Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভাব দূর করতে গিয়ে লাশ হলেন

গন্ডামারায় হাফেজ মীরের মায়ের আহাজারি

চট্টগ্রাম ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ২০ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০০ এএম

মাহমুদ রেজা ওরফে মীর খান (১৮) পবিত্র কোরআনের হাফেজ। দাখিল পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু লকডাউনে পরীক্ষা দেয়া হয়নি। দুই বছর আগে বাবা মারা যান। তিন বোনের বিয়ে দিতে গিয়ে ধার দেনায় বিপর্যস্ত গোটা পরিবার। এ অবস্থায় পরিবারের হাল ধরতে মাত্র ১০ দিন আগে মাসিক ১৬ হাজার টাকা মজুরিতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিকের কাজ নেন মীর খান। মাস শেষ হওয়ার আগেই গুলিতে লাশ হয়ে ফিরেন তিনি।
তার এমন মৃত্যুতে অভাবগ্রস্ত পরিবারটি এখন দিশেহারা। বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব বড়ঘোনা গ্রামের আহমদ আলী মিয়াজি বাড়িতে এখনও চলছে শোকের আহাজারি। বিলাপ করে কাঁদছেন সন্তানহারা মা নূরাইন জান্নাত। ভাই-বোনসহ পরিবারের স্বজনদের কান্নায় ভারী এলাকার বাতাস। তাদের সান্ত¡না দিতে যারা এসেছেন তাদেরও চোখে পানি।
হাফেজ মীর খানের মত গুলিতে নিহত আরও চারজনের বাড়িতেও কান্নার রোল। হতদরিদ্র এসব পরিবারের অভাব-অনটন গুছিয়ে সবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তারা ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিকের কাজ নেন। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হলো না। কফিনে বন্দি হয়ে ফিরে যেতে হলো নিজ নিজ বাড়িতে। তাদের মৃত্যুতে দিশেহারা এসব পরিবার। একমাত্র উপার্জনক্ষমকে হারিয়ে পরিবারের সদস্যরা এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন।
গত শনিবার সকালে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গন্ডামারায় এস আলম গ্রæপের মালিকানাধীন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। গুলিতে ঘটনাস্থলে চারজনসহ পাঁচজন শ্রমিক প্রাণ হারান। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন আরও ৩০ জন শ্রমিক।
কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশের গ্রামেই নিহত মীর খানের বাড়ি। রোজা রেখেই ওইদিন কারখানায় যান তিনি। কয়েক ঘণ্টা পর বাড়িতে খবর আসে পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন মীর খান। মীর খানের ভাই আহমদ রেজা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমাদের এখন সংসার চলবে কিভাবে। তিন বোনের বিয়ে দিতে গিয়ে বহু ঋণ হয় আমাদের। দুই বছর আগে বাবা মারা গেলে সীমাহীন বিপদে পড়ি আমরা। এরপরও মা বড় ভাইকে ঋণ করে ওমান পাঠান। কিন্তু সেখানে তিনি ভালো চাকরি না পাওয়ায় আয়–রোজগার তেমনটা হতো না। আমিও শহরের একটি মাদরাসায় পড়াশোনা করি। আমাদের কষ্ট লাঘবেই মীর খান শ্রমিকের চাকরি নিয়েছিল। তার স্বপ্ন ছিল পরিবারের দুঃখ গোছাবে।
নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার আদর্শ গ্রামের আবদুল মতিনের ছেলে মো. রায়হান। মা-বাবার কষ্ট লাঘবে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিকের চাকরি নেন। থাকতেন শ্রমিক ব্যারাকে। রোজা অবস্থায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ যায় তার। চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানার মিনাজপুর এলাকার দরিদ্র পরিবারের সন্তান মো. রনি। অভাবী পিতা ওলীউল্লাহর সংসারের কষ্ট গোছাতে সুদূর বাঁশখালীতে এসে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। কয়েক মাস বেতনও পেয়েছেন। বাড়িতে কিছু টাকাও পাঠিয়েছেন। ঈদের ছুটিতে মা-বাবা, ভাই-বোনদের জন্য নতুন কাপড় নিয়ে ফেরার কথা ছিল তার। কিন্তু ফিরতে হল সাদা কাফনে কফিনবন্দি হয়ে।
একই কষ্টগাথা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার নজরুলের ছেলে মো. শুভ’র। বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারা ইউনিয়নের পূর্ব বড়ঘোনা এলাকার ফারুক আহমদের ছেলে মাহমুদুল হাসান রাহাতেরও। তাদের পরিবারেও চলছে আহাজারি। হাসপাতালে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন গুলিবিদ্ধ ৩০জন। সন্তানের পাশে পিতা-মাতার বিনিদ্র রজনী পার হচ্ছে। সংসারের হাল ধরতেই তারা এসেছিলেন বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এখন তাদের ভবিষ্যত অন্ধকার। চিকিৎসকরা বলছেন, গুলিবিদ্ধ অনেকের অবস্থা এখনও শঙ্কামুক্ত নয়। হাসপাতাল ছাড়তে তাদের সময় লাগবে। এদের কয়েকজন পুরোপুরি সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কিনা তা নিয়েও সংশয়ে চিকিৎসকেরা।
মাসের ৫ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ, পবিত্র রমজান মাসে কর্মঘণ্টা ১০ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টা, শুক্রবার ৮ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৪ ঘণ্টা এবং ইফতার ও মাগরিবের নামাজের বিরতিসহ নানা দাবিতে বিক্ষোভ করেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজের শ্রমিকেরা। বিক্ষোভের একপর্যায়ে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন কিছু শ্রমিক। তখনই পুলিশ গুলি ছুড়তে থাকলে এ ঘটনা ঘটে। হতভাগ্য এসব শ্রমিকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি করেছে বিভিন্ন সংগঠন।



 

Show all comments
  • মোঃ+দুলাল+মিয়া ২০ এপ্রিল, ২০২১, ১২:১৯ এএম says : 0
    বাংকারদের পরিবারকে 50 লক্ষ টাকা দিতেছে এই সমস্ত পরিবারের পতি বিবেচনা করতে পারে সরকার।
    Total Reply(0) Reply
  • MD Tarikul Islam ২০ এপ্রিল, ২০২১, ১:১৯ এএম says : 0
    তাকে যথাযথভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক।
    Total Reply(0) Reply
  • রফিকুল ইসলাম ২০ এপ্রিল, ২০২১, ১:১৯ এএম says : 0
    মানুষের এই আহাজারি সহ্য করার মতো নয়।
    Total Reply(0) Reply
  • তানিম আশরাফ ২০ এপ্রিল, ২০২১, ১:২০ এএম says : 0
    হে আল্লাহ তুমি পরিবারটির ওপর রহম করো।
    Total Reply(0) Reply
  • Jibon Hasan ২০ এপ্রিল, ২০২১, ৯:২৪ এএম says : 0
    Bangladesh is Singapore now. This is called our real Bangladesh. Shame on .......
    Total Reply(0) Reply
  • Jack+Ali ২০ এপ্রিল, ২০২১, ১:৫৭ পিএম says : 0
    আমরা কিসের জন্য দেশ স্বাধীন করেছিলাম হানাদার পাকিস্তান আর্মি ও রাজাকারদের কাছ থেকে? আমাদের সরকার হানাদার পাকবাহিনীর থেকেও শত শত গুন নিষ্ঠুর! আমাদেরকে পাখির মত গুলি করে মারছে গুম করছে মিথ্যা কেস দিয়ে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষকে জেলে ঢুকাচ্ছে আমাদের লক্ষ্য কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাঠাচ্ছে আওয়ামী গুন্ডারা চাঁদাবাজির জন্য জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সর্বোপরি এরা আমাদের দেশকে ধ্বংস করে ফেলেছে. ও আল্লাহ আমাদেরকে বাচাও এই জালেম সরকার থেকে : ও আল্লাহ একজন মুসলিম লিডারকে দিয়ে দেশ শাসন করাও কোরআন দিয়ে তাহলে আমরা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারব, তাহলে আমরা আর জুলুমের শিকার হবো না
    Total Reply(0) Reply
  • Jack+Ali ২০ এপ্রিল, ২০২১, ২:০৪ পিএম says : 0
    "আর যে কেউ বিশ্বাসীকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে, তার প্রতিদান জাহান্নাম, চিরকাল থাকবে এবং আল্লাহর ক্রোধ তাঁর উপর বর্তাবে এবং তার অভিশাপ। তার জন্য প্রস্তুত একটি গুরুতর যন্ত্রণা "(আল-নিসা ': 93) "পৃথিবীর ধ্বংস একটি মুসলিম মানুষের হত্যার চেয়ে আল্লাহর উপর লাইটার", (তিরমিযী) আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাবার তওয়াফ করছিলেন এবং বললেন, তুমি কত আনন্দিত, আর তোমার সুগন্ধ কতটুকু! আপনি কতটা মহৎ, এবং আপনার পবিত্রতা কত মহান! কিন্তু যার হাতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, বিশ্বাসী, তার সম্পদ ও রক্তের পবিত্রতা, আপনার পবিত্রতার চেয়ে আল্লাহর দৃষ্টিতে অধিকতর, আর আমরা তাকে ভালভাবে চিন্তা করি না। (ইবনে মাজাহ) আবু ধর বর্ণনা করেছেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন: হে আমার বান্দারা, আমি নিজের জন্য জুলুম নিষেধ করেছি এবং তোমাদের মধ্যে আমি তা নিষিদ্ধ করেছি, সুতরাং একে অপরের উপর অত্যাচার করো না। [মুসলিম 2577] সূরা ফাতির (فاطر), আয়াত: ৩৭ وَہُمۡ یَصۡطَرِخُوۡنَ فِیۡہَا ۚ  رَبَّنَاۤ اَخۡرِجۡنَا نَعۡمَلۡ صَالِحًا غَیۡرَ الَّذِیۡ کُنَّا نَعۡمَلُ ؕ  اَوَلَمۡ نُعَمِّرۡکُمۡ مَّا یَتَذَکَّرُ فِیۡہِ مَنۡ تَذَکَّرَ وَجَآءَکُمُ النَّذِیۡرُ ؕ  فَذُوۡقُوۡا فَمَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ نَّصِیۡرٍ ٪ অর্থঃ সেখানে তারা আর্ত চিৎকার করে বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, বের করুন আমাদেরকে, আমরা সৎকাজ করব, পূর্বে যা করতাম, তা করব না। (আল্লাহ বলবেন) আমি কি তোমাদেরকে এতটা বয়স দেইনি, যাতে যা চিন্তা করার বিষয় চিন্তা করতে পারতে? উপরন্তু তোমাদের কাছে সতর্ককারীও আগমন করেছিল। অতএব আস্বাদন কর। জালেমদের জন্যে কোন সাহায্যকারী নেই। ﴿وَأَنِيبُوٓاْ إِلَىٰ رَبِّكُمۡ وَأَسۡلِمُواْ لَهُۥ مِن قَبۡلِ أَن يَأۡتِيَكُمُ ٱلۡعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنصَرُونَ ٥٤ ﴾ [الزمر: ٥٤] ‘তোমরা স্বীয় রবের অভিমুখী হও এবং তার আজ্ঞাবহ ও অনুগত হও তোমাদের কাছে আযাব আসার পূর্বে। এরপর তোমাদের সাহায্য করা হবে না।’ (সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৫৪) * আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿ وَٱتَّقُواْ ٱلنَّارَ ٱلَّتِيٓ أُعِدَّتۡ لِلۡكَٰفِرِينَ ١٣١ ﴾ [ال عمران: ١٣١] ‘তোমরা ওই আগুনকে ভয় কর, যা কাফেরদের জন্য তৈরি করা হয়েছে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১) * আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন: ﴿ إِنَّآ أَعۡتَدۡنَا لِلۡكَٰفِرِينَ سَلَٰسِلَاْ وَأَغۡلَٰلٗا وَسَعِيرًا ٤ ﴾ [الانسان: ٤] ‘নিশ্চয় আমরা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি শিকল, বেড়ি ও প্রজ্জ্বলিত অগ্নি।’ (সূরা আল-ইনসান, আয়াত: ৪) * আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন: ﴿ إِنَّآ أَعۡتَدۡنَا لِلظَّٰلِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمۡ سُرَادِقُهَاۚ﴾ [الكهف: ٢٩] ‘নিশ্চয় আমরা যালিমদের জন্য আগুন প্রস্তুত করেছি, যার প্রাচীরগুলো তাদেরকে বেষ্টন করে রেখেছে। (সূরা আল-কাহফ, আয়াত: ২৯)
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: লাশ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ