চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ফিরোজ আহমাদ : কর্জ আরবি শব্দ যার বাংলা হলো ঋণ। দৈনন্দিন জীবনে কর্জের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কর্জ দু’ধরনের। এক সুদযুক্ত দুই সুদমুক্ত। সুদবিহীন ঋণ ইসলাম সমর্থন করে। কোরআনের ভাষায় যাকে কর্জে হাসানা বলা হয়েছে। মানুষের চরিত্রের উত্তম গুণ হলো দানশীলতা। আত্মত্যাগ ও পারস্পরিক সহযোগিতা ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এক মুসলমান অপর একজন মুসলমানের সহযোগী। সূরা বাকারার ২৪৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, (তোমাদের মধ্য থেকে) কে হবে, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেবে, আল্লাহ পাক তার জন্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেবেন; আল্লাহপাক কাউকে ধনী কাউকে গরিব করেন। এখানে কর্জ বা ঋণ হলো সৎকর্ম। আল্লাহকে ঋণ দান শব্দটি রূপক। আল্লাহপাক সম্পূর্ণ অভাব মুক্ত। তিনি কখনো কারো মূখাপেক্ষী নন। আল্লাহকে ভালোবাসার মাধ্যম হলো তাঁর বান্দাকে ভালোবাসা। সরাসরি আল্লাহকে নগদ টাকা দানের কোন ব্যবস্থা নেই।
অভাবগ্রস্ত বান্দার অভাব পূরণে ঋণ দেয়া হলো কর্জে হাসানা। হযরত রাসূল (সঃ) বলেছেন, কোন মুসলমান অপর মুসলমানকে একবার ঋণ দিলে এ ঋণ দান আল্লাহর পথে দু’বার সদকা করার সমতুল্য ফজিলত। অপর এক হাদিসে হযরত রাসূল (সা.) বলেছেন, মানুষের মধ্যে উত্তম হলো সে ব্যক্তি, যে মানুষের কল্যাণ করে এবং মানুষের কল্যাণের জন্য চিন্তা ভাবনা করে। কারণ মানব কল্যাণ, মানব সেবা করা মুসলমানের সর্বোৎকৃষ্ট গুণ।
সুদ দেয়া-নেয়া এবং আদান-প্রদানের স্বাক্ষী হওয়া ইসলামে সম্পূর্ণ নিষেধ। মানুষের অভাব মোচনের জন্য আল্লাহ অনেক পথ খোলে দিয়েছেন। ইসলামে সব সময় হালাল রুজি খাওয়া ফরজ। ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হালাল রুজি খাওয়া। হালাল রুজি ব্যতীত ইবাদত কবুল হয় না। ইবনে মাজাহ শরীফে হযরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, মেরাজের রাত্রে আমি এমন একদল লোকের নিকট গমন করলাম, যাদের উদর একটি গৃহের ন্যায় বৃহৎ। আর তার মধ্যে বহু সংখ্যক সাপ বিদ্যমান যা বের হতে দেখা যায়। আমি জিব্রাঈলকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কোন শ্রেণীর লোক? তিনি বললেন, এরা সুদখোর। যারা আল্লাহকে প্রকাশ্যে ও গোপনে ভয় করবে। তারা কখনো সুদের সাথে সম্পৃক্ত হবে না। সুদ একটি জগণ্যতম অপরাধ। আমাদের দেশের কতিপয় অঞ্চলে বিকল্প সুদ ব্যবসা হিসেবে ভূমিহীন পত্তনি সুদ প্রথা চালু হয়েছে। যা আধুনিক সুদ প্রথার একটি নতুন সংস্করণ। ঘটনাটি এ রকম। পূর্বে মানুষ জমিন বন্ধক দিয়ে মহাজনের নিকট থেকে ঋণ নিতো। বর্তমানে পত্তনি ঋণ গ্রহীতার জমি থাকার প্রয়োজন হয় না। আগে টাকার পরিবর্তে টাকা গ্রহণ করতো। এখন ঋণ দাতা টাকার সাথে ভূমি শব্দটি জুড়ে দিচ্ছেন। অথচ ঋণ গ্রহীতার কোন জমিন নেই। এ ঋণের লভ্যাংশও অনেকে বেশি। ১ লক্ষ টাকায় বছরে ৩৬ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। যিনি ঋণ গ্রহণ করেন তিনি ১ লক্ষ টাকা ঋণ গ্রহণ করার সময় নগদ হাতে পান ৭৪ হাজার টাকা। পত্তনি ঋণের লভ্যাংশ ঋণ দানের সময় কেটে রাখা হয়। বর্তমানে এ ধরনের ঋণ গ্রহীতাদের কেউ কেউ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। সুদের নতুন সংস্করণ পত্তনি ঋণ ব্যবস্থা ইসলাম অনুমোদন করে না। এখানে কোন উদারতা নেই। ঋণ মওকুফের কোন ব্যবস্থা নেই। বুখারী শরীফে হযরত আবু বুরদা ইবনে মুসা (রা.) হতে বর্ণিত হযরত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, হে আবু বুরদা! তুমি ব্যাপক সুদের এলাকায় বসবাস কর। অতত্রব, কারো কাছে যদি তোমার কোনরূপ প্রাপ্য থাকে, আর সে যদি তোমাকে এক বোঝা খড়-কাঠ, এক গাঠুরী যব বা এক বোঝা ঘাসও হাদিয়া স্বরূপ দান করে তুমি তা গ্রহণ করবে না। কেননা তা সুদরূপে গণ্য হবে। ইসলাম হলো উদার। ইসলাম কখনো জুলুম করে না। যেখানে মানবতা নেই সেখানে ইসলাম নেই।
মুসলমান মাত্রই অপরের সুখে সুখী ও অপরের দুঃখে দুঃখী।
মুসলিম শরীফে হযরত আবু ইউসার (রা.) হতে বর্ণিত হযরত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যে অসমর্থ ঋণীকে সময় দান করবে কিম্বা তার ঋণ মাফ করে দেবে, মহান আল্লাহ হাশরের মাঠে তাকে রহমতের ছায়া দান করবেন। বুখারী শরীফে হযরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে হযরত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ করার নিয়ত রেখে অপরের মাল ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে, আল্লাহপাক তাকে সাহায্য করেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ঋণদাতার মাল নষ্ট এবং আত্মসাৎ করার নিয়তে ঋণ গ্রহণ করে, আল্লাহপাক তাকে ধ্বংস করেন। মুসলিম শরীফে হযরত হুজায়ফা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, পূর্ববর্তী যুগের এক ব্যক্তির ইন্তেকালের সময় ফিরিশতারা তার রূহ কবজ করতে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার জীবদ্দশায় কোন নেক আমল করেছ কী? প্রত্যুত্তরে সে বলল, না। ফিরিশতারা পুনরায় বললেন, স্মরণ করে দেখ তো! সে বলল, আমি মানুষকে ঋণ প্রদান করে গোলামদের নির্দেশ দিতাম তারা যেন দরিদ্র লোকদের অবকাশ দেয় এবং ধনীদের সাথে ভালো ব্যবহার করে। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ফিরিশতাদের বললেন, তোমরাও তার সাথে সদাচরণ কর। আমাদের কে ব্যবসা বাণিজ্যে কিম্বা যে কোন কাজ কারার লেনদেন করার সময় মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের কথা স্মরণ রাখতে হবে। দুনিয়ার জীবনের পরও একটি অনন্তকালের জীবন রয়েছে। দুনিয়ার ভালো কর্মের উপর আখেরাতের ভালো-মন্দ ফলাফল নির্ভর করবে। সূরা হাশরের ১৮নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহপাককে ভয় করো, প্রত্যেকের উচিত লক্ষ্য করা যে, আগামীকালের জন্য তোমরা কি পেশ করতে যাচ্ছো। সুতরাং ইসলাম যে সকল কাজ অনুমোদন করে না। এসব কাজ থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে। তাহলে আমাদের পরকালীন জীবন সুন্দর হবে। আর নিজের পছন্দ মতো শব্দ ব্যবহার করে সুদকে হালাল করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
লেখক : ধর্ম ও সূফীবাদ গবেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।