Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

নৈতিকতাই গণতন্ত্রের শক্তি

প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন | প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০২১, ১২:০১ এএম

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়ে। ৫০ বছরে জাতি হিসাবে আমাদের অর্জন কম নয়। অর্থনীতি এক সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গেছে। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। তবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা ছাড়া এ উন্নয়ন কতটুকু টেকসই হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। উন্নয়নে এগিয়ে গেলেও নৈতিক এবং মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি।

মহান স্বাধীনতা দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল। যে কারণে দেশ স্বাধীন হয়েছে সে কারণগুলো ১৯৪৭ সালের আগেও ছিল। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা চলে যেতে বাধ্য হলো। নেহেরু চাইলেন অখন্ড ভারত। কংগ্রেসের দাবি ছিলো ভারত ভাগ। মুসলিম লীগ বলল, আমরা পাকিস্তান চাই। আর শ্যামাপ্রসাদ বললেন, আমরা বাংলা ভাগ চাই। ১৯৪৬ সালে যে নির্বাচন হলো তাতে পূর্ব বাংলা এবং পাঞ্জাবে মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। পরে ভারত বিভাগের সময় ওই দুটোকেই ভাগ করা হলো। হিন্দুরাই বাংলা ভাগ করেছে। আর এই ঘটনার মধ্যেই ভারতের ধর্মীয় উন্মাদনা নিহিত। সাধারণ মানুষ না চাইলেও নেতাদের রাজনৈতিক স্বার্থে তখন বাংলা ভাগ করা হলো। বাংলা ভাগ হওয়ার সময় মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিলো মূলত হিন্দুরা। তাদের অনেকে চলে গেলেন পশ্চিমবঙ্গে। আর যারা দরিদ্র তাদের অনেকে গেলো ত্রিপুরায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির শূন্যতা তৈরী হলো। ভারত থেকে আসা বিহারী বা অবাঙ্গালী সে শূন্যতা পূরণ করতে শুরু করলো। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠি এই সুযোগটা নিলো। দেশ ভাগের পর মুসলিম লীগের নেতৃত্ব এই অঞ্চলের গণমানুষের মনের কথা বুঝতে পারেনি। তারা ওইসব বিহারীদের পুনর্বাসন করলো। তাদের দিয়ে তারা এই দেশ শাসনের পরিকল্পনা করলো। উর্দু ভাষা চালুর চেষ্টা করলো। বাংলা ভাষার উপর আসে প্রথম আঘাত।

৬০এর দশকে বামধারার রাজনীতি সক্রিয় ছিলো। তবে তারা তাদের সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা সাধারণ মানুষের কাছে পেীঁছাতে ব্যর্থ হয়। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা সহজে মানুষ গ্রহণ করে। তিনি এই ছয় দফার মধ্যে সবকিছুই নিয়ে আসেন। ১৯৬৬-৭১ ছিলো ছাত্রলীগের ঐতিহ্যময় সময়। মেধাবীরাই তখন ছাত্রলীগ করতেন। তারাই বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। ছয় দফা হয়ে উঠে বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ। এক সাগর রক্তের বদলে আসে স্বাধীনতা। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত রাখে। ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা করেন। সোনার বাংলা গড়তে শুরু হয় নতুন পথ চলা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ায় মনোযোগ দেন তিনি। তৎকালীন মার্কিন পরাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলে বসেন বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি। তার এ উক্তি ছিলো বাস্তব। কোন খনিজ সম্পদ নেই। নেই কোনো ভারী শিল্প কারখানা। চারিদিকে শুধু ধ্বংসের চিহ্ন। আর ছিলো বিপুল জনসংখ্যা। তবে সে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর পুরো কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বল্প সময়ে অর্থনীতির যে ভিত রচনা করেছেন তাকে বিকশিত করছেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের উন্নয়ন বিশে^র অনেক দেশের কাছে এখন মহাবিস্ময়।

অর্থনৈতিকভাবে দেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে। আগে একজন এ কে খান ছিলেন। এখন এ কে খানের সংখ্যা হাজার হাজার। ধনীক শ্রেণি তৈরী হচ্ছে। ৫০ বছরের পথচলায় যে সমৃদ্ধি এসেছে তাতে ভাল ভূমিকা রেখেছে শিক্ষা। শিক্ষার হার বাড়ছে। কৃষকরা উন্নয়নের কারিগর। নারীরাও এগিয়েছে। বিশেষ করে তৈরী পোশাক খাতে তাদের অবদান অনেক। বিদেশে যেসব শ্রমিক আছেন তারা দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দিচ্ছেন। তবে তাদের প্রশিক্ষিত করে বিদেশে পাঠানো গেলে রেমিটেন্স প্রবাহে আরও গতি আসতো। এ জন্য কারিগরি শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। উচ্চ শিক্ষিত যারা বিদেশে যান তারা আর ফিরে আসেন না। ফলে যারা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখেন তাদের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিকদের ব্যাপারেও মনোযোগ দেয়া জরুরি। তারা এখন শোষণের শিকার। শারীরিকভাবে তারা দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাদের সন্তানরাও দুর্বল হচ্ছে। সমাজের বিশাল অংশ পুষ্টিহীনতা নিয়ে বড় হচ্ছে।

অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হলেও নৈতিক দিক দিয়ে আমরা পেছনে পড়ে যাচ্ছি। দুর্নীতি এখন সর্বগ্রাসী। এমন কোন সেক্টর নেই, যেখানে দুর্নীতি নেই। একটা শ্রেণি তৈরী হয়েছে তারা দুর্নীতিকে এখন আর কোন অপরাধ মনে করে না। দশ হাজার টাকা বেতন পান, ঘর ভাড়া দিচ্ছেন ২০ হাজার টাকা। দুর্নীতি এখন দৃশ্যমান। এসব দুর্নীতিবাজদের সন্তানরাও অপরাধ করতে দ্বিধা করছে না। দুর্নীতির কারণে সমাজে নানা ধরনের অপরাধ বাড়ছে। একটি শ্রেণি অবাধে বিদেশে অর্থ পাচার করছে। কেউ ভারতে, কেউ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডায় বাড়ি করছে।

দুর্নীতির করে কেউ রাতারাতি কোটিপতি হচ্ছে। এতে সমাজে বৈষম্য বাড়ছে। এর ফলে এক শ্রেণির মধ্যে হতাশা তৈরী হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম বিপথগামী হচ্ছে। পরিবার সমাজে অস্থিতরা বাড়ছে। সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক চর্চা নেই। এই থেকে পরিত্রাণ পেতে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। প্রাথমিক স্কুল থেকে নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দিতে হবে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা বাড়াতে হবে। নতুন প্রজন্মকে আত্মপরিচয়ে বলিয়ান করে তোলার মত শিক্ষানীতি খুবই জরুরি। দুর্নীতি দমনে সত্যিকার অর্থে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। তবেই দুর্নীতিবাজদের লাগাম টেনে ধরা যাবে। এ জন্য বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে আইনের শাসনও জরুরি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল কথা ছিলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। একদিনের গণতন্ত্র নয়, সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিলো। অথচ স্বাধীনতার এত বছর পরও গণতন্ত্র যথাযথ অবস্থানে ইেন। পরিতাপের বিষয় হলো, দেশে সত্যিকার অর্থে কোন শক্তিশালী বিরোধী দল নেই, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য। এই সুযোগে উগ্রবাদী কোন গোষ্ঠির উত্থান হলে পরিনতি হবে ভয়াবহ। দেশে গণতান্ত্রিক কোনো প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে কাজ করছে না। ভিন্নমত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগও সংকুচিত। শিক্ষাঙ্গনে যা চলছে তা কোনভাবেই কাম্য নয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি থাকবে না। সেখানে থাকবে মেধাভিত্তিক মুক্ত বুদ্ধির চর্চা। ছাত্ররা আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি সে সম্ভাবনাকে ¤øান করে দিচ্ছে। একটা জাতির জীবনে ৫০টি বছর কম সময় নয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে এখন আর পেছনে তাকানোর সময় নেই। আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। উন্নয়নের সাথে নৈতিক সমাজ গঠনই এখন সময়ের দাবি। নৈতিকতাই গণতন্ত্রের শক্তি।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী, সাবেক ডিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন