের শিক্ষা যদি কেউ কাজে লাগায় তাহলে পরবর্তী ১১মাস ব্যাপী তার জীবন হবে রমজান মাসের মতই স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত। তাই সুস্থ-সুন্দর ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে মাহে রমজানের বিকল্প নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে আমলের গুরুত্ব
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ