চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ইসলামে মানব উন্নয়ন আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের মূল বিষয়। কুরআন মাজীদের মৌলিক বিষয় হলো মুসলিমের আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত সমৃদ্ধি ও কল্যাণের জন্য মানব উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ গঠন। এ উন্নয়নের জন্য ইসলাম মানুষের দৈহিক আকৃতিতে মানুষ হওয়ার সাথে সাথে মানবিক ঔদার্য ও মানসিক সৌন্দর্যের অধিকারী হওয়ার উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। ইসলাম ঘোষণা করেছে, আল্লাহ তা’য়ালার সৃষ্টি হিসেবে মানুষ সম্মানিত এবং শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তা’লাই মানুষকে এ শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি তোমাদেরকে দুনিয়ার প্রতিনিধি বানিয়েছেন’।
তিনি অন্যত্র বলেছেন: নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দিয়েছি, তাদেরকে স্থলভাগে ও সাগরে চলাচলের বাহন দিয়েছি, তাদেরকে পবিত্র জীবিকা দিয়েছি এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের উপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। তবে মানুষের এ শ্রেষ্ঠত্বকে আল্লাহ তা’য়ালা স্থায়ী ও অক্ষয় করে দেননি। বরং মানুষের আচরণিক ও আত্মিক উন্নয়ন করা ও না করার উপর এর ভিত্তি স্থাপন করেছেন। কেউ যদি আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশনা মেনে নিজের আচরণ ও মানসিকতা উন্নত করে তাহলে সে তার শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে। আর যদি এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় তাহলে নীচ থেকে নীচতর স্তরে নেমে যাবে। ‘‘আল্লাহ তাআলা এ সম্পর্কে বলেছেন: নিশ্চয় আমি মানুষকে সুন্দরতম করে সৃষ্টি করেছি। এরপর আমি তাকে সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে দিয়েছি’’। মানুষের মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার পথ হিসেবে আচরণিক ও আত্মিক উন্নয়ন অনিবার্য করে ইসলামে মানবসম্পদ উন্নয়ন চেষ্টা নৈতিকভাবে সকলের জন্য বিধিবদ্ধ উপায়ে আবশ্যিক করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে আবশ্যিক হয়েছে জ্ঞান অর্জন, হালাল জীবিকা উপার্জন ও গ্রহণ, স্বনির্ভরতা অর্জন, কর্তব্য পালন, যোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বারোপ, আখিরাতে সফলতা- ব্যর্থতাকে মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ এবং বিশেষভাবে নৈতিক উন্নয়ন।
মুমিন হওয়ার জন্য জ্ঞান অর্জনকে ইসলাম প্রথম শর্ত হিসেবে গণ্য করেছে। আল্লাহ তাআলা প্রথম মানুষ আদম আ. কে সৃষ্টির পর সবার আগে বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান দান করেছেন এবং এ জ্ঞানের পরীক্ষাতেই আদম আ. এর মাধ্যমে ফেরেশতাদের উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। কুরআন মজীদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, আল্লাহ আদমকে প্রতিটি বিষয়ের নাম শেখালেন। এরপর তা ফেরেশতাদের সামনে পেশ করলেন এবং বললেন, ‘যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে আমাদের এগুলোর নামসমূহ জানাও।’ ফেরেশতাগণ বললেন, আপনি মহাপবিত্র। আপনি আমাদের যা শেখান, তা ছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয় আপনি মহাজ্ঞানী, মহা প্রজ্ঞাময়।’ আল্লাহ বললেন,‘হে আদম! তুমি যাদেরকে বিষয়গুলোর নাম জানিয়ে দাও।’এরপর যখন আদম তাদেরকে বিষয়গুলোর নাম জানিয়ে দিলেন, আল্লাহ তাআলা বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নিশ্চয় আমি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অদৃশ্য সম্পর্কে জানি? আর আমি খুব ভালভাবেই জানি যা তোমরা প্রকাশ কর এবং যা গোপন রাখ। যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ছাড়া সকলেই সিজদা করল। ইবলীস অবাধ্য হল ও অহঙ্কার করল এবং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।
রাসূলুল্লাহ সা. যখন রিসালাত লাভ করলেন তখন তাঁর উপর প্রথম যে ওহী নাযিল হল তাও জ্ঞানার্জন বিষয়ক। হিরাগুহায় ধ্যানমগ্ন রাসূলুল্লাহ সা. প্রথম ওহী লাভ করলেন, পড়–ন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন; যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত হতে। পড়–ন এবং আপনার প্রতিপালক মহাসম্মানিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন তা, যা সে জানত না। জ্ঞানকে মর্যাদা ও কল্যাণের বাহন বর্ণনাকরে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা তাদের মর্যাদা উচ্চ করে দেবেন।” অন্যত্র বলা হয়েছে, তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমাত দান করেন। আর যাকে হিকমাত দেয়া হয় তাকে বিপুল কল্যাণ দান করা হয়। আর জ্ঞানীরা ছাড়া কেউ তো উপদেশ গ্রহণ করে না। আল্লাহ তাআলা সাধারণভাবে জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি উচ্চতর গবেষণারও নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অতএব হে চক্ষুষ্মান মানুষেরা! তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। জ্ঞানের প্রতি আল্লাহ তাআলার এমন গুরুত্বারোপের পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ সা. জ্ঞান অর্জনকে ফরয ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রতিজন মুসলিমের উপর ফরয। জ্ঞানীকে তিনি নবী-রাসূলগণের উত্তরসূরী আখ্যায়িত করে বলেছেন, আলিমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী। আর নবীগণ উত্তরাধিকার হিসেবে দীনার বা দিরহাম রেখে যাননি। তারা উত্তরাধিকার রেখে গেছেন শুধু জ্ঞান। তাই যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করেছে সে অর্জন করেছে উত্তরাধিকারের পুরো অংশ। জ্ঞানার্জনের কাজকে তিনি আল্লাহর পথে জিহাদের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণে বের হয়েছে, সে আল্লাহর পথে রয়েছে, যতক্ষণ না সে প্রত্যাবর্তন করে। এভাবে ইসলাম জ্ঞানার্জন ও গবেষণার কাজকে বাধ্যতামূলক রেখে মানবসম্পদ উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এতে এমন বিধান রাখা হয় যে, একজন মানুষ মুসলিম হলে তাকে অবশ্যই শিক্ষিত হতে হয়। শিক্ষিত হওয়া ছাড়া মুসলিম হওয়ার বিষয়টি বিধিগতভাবে অসম্ভব বলে গণ্য হয়।
আল্লাহ তাআলার ইবাদত যেমন ফরয, ইসলামে জীবিকা উপার্জনকে তেমন ফরয করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এরপর যখন সালাত আদায় শেষ হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে, আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করবে এবং আল্লাহর বেশি বেশি যিকর করবে, এতে তোমরা সফল হবে। আবার জীবিকা উপার্জনের ক্ষেত্রেও হালা-হারামের সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে এমন প্রবলভাবে যে, ইবাদত কবুল হবে কি না, ব্যক্তি জান্নাতে যাবে কি না তা একান্তভাবে জীবিকা উপার্জনের পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল রাখা হয়েছে। ফলে ইসলামে একজন ব্যক্তি কেবল জীবিকাই উপার্জন করে না বরং হালাল উপায় অবলম্বন করে বৈধভাবে জীবিকা উপার্জন করে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, হালাল উপার্জন অন্বেষণ করা ফরযের পরে ফরয। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, তোমরা উত্তম ও পবিত্র বস্তু আহার করো, যা আমি তোমাদের জীবিকারূপে দিয়েছি এবং কৃতজ্ঞতা আদায় করো আল্লাহর, যদি তোমরা একান্তই তাঁর ইবাদাত করো। আল্লাহর রাসূল সা. এ প্রেক্ষাপটেই বলেছেন, হারাম সম্পদে তৈরি গোশত ও রক্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং হারাম সম্পদে তৈরি প্রতি টুকরো গোশত ও প্রতি ফোটা রক্তের জন্যে নরকই যথোপযুক্ত আবাস।
ইসলাম সাধারণভাবে সকল মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সকলের জন্য অর্পিত কর্তব্য পালন আবশ্যিক করেছে এবং এ ক্ষেত্রে যে কোন অবহেলাকে আল্লাহ তাআলার নিকট জবাবদিহিতার বিষয় বলে সতর্ক করেছে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব, ইমাম বা নেতা, যিনি জনগণের ওপর দায়িত্ববান-তিনি তার অধীনদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবেন। আর ব্যক্তি, যে তার পরিবারের সদস্যদের দায়িত্বশীল- সে তার পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী দায়িত্বশীল তার স্বামীর পরিবারের সদস্যদের ও সন্তান-সন্ততির। সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। আর দাস ব্যক্তি তার মনিবের সম্পদের দায়িত্বশীল এবং সে এই সম্পদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কাজেই সতর্ক হও! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে (পরকালে আল্লাহর নিকট) জিজ্ঞাসিত হবে। ইসলাম একন্তভাবে মানুষকে এ শিক্ষা দিয়েছে, কেউ কারো বোঝা বহন করবে না।
আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন, যারা সরল-সঠিক পথে পরিচালিত হবে নিশ্চয় তারা তাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যই সঠিক পথে পরিচালিত হবে। আর যারা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হবে তারা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হবে তাদের নিজেদের ধ্বংসের জন্যই। কেউ কারো কাজের দায় বহন করবে না। আর আমি রাসূল পাঠিয়ে সতর্ক করা ছাড়া কাউকে শাস্তি দেই না। ইসলামের এ নীতি একান্তভাবে দায়িত্ব সচেতন করে এবং দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে। এ নীতি মানুষকে এমনভাবে ভাবতে শেখায় যে, কেউ অন্য কারো কবরে যাবে না। কেউ অন্য কারো কাজের জবাবদিহিতা করবে না। সাধারণভাবে কেউ অন্য কারো কাজের সুফল বা দায় ভোগ করবে না। বরং প্রত্যেককে নিজ নিজ কাজের সুফল বা কুফল ভোগ করতে হবে। এ শিক্ষার ফলে মানুষ নিজেকে দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে গড়ে তোলে। এটি তার ব্যক্তি সত্তার উন্নতি বিধান করে।
ইসলাম মানুষে মানুষে মানবিক কোন ব্যবধান বা বৈষম্য স্বীকার করেনি। মানবিক মর্যাদায় সাধারণভাবে সকলকে সমান মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করেছে। মানুষের উৎস ও বিস্তার সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা এ বিষয়টি নির্দেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন, যিনি সৃষ্টি করেছেন সে ব্যক্তি থেকে তার জোড়া, আর তাদের দুজন থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন অসংখ্য পুরুষ ও নারী। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অন্যের নিকট কিছু চাও। আর তোমরা আত্মীয়দের (হক আদায় ও সম্পর্ক অটুট রাখার) ব্যাপারে সতর্ক হও। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।
আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন, হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। রাসূলুল্লাহ সা.বলেছেন, হে মানবজাতি! সাবধান! নিশ্চয় তোমাদের রব একজন, তোমাদের পিতাও একজন। সতর্ক হও! কোন আরবের উপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোন কালোর উপর সাদার কিংবা সাদার উপর কালোর তাকওয়া ব্যতীত কোন মর্যাদা নেই। সাধারণভাবে সকল মানুষকে এভাবে সমান ঘোষণার পর কুরআন ও হাদীসে মানুষের উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্বের জন্য বিশেষ যোগ্যতা অর্জনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে ব্যক্তিই সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি তাকওয়াবান। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।