চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে সর্বোৎকৃষ্ট মাস শাহরু রমাদান। একজন মুসলিম মহান রবের অপার কৃপায় রহমত,বরকত, কল্যাণ ও মাগফিরাতে সিক্ত হয়ে জাহান্নামের ভয়াবহ আজাব হতে নিজেকে বাঁচানোর সুবর্ণ সুযোগ লাভ করে এ মমিান্বিত মাসে। এর মর্যাদা এত বেশী হওয়ার অন্যতম কারণ এ মাসেই পবিত্র কুরআনুল কারীম নাযিল হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন:‘রমাদান মাস, এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্খক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসের সিয়াম পালন করে’(সূরা বাক্বারা:১৮৫)।
ক. রমাদান মাসের ফজীলত : মহান রব প্রদত্ত সর্বশ্রেষ্ঠ মাস শাহরু রমাদান। এ মাস আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর বান্দাদের জন্য এক বিশেষ নিয়ামত। সাওয়াব অর্জনের মাধ্যমে মহান মনীবকে সন্তুষ্ট করার সর্বোৎকৃষ্ট সময়।আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: ‘লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ’(সূরা ক্বদর:৩)।আর এটি এ রমাদান মাসেই বিদ্যমান।হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন: ‘যখন রমজান মাস উপস্থিত হয় তখন জান্নাতের দ্বারসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের বন্ধী করা হয়’(সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)। হাদীসে কুদসীতে এসেছে, হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল -সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন, আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : “বনী আদমের প্রতিটি নেক আমল দশ হতে সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়, আল্লাহ তা’আলা বলেন তবে সাওম ব্যতীত। কেননা ইহা শুধু আমার জন্য আর আমিই এর প্রতিদান দিব” (সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)। রাসূল (সা.) আরো বলেন: ‘যে ব্যাক্তি রমাদান মাসের সিয়াম ঈমান ও সাওয়াবের আশায় পালন করে আল্লাহ তা’আলা তার অতীতের সকল পাপ ক্ষমা করে দেন’(সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)।
খ. শাহরু রমাদানে করণীয় : এ মাসের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল রয়েছে, প্রত্যেক মু’মিনের যে আমলগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সম্পাদন করা উচিত। নিম্নে সংক্ষেপে এ জাতীয় কয়েকটি করণীয় তুলে ধরা হলো- ১. সিয়াম পালন করা: ইসলামের পাঁচটি রুকনের অন্যতম হলো রমাদান মাসের সিয়াম পালন করা। তাই রমজান মাসের প্রধান কাজ হলো সিয়াম পালন করা।কুরআনুল কারীমের ভাষায়: ‘তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসের সিয়াম পালন করে’। এ রোযা প্রত্যেক সুস্থ, মুকীম, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং হায়েয-নেফাসমুক্ত প্রাপ্তবয়স্ক নারীর ওপর ফরজ। শরয়ী ওযর ছাড়া এ মাসের একটি রোযাও কোনো মুসলমান ইচ্ছাকৃতভাবে না রাখলে জঘন্য অপরাধী সাব্যস্ত হবে এবং কঠিন শাস্তির উপযুক্ত হবে।আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন: “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর” (সূরা বাকারা:১৮৩)। হাদীসে কুদসীতে এসেছে রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন: ‘রোযা আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেবো’। তবে শর্তসাপেক্ষে পরবর্তীতে আদায় করার সুযোগ রয়েছে। কুরআনুল কারীমের ভাষায়: ‘তবে কেউ অসুস্থ বা সফরে থাকলে অন্য সময়ে এ সংখ্যা পূর্ণ করবে’।
২. তাকওয়া অর্জন করা: সিয়াম সাধনার মূল লক্ষ্যই হলো তাকওয়া অর্জন।যেমন- আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন: “হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে,যেমনি ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে” (সূরা আল-বাক্বারা : ১৮৩)। ৩.জামা’আতের সাথে সময়ানুযায়ী সালাত আদায় করা: আল্লাহ তা’আলা বলেন: “নিশ্চয় সালাত মু’মিনদের ওপর নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা ফরয” (সূরা নিসা : ১০৩)। ৪.সালাতুত তারাবীহ আদায় করা: সালাতুত তারাবীহ আদায় করা এ বরকতময় মাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রাসূল (সা.) বলেন: “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের আশায় রমাদান মাসে সালাতুত তারাবীহ আদায় করে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়” (সহীহুল বুখারী)।
৫. সাহরী খাওয়া: সাহরী খাওয়ার মধ্যে অশেষ কল্যাণ ও বরকত রয়েছে এবং সিয়াম পালনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসূল -সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন: “তোমরা সাহরী খাও;কেননা সাহরীর মধ্যে বরকত রয়েছে” (সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)। ৬. ইফতার করা: সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করা বিরাট ফজিলাতপূর্ণ কাজ। কেননা রাসূল (সা.) বলেন: “মানুষ তৎক্ষন কল্যাণের মধ্যে থাকবে যতক্ষন সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করবে” (সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)। রাসূল (সা.) অন্যত্র বলেন:‘‘তোমাদের মাঝে যে সিয়াম পালন করে, সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করে, খেজুর না পেলে পানি দিয়ে ইফতার করবে।কেননা পানি হলো অধিক পবিত্র ’’ (সুনান আবু দাউদ)। নবী -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন : “পিপাসা নিবারিত হল, শিরা উপশিরা সিক্ত হল এবং আল্লাহর ইচ্ছায় পুরস্কার নির্ধারিত হল” (সুনানু আবূ-দাউদ)।
৭. ইফতার করানো : অপর রোযাদারকে ইফতার করানো একটি বিরাট সাওয়াবের কাজ। হাদীসে এসেছে: ‘‘যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে,সে তাদের সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে, তবে রোযাদারের সাওয়াব হতে বিন্দুমাত্র হ্রাস করা হবে না’’( ইবন মাজাহ)।
৮. কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করা : রমাদান মাস কুরআনের মাস। এ মাসের সঙ্গে কুরআনুল কারীমের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।কেননা এ মহিমান্বিত মাসেই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। মহান রবের ভাষায়: ‘রমাদান মাস, যাতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। (সূরা আল-বাকারাহ:১৮৫)। তাই নবী -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- রমাদান মাসে কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন: ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সবচেয়ে বেশি দানশীল ও বদান্য, রমজানে তাঁর দানশীলতা ও বদান্যতা অনেক আরো বেড়ে যেত। প্রত্যেক রমজানে জিবরাঈল (আ.) তাঁর সঙ্গে মিলিত হতেন এবং পুরো কুরআন একে অপরকে শোনাতে’ (সহীহুল বুখারী )। রাসূল (সা.) বলেন: তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর;কেননা ইহা কিয়ামতের দিন তার তিলাওয়াতকারীর জন্য শাফায়াতকারী হবে” (সহীহ মুসলিম)। রাসূল (সা.) আরো বলেন: “সিয়াম ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে, রোজা বলবে হে রব! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও বৈধ জৈবিক চাহিদা হতে বিরত রেখেছি, অতএব আমাকে তার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দিন। আর কুরআন বলবে আমি তাকে রাতের বেলায় নিদ্রা হতে বিরত রেখেছি তাই আমাকে তার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দিন। রাসূল (সা.) বলেন, অত:পর এতদ্বয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে” (আহমাদ)। তিনি অন্যত্র বলেন:‘‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ তিলাওয়াত করে, তাকে কমপক্ষে দশটি নেকি প্রদান করা হয়। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ’’ (সুনানুত তিরমিযি)। ৯. কুরআন বুঝার জন্য সচেষ্ট হওয়া : নারী-পুরুষ সকল মুসলমানের উচিৎ কুরআনুল কারীম বুঝার জন্য চেষ্টা করা। আর কুরআন নাযিলের মাসে তা বুঝার জন্য আরো বেশি চেষ্টা করা দরকার। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “এক কল্যাণময় কিতাব, ইহা আমি আপনার ওপর অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ গ্রহণ করে উপদেশ” (সূরা সোয়াদ:২৯)।
১০. আল্লাহ তা’আলার প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষণ করা : রমাদান মাস পাওয়া প্রতিটি মু’মিনের জন্য এক মহা সৌভাগ্যের বিষয়।কেননা এ মাসের মর্যাদা অনেক বেশী। যাতে বান্দার জন্য মহান মনীবের সন্তুষ্টি অর্জন করা অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশী সহজতর। কুরআনুল কারীমের ভাষায়: “তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার” (সূরা আল-বাকারাহ:১৮৫)।
১১. কল্যাণকর কাজ বেশি বেশি করা : এ মাসটি মহান রব প্রদত্ত ইবাদতের বিশেষ মওসুম। তাই সাধ্যানুযায়ী এ মাসে বেশি বেশি ভাল কাজ করা উচিত। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “তোমরা ধাবমান হও স্বীয় প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও যমীনের ন্যায়, যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে”(আল-ইমরান-১৩৩)। রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর ভাষায়:‘‘এ মাসের প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী এ বলে আহবান করতে থাকে যে, হে কল্যাণের অনুসন্ধানকারী তুমি আরো অগ্রসর হও! হে অসৎ কাজের পথিক,তোমরা অন্যায় পথে চলা বন্ধ কর। এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তা’আলা অগণিত লোককে জাহান্নাম হতে মুক্তি দিয়ে থাকেন” (সুনানুত তিরমিযী)।
১২. বেশি বেশি দান-সদাকাহ করা : এ মাসে বেশি বেশি দান-সাদাকাহ করার জন্য চেষ্টা করা, ইয়াতীম, বিধবা গরীব, মিসকীন ও অসহয়দের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও বেশি বেশি দান সদাকাহ করা, বিশেষত: করোনাভাইরাস নামক বৈশ্বিক মহামারীর ভয়াল ছোবলে আক্রান্ত অসহায় মানুষকে সহায়তা করা। মহান রবের ভাষায়:“অতএব তোমরা সৎকর্মে প্রতিযোগিতা কর” (সূরা আল-বাক্বারা:১৪৮)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত:‘‘রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমজান মাসে তাঁর এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত’’ (সহীহুল বুখারী)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।