Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পানি নেই কাঁদছে নদী

বিপন্ন প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য # চার দশকে ৮০টি নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে, নদীপথ শুকিয়েছে ১৬০০০ কিলোমিটার # পানিশূন্য নদীতে মাছ না পেয়ে পেশা পরিবর্তন করছে জেলেরা # নদ-নদীতে পানি না

রফিক মুহাম্মদ/এ কে এম আব্দুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২৫ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০২ এএম

এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা আজ পানিশূন্য। বিস্তৃর্ণ পদ্মার বুক ফসলের মাঠ। যমুনার বুকে পড়ছে চর। তিস্তার বুকে চিকচিক করছে ধু-ধু বালু। এরকম দেশের অধিকাংশ নদ-নদীই আজ পানিশূন্য। পানি হচ্ছে নদীর প্রাণ। সেই পানির জন্য হাহাকার করছে দেশের প্রতিটি নদী। অথচ কেউ শুনছে না নদীর এই কান্না। নদীকে জীবন্তসত্ত্বা ঘোষণা করে নদীর প্রাণ ফিরিয়ে দিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। দখলে-দূষণে মরছে নদী। অপর দিকে ভারতের ফারাক্কা ও গজল ডোবায় বাঁধ দিয়ে এবং উজানে তৈরি করা ৪০টি ড্যাম ও ব্যারাজ পানির গতি পরিবর্তন করে এদেশের নদীগুলোকে পানিশূন্য করা হয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত পলি জমে নদীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নানা ধরনের শিল্প বর্জ্যরে দূষণে নদীর প্রাণ বৈচিত্র্যও এখন হুমকির মুখে। পাশাপাশি নদীর পাড় দখল করে, কিংবা নদীর বুকেই চলছে অবৈধ নির্মাণ।
পদ্মা নদীতে পানি কমে যাওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। এতে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ধান চাষ হুমকির মুখে। ফারাক্কা বাঁধের ফলে তিস্তার বুক পানিশূন্য। এতে উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম তিস্তা সেচ প্রকল্পও বন্ধ হয়ে গেছে। নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষবাদ হচ্ছে না। নদ-নদীতে পানি না থাকায় উত্তারাঞ্চল মরুকরণের দিকে দ্রæত ধাবিত হচ্ছে। পানির অভাবে লতার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নদী হারিয়ে যাচ্ছে। নদীর মৃত্যুতে ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য। বদলে যাচ্ছে দেশের ভ‚প্রকৃতির চিত্র। বাংলাদেশের সর্বত্রই নদীর বুকে এখন ধু-ধু বালুচর। কোথাও কোথাও নদীর বুকে হচ্ছে ফসলের চাষ। এর ফলে বহু নদী বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হয়তো এর মধ্যেই হারিয়ে গেছে, নয়তো কোনো রকমে ধুঁকছে।
সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে নদ-নদীর সঠিক সংখ্যার তথ্য নেই। নদী নিয়ে গবেষণা করে এমন সংস্থার তথ্যমতে, এক সময় বাংলাদেশে নদ-নদীর (উপনদী-শাখা নদীসহ) সংখ্যা ছিল এক হাজারের ওপরে। বিশেষজ্ঞদের মতে ষাটের দশকে সাড়ে সাতশ’ নদী ছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। বর্তমানের ২৩০টির মধ্যে ৫৯টি আন্তর্জাতিক নদী। এগুলোর মধ্যে ৫৪টি ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আদি যুগে সহজ যোগাযোগের কারণেই নদী তীরে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশে সত্তরের দশকেও নদীপথে পণ্য পরিবহন হতো বেশি। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ভারতের বাঁধের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ অন্যদিকে নেয়ায় এই চার দশকে ১৬ হাজার কিলোমিটার নদীপথ কমে গেছে। স্বাধীনতার পর বিআইডাবিøউটিএ’র এক জরিপের তথ্যমতে বাংলাদেশে নদীপথের মোট দৈর্ঘ্য ছিল ২৪০০০ কিলোমিটার। কিন্তু এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৮০০০ কিলোমিটার। অর্থাৎ প্রায় চার দশকে ১৬০০০ কিলোমিটার নদীপথ শুকিয়ে গিয়েছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, বাংলাদেশে গত প্রায় চার দশকে ৫০ থেকে ৮০টা নদী, শাখা নদী এবং উপ-নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে। নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ায় জেলেরা এখন আর মাছ ধরতে পারছেন না। এতে তারা বাধ্য হয়ে পেশা বদল করছেন।
বিশিষ্ট পানিবিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেন, নদীর সংখ্যা নির্ধারণের আগে নদীর সংজ্ঞা আমাদের জানতে হবে। দখল-দূষণের বাইরেও নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করতে হবে। নদীর প্রবাহ কমে যাওয়া, সংকুচিত হয়ে যাওয়া এবং পানির গুণগত মান নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে নদীগুলো মরে যাচ্ছে। এ জন্য দখল এবং দূষণই মূলত দায়ী। এ জন্য পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছার অভাব পরিলক্ষিত হয়। আসলে নদী না বাঁচলে পরিবেশ এবং প্রতিবেশ বাঁচবে না। আর এসব না বাঁচলে মানুষও বাঁচবে না। তাই নদী রক্ষার বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।
হাওর-বাঁওর ও বহু নদ-নদী পরিবেষ্টিত দেশের ভাটি অঞ্চলের একটি জেলা নেত্রকোনা। ময়মনসিংহ গীতিকার সেই আলোচিত মহুয়া মলুয়া ও নদের চাঁদের স্মৃতি বিজড়িত এ জেলায় ছোট বড় ৮৫টি নদী প্রবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে কংশ, মগড়া, সোমেশ্বরী, ধনু, বিষনাই এসব নদী ছিল প্রমত্তা। দীর্ঘদিন যাবৎ সেসব নদ-নদীগুলো খনন না করায় কালের আবর্তে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানির সাথে আসা বালি ও পলি পড়ে বেশিরভাগ নদ-নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক নদ-নদীর তলদেশে এখন ধান চাষ হচ্ছে।
নেত্রকোনা জেলার নদ-নদী সারা বছর পানিতে টইটুম্বর থাকত। পাল তোলা নৌকার সাথে সাথে লঞ্চ-স্টিমার ও কার্গো জাহাজ চলাচল করত। নৌপথে পণ্য পরিবহন খরচ কম হওয়ায় এ অঞ্চলের বেশিরভাগ ব্যবসায়ী নৌযানে তাদের মালামাল পরিবহন করতো। এছাড়াও নদীতে মাছ ধরে হাজার হাজার জেলে পরিবার জীবিকা নির্বাহ করত। এক সময়ের খরস্রোতা নদ-নদীগুলো কালের বিবর্তনে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় সে সব নদ-নদীতে এখন আর আগের মতো পানি নেই। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পলি-বালি জমে বেশিরভাগ নদ-নদী এখন তাদের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। নদীর বুকজুড়ে তৈরি হচ্ছে ফসলের মাঠ।
নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা জেলার ৮৫টি নদ-নদীর মধ্যে বড় বড় কংশ মগড়া সোমেশ্বরী, ধনু ও উব্দাখালী নাম বলতে পারলেও বেশিরভাগ নদীর নাব্যতা হারিয়ে যেতে বসায় তাদের নাম বলতে পারছে না। এরই মধ্যে নেত্রকোনা থেকে হারিয়ে যেতে বসা নদ-নদীগুলো হচ্ছে, আত্রাখালী নদী, কাওনাল নদী, কাকুরিয়া নদী, কানসা নদী, কানাই নদী, কালিয়ারা নদী, কালিহর নদী, কর্ণ বালজা নদী, কালা পানি ঝরা নদী, গুনাই নদী, জলকান্দি নদী, জল শিমুলকান্দি নদী, জারিয়া নদী, তেওড়াখালী নদী, ধলাই নদী, ধোপখলা নদী, ধুপিখালী নদী, নিতাই নদী, বাউরী নদী, ছিলা নদী, তুষাই নদী, বল নদী, বলী নদী, বালই নদী, বেদুরী নদী, বানোয়ারী নদী, বারুণী নদী, বালিয়া নদী, বাঁকহারা নদী, বিষনাই নদী, বেতাই নদী, মরা সুরমা, নয়া নদী, পাতকুড়া নদী, পিয়াইন নদী, সিনাই নদী, রাজেশ্বরী নদী, ধলেশ্বরী নদী, পাটেশ্বরী নদী, ফুলেশ্বরী নদী, লাউয়ারী নদী, সুতি নদী, সুরিয়া নদী, সাইঢুলি নদী, সোনাই নদীসহ আরও অনেক নদী।
জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কলেজপড়–য়া শিক্ষার্থী ফয়সাল বলেন, এলাকার প্রবীণদের কাছে অনেক নদ-নদীর নাম শুনেছি; কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ নদীর প্রকৃতরূপ আমরা দেখতে পাইনি। মদন উপজেলার মগড়া নদী থেকে ফতেপুর ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামের পেছন ও নায়েকপুর ইউনিয়নের চন্দ্রতলা গ্রামের সামনে দিয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে পাশের উপজেলা কেন্দুয়ার সাইডুলি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এ ছাড়াও ধলাই নদী ছত্রকোনা গ্রামের পেছন দিয়ে প্রায় ৪ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে তিয়শ্রী ইউনিয়নের সাহিতপুর গ্রামের পেছনের মগড়া নদীতে মিলিত হয়েছে। এলাকার কতিপয় প্রভাবশালী মহল ছত্রকোনার পেছনের অংশসহ বিভিন্ন অংশ যে যার মতো দখলে নিয়ে পানি শুকিয়ে মাছ ধরে ধান চাষ করেছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অদৃশ্য কারণে নীরব থাকায় সচেতন মহলের ধারণা, এক সময় হতো মানচিত্র থেকে এ নদীটি হারিয়ে যাবে। এলাকার জেলেরা নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময় পানি না থাকায় জেলেরা এখন অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
নদীতে পানি থাকায় চলছে দখলের মহোৎসব। দুই তীরে যাদের জমি আছে তারাই নদী দখলে নিচ্ছে। যাদের জমি নেই তারাও ধান লাগানোর ছলনায় নদী দখল করছে। কেউ কেউ সুবিধা অনুযায়ী নদী থেকে বালি উত্তোলন করে অন্যত্র বিক্রি করে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজি মো. আব্দুর রহমান বলেন, নদী থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হবে। যে সব নদ-নদী খননের প্রয়োজন তার একটি তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হবে।
সিলেট বিভাগে প্রায় শতাধিক নদনদী রয়েছে। অনেক নদীই ভারত থেকে এসেছে, যা আন্তঃসীমান্ত নদী নামে পরিচিত। আর সিলেটের সকল নদীই সুরমা ও কুশিয়ারায় মিলিত হয়েছে। তবে অধিকাংশ নদীই বর্তমানে অস্থিত সংকটে রয়েছে। বিশেষ করে সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা, খোয়াই, মনু, দাড়াইন, কালনী, পিয়াইন, সারি, গোয়াইন, সোনাই, ধলাই, জুড়ি, সুতাং নদীর নাব্যতা হারিয়ে অস্থিত সংকটে পড়েছে। নদীগুলো উজানে ভারতে বাঁধ, নদীর পাশে কল-কারখানা গড়ে উঠা, ময়লা-আবর্জনা, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন, দখল-দূষণ, পাহাড় টিলা কাটার কারণে নদীগুলো অস্থিত সংকটে পড়েছে।
চলন বিলের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া বড়াল নদীকে দেখলে বিশ্বাসই হবে না যে এটি একটি নদী। এর বুকের ঠিক মাঝ বরাবর তৈরি করা হয়েছে একটি ক্রস-ড্যাম বা আড়ি-বাঁধ। এটি একই সঙ্গে সড়ক হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এই বাঁধ নদীটিকে মাঝ বরাবর কেটে দু’টুকরো করে ফেলেছে। বড়ালে পানি আছে। তবে নদীতে যেমন পানি প্রবহমান থাকে। বড়ালে তেমনটি নয়। নদীর জল স্থবির। কচুরিপানায় ঢাকা। বেশ কয়েকটি বাঁধ এবং সুইস গেটের কারণে নদীটি খন্ড খন্ড হয়ে গিয়েছে। বড়ালে পাড়ের বাসিন্দা মো. খলিল জানান, বড়াল দিয়ে এক সময় হাজার-বারশ’ মণ মালবাহী নৌকা চলাচল করত। চাটমোহর ছিল ব্যস্ত এক বন্দর। চলন বিলের কৃষিপণ্য বড়াল বেয়ে চালান হয়ে যেত দূর-দূরান্তে। কিন্তু এখন এই নদীর পানি পাখিও পান করে না।
টাঙ্গাইল শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া লৌহজঙ্গ নদীটি এখন একটি ড্রেন। নদীর এই শাখার ওপরই নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল মার্কেট। ময়মনসিংহের পুরোনো ব্রহ্মপুত্র, নেত্রকোনার মগড়া, কংশ ও সোমেশ্বরী, যশোরের ভৈরব, কপোতাক্ষ, ইছামতী, বেতনা, মুক্তেশ্বরী; কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা, ঘোড়াউত্রা, ফুলেশ্বরী; খুলনার রূপসা, শিবসা, ডাকি, আত্রাই-এর মতো নদীগুলো এখন মৃত্যুর দিন গুণছে। একই চিত্র ফরিদপুরের কুমার, বগুড়ার করতোয়া, কুমিল্লার গোমতী, পিরোজপুরের বলেশ্বর, রাজবাড়ির গড়াই, কুড়িগ্রামের ধরলা, গাইবান্ধার ঘাঘট, বান্দরবানের সাঙ্গু, খাগড়াছড়ির চেঙ্গী, নওগাঁর আত্রাই, জামালপুরের ঝিনাই নদীর।
ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তা ব্যারেজের মতো মানুষের তৈরি বাধার কারণে মরে যাচ্ছে নদী। অন্যদিকে মানুষ তার লোভ কিংবা মুনাফার টানে নদীর শুধু গতিপথই বদলে দিচ্ছে না, আঘাত করছে নদীগুলোর প্রাণবৈচিত্র্যেও। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বংশী, বালু, লৌহজঙ্গ কিংবা শীতলক্ষ্যার মতো নদীগুলোর দু’ধারে যে শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে, তার অপরিশোধিত বর্জ্য গিয়ে পড়ছে এসব নদীতে। ফলে বিষক্রিয়ায় মরে যাচ্ছে নদীর প্রাণ। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা এরই মধ্যে মারা গেছে। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যার পাড়ে গেলে পানি অসম্ভব দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। পানিতে দ্রবীভ‚ত অক্সিজেনের পরিমাণ এখন ন্যূনতম মাত্রার চেয়েও কম।
ভারতের আগ্রাসী পানিনীতি আর এ অঞ্চলের মানুষের কাছে মরণবাঁধ হিসাবে খ্যাত ‘ফারাক্কা ব্যারাজ’ বিগত সাড়ে চার দশকে পদ্মা ও তার শাখা-প্রশাখাগুলোকে প্রাণহীন করেছে। একসময়ের অন্যতম নদী হিসাবে পরিচিত পদ্মা এখন বিশাল বালিচরের নিচে চাপা পড়ে হাহাকার করছে। দেখলে মনে হয় নদী নয় যেন নদীর ক্ষীণ ধারা। একসময়ের চঞ্চলা দূরন্ত যৌবনা আর দূরন্ত হয়ে ছুটে চলা পদ্মা এখন মরা নদীর নাম। শাখা-প্রশাখা নদী বড়াল, মরা বড়াল, নারদ, মুছাখান, ইছামতি, ধলাই, হুড়াসাগর, চিকনাই, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, নবগঙ্গা, চিত্রা, বেতা কালিকুমার, হরিহর, কালিগঙ্গা, কাজল, হিসনা, সাগরখালি, চন্দনা, কপোতাক্ষ, বেলাবত এদের অস্বীত্ব প্রায় বিলীন। বর্ষার সময় কিছু পানি থাকলেও সারা বছর থাকে শুকনো। নৌকা নয় চলে চাষাবাদ। এসব নদীর নাম মানচিত্র আর কিছু বইয়ের পাতায় অস্তিত্ব বজায় রেখেছে।
ফারাক্কা ছাড়াও আরো বেশকটি নদীতে ভারত বাঁধ দিয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে তিস্তা, মহানন্দা, করতোয়া, আত্রাই ও ধরলা। এসব নদীতে বাঁধ দেয়ার ফলে নদী ছাড়াও এর শাখা উপশাখা নদীগুলো অস্তিত্ব হারানোর পথে। যেমন পুনর্ভবা, টাঙ্গন, চাওয়াই, নাগর, চিলফা, টেপা, ডাহুক, ভেরসা, পাথরাজ, তিরনাই, সিনুয়া, হাতুড়ির অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে।
ভারত তার পানি আগ্রাসী নীতিতে গঙ্গায় ফারাক্কা ব্যারাজ দিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশের মহাবিপর্যয় ডেকে এনে ক্ষান্ত হয়নি। ভারত সীমান্তের ওপারে তিস্তা নদীর ওপারে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে পুরো উত্তারঞ্চলে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এক সময়ের খরস্রোতা তিস্তা নদীও পদ্মার পরিণতি লাভ করেছে। ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে কুষ্টিয়া যেমন গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। তেমনি গজলডোবা ব্যারাজের কারণে তিস্তার ১২৫ কিলোমিটারজুড়ে এখন পানির বদলে বালির উত্তাপ। তিস্তাসহ এ অঞ্চলের ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, আলিয়া, দুধকুমার, বুড়ি, তিস্তাসহ ৩৫টি ছোট বড় নদ নদী অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। উত্তরের নীলফামারী রংপুর গাইবান্দা বগুড়া জয়পুরহাট জেলার ৩৫ উপজেলায় সাড়ে তের লাখ একর জমিতে চাষাবাদের জন্য সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে নির্মিত দৃষ্টি নন্দন তিস্তা ব্যারাজ পানির অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের পানি প্রত্যাহরে যেমন নদী মরছে তেমনি অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন প্রকল্প করেও নদী ধ্বংস করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহ-সভাপতি ডা. মো: আব্দুল মতিন বলেন, সরকার নদী রক্ষায় আন্তরিক নয়। নদী রক্ষার আইন আছে; কিন্তু তার যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। হাইকোর্ট নদীকে জীবন্ত সত্তা বলে ঘোষণা করে নদীর প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। অথচ নদীর দূষণ ও দখল কোনটাই থামছে না। নদী ধুঁকে ধুঁকে মরছে। যারা নদী রক্ষার দায়িত্বে তারা এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।



 

Show all comments
  • Md. Mofazzal Hossain ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৩৪ এএম says : 0
    গভীর পুকুর জাতীয় জলাশয় লাগবে। যা পানি ধরে রাখবে
    Total Reply(0) Reply
  • অজানা দ্বীপ ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৩৬ এএম says : 0
    চাষীদের বলবো, সবাই মিলে একত্রিত হয়ে পানি তোলার জন্য টিউবয়েল স্থাপন করুন তাহলে হয়তো সমস্যার সমাধান হবে উপরওয়ালার ইচ্ছায়
    Total Reply(0) Reply
  • Sudipta Dhali ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৩৭ এএম says : 0
    এটা একটা সময়োপযোগী প্রতিবেদন। এভাবে সারাদেশের মানুষের কথা "দৈনিক ইনকিলাব" এর মত জাতীয় পত্রিকায় তুলে ধরার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • Tushar Mondal ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৩৮ এএম says : 0
    খাল খনন গুলো ঠিকঠাক হলে। পানির অভাব থাকত না।
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ নাজমুল ইসলাম ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৩৯ এএম says : 0
    আজ চারদিকে দুর্যোগের প্রকোপ দেখলে হলিউডের সেই সিনেমার কাহিনি সত্যি মনে হয়। আমরা যতই প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করব, ততই সে বিরূপ আচরণ করবে। তাই ভালো থাকার উপায় প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা নয় বরং এর সঙ্গে মিলেমিশে থাকা। কেননা, দিন শেষে আমরা যে সবকিছু প্রকৃতি থেকেই পাই!
    Total Reply(0) Reply
  • Sibbir Ahmed ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৪ এএম says : 0
    আমাদের দেশে দিন দিন অনেক নদ-নদী দখল করছে এদেশের অনেক বিত্তবানরা|সরকারের উচিত এ বিষয়ে গূরুতর পদক্ষেপ নেয়া|
    Total Reply(0) Reply
  • RA S EL ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৪ এএম says : 0
    নদী বাংলাদেশের দুগ্ধবতী গাভির মত| নদী বাচলেই বাচবে এদেশ|
    Total Reply(0) Reply
  • Md Jewel Rana ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৪ এএম says : 0
    নদি না থাকলে কি লাভ বেচে থেকে
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammad Hashibul Islam ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৪ এএম says : 0
    বাংলাদেশে নদনদীর ভবিষৎ অন্ধকার তবে মরুভুমির ভবিষৎ আলোকিত।
    Total Reply(0) Reply
  • Alam Azizul ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৫ এএম says : 0
    বাংলাদেশর নদী ভারতের বাঁধ নির্মানের ফলে মঙ্গল গ্রহের নদীর ধারার মত রুপ নিছে
    Total Reply(0) Reply
  • Amir Hossen Rubel ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৫ এএম says : 0
    নদীমাতৃক দেশ ছিল বাংলাদেশের অতীত,, বর্তমান হচ্ছে নদীদূষণ মাতৃক দেশ।
    Total Reply(0) Reply
  • Hasan Muzahid ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৫ এএম says : 0
    মূল কারণ নদীতে পানির প্রবাহ নেই সব নদীর উৎস মুখে বাধ দিয়ে ফল খাচ্ছে দাদারা আমরা শুকিয়ে কাঠ।
    Total Reply(0) Reply
  • Mizanur Rahman ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৬ এএম says : 0
    নদীর পানি নষ্ট হবে না কেন, মিল-ফ্যাক্টরি গুলো অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলে। কিছু ফ্যাক্টরি পরিবেশ অধিদপ্তরের চাপে পরে ETP প্লান্ট বানিয়েছে কিন্তু কেমিক্যালের অতিরিক্ত দামের কারণে বন্ধ ই রাখে আর কালে ভদ্রে চালায়। সরকারের এই বিষয়টি অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত, সকল মিল - ইন্ডাস্ট্রিজ গুলোকে ETP চালানো ব্যতিরেক প্রডাকশন নিষিদ্ধ এমন কঠোর হওয়া উচিত, তবেই নদী বাঁচবে আমরা বাঁচব।
    Total Reply(0) Reply
  • S M Bayazid Shikder ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৬ এএম says : 0
    দেশকে আত্মসম্পদে পরিনত করাই নদী দূষনের প্রধান অন্তরায়। কারণ, দাদা প্রিতী আজ তুঙ্গে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে টিপাইমুখ আর ফারাক্কা বাধ, দেশ মরু হলে কার বা যায় আশে
    Total Reply(0) Reply
  • M Mamun ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৭ এএম says : 0
    সৌন্দর্যের কথা ভাবার সময় নেই রাষ্ট্রের নেতাদের, তাদের ভাবনা ক্ষমতা আর অর্থ।
    Total Reply(0) Reply
  • Abu Saleh Sumon ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৭ এএম says : 0
    দাদারা যে ৪০ বছরে বাংলাদেশের বড় বড় নদীগুলো শেষ করে দিলো, সে নিয়ে কিছু বলতে গেলে মুখে কুলুপ এটে যায়, ভূপেন?
    Total Reply(0) Reply
  • Bonny ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ৩:৪০ এএম says : 0
    Patriotism depends on water.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ