পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আজ ২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনও আজ। আমাদের স্বাধীনতা ৫০তম বর্ষ অতিক্রম করে ৫১তম বর্ষে পদার্পণ করলো। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার সূচনা করে। হানাদার বাহিনীর এই হামলা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে তখনই দুর্বার প্রতিরোধ শুরু হয়ে যায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে বেতারে ঘোষিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা। এই ঘোষণা গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে ও লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘ ৯ মাসের মরণপণ সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশমাতৃকা হানাদারমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শাহাদাত বরণ করেন, অসংখ্য মানুষ আহত হন, বহু মা-বোন সম্ভ্রম হারান, সম্পদ-সম্পত্তির বেশুমার ক্ষতি হয়। এত কিছুর বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা, যার প্রতীক্ষায় যুগযুগ ধরে অপেক্ষায় ছিল দেশের মানুষ। স্বাধীনতা যে কোনো জাতির জন্য পরম আকাক্সক্ষার বিষয়। আত্মপ্রতিষ্ঠার অধিকার, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, সুশাসন, অর্থনৈতিক মুক্তি, বৈষম্যের অবসান ইত্যাদি ছিল আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য। এইসব লক্ষ্য অর্জনের প্রত্যাশা নিয়েই জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং বিপুল ত্যাগ ও মূল্যে স্বাধীনতার স্বপ্নের বন্দরে উপনীত হতে সক্ষম হয়েছিল। শুরুতেই স্বাধীনতার তিনটি মৌলিক লক্ষ্যের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছিল। এই তিনটি মৌলিক লক্ষ্য হলো, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা এবং সাম্য। এর সঙ্গে গণতান্ত্রিক অধিকার, সুশাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়গুলোও ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত ছিল।
আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। একইসঙ্গে এ বছর স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। সমৃদ্ধ দেশ গঠনই বঙ্গবন্ধু ও লাখো মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন ছিল। সেই লক্ষ্য এখনো অনেক দূরে। এখন পর্যন্ত এই অঙ্গীকার-প্রতিজ্ঞা অনেকটাই অপূর্ণ রয়ে গেছে, রাজনীতি এখনো পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহাবস্থানমূলক ধারায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উল্টো দোষারোপের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। গণতন্ত্র এখনো সোনার হরিণ। সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ, মানবিক মর্যাদা ও সাম্য প্রায় নিখোঁজ। অর্থনৈতিক মুক্তি সুদূরপরাহত। সবচেয়ে গভীর উদ্বেগের বিষয় এই যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতিকে বিভক্ত করার এক সর্বনাশা তৎপরতা চলছে। জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল বলেই স্বাধীনতা অর্জন সম্ভবপর হয়েছিল। বলা হয়, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা অনেক কঠিন। স্বাধীনতা তখনই সুরক্ষিত থাকে যখন জাতি ইস্পাতকঠিন ঐক্যে দৃঢ়বদ্ধ থাকে। যারা জাতিকে বিভক্ত করতে তৎপর তারা মূলত স্বাধীনতাকে অরক্ষিত করে তুলছে। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও একই সমতলে আনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল বঙ্গবন্ধুর। তিনি জানতেন এবং বিশ্বাস করতেন, স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। আমাদের রাজনীতি, নির্বাচন, শাসন ইত্যাদির যে চিত্র আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি, তা গভীর উদ্বেগজনক। ক্ষমতা যখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় এবং ক্ষমতার জন্য কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা যখন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, তখন জাতির ভবিষ্যত নিয়ে শংকা জাগা স্বাভাবিক। বলা হয়, জনগণই দেশের মালিক, ক্ষমতার উৎস, অথচ বাস্তবতা হলো, জনগণের মালিকানা এখন জনগণের হাতে নেই। তারা আর এখন ক্ষমতার উৎস নয়। দেশে এখন একতরফা ও জোর-জবরদস্তিমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। এহেন গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থায় দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির কাক্সিক্ষত গতি ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব নয়।
আমরা যখন সাড়ম্বরে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি, তখন বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির তান্ডব অব্যাহত থাকায় রাষ্ট্রীয় সব অনুষ্ঠানই সীমিত করা হয়েছে। এর মধ্যেই ১০ দিনের জাতীয় কর্মসূচি অনুসারে স্মারক অনুষ্ঠান হচ্ছে। এমন পেন্ডেমিক অবস্থায়ও দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকজন সরকার ও রাষ্ট্র প্রধান জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সশরীরে হাজির হয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। বিশ্ব নেতাদের অনেকে এ উপলক্ষে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন। একটি দেশের জাতীয় ইতিহাসের নিরিখে খুব দীর্ঘ সময় না হলেও আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বা ৫০ বছর অতিক্রম অনেক বড় তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আমাদের বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধা এবং নতুন প্রজন্ম দেশের স্বাধীনতার প্রত্যাশা, পঞ্চাশ বছরের অর্জন ও ব্যর্থতার খতিয়ান মূল্যায়ন করতে চাইবে। স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে এসে আমরা দেখছি, যে লক্ষ্যসমূহকে সামনে রেখে জাতির জনকের ডাকে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম সে লক্ষ্য অর্জনে এখনো আমাদের বহুদূর যেতে হবে। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সেই স্বপ্ন এখনো অধরা। এ কথা ঠিক যে, গত ৫০ বছরে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। তারপরও স্বাধীনতার জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে আমাদের নিরলস প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। সামাজিক-রাজনৈতিক অনৈক্য, দ্বিধাবিভক্তি, হানাহানি ও দোষারোপের রাজনীতি আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। আমাদের জাতীয় লক্ষ্য অর্জন ও অগ্রগতির জন্য একদিকে যেমন দেশের সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন, অন্যদিকে তেমনি আঞ্চলিক রাজনৈতিক বিরোধের ইস্যুগুলোকেও অগ্রাহ্য করা যায় না। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার বিরোধ-বৈরিতার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার অন্য প্রতিবেশীদের মধ্যেও পড়তে বাধ্য। এবার সে ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সমঝোতা ও সম্প্রীতির একটি প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে। পাকিস্তানের জাতীয় দিবস উপলক্ষে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পাক প্রধানমন্ত্রীর কাছে শুভেচ্ছা পত্র পাঠিয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কাছে শুভেচ্ছা পত্র পাঠিয়েছেন। সার্কভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালায় শরিক হয়ে তাদের আন্তরিক ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এভাবেই একটি আঞ্চলিক ঐক্যের আবহ সৃষ্টি হয়েছে। এ আঞ্চলিক ঐক্য প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন, তেমনি দেশে জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক পুনর্গঠনে তার ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই। জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জাতির জনকের কন্যার কাছে দেশের মানুষ সেই প্রত্যাশাই করছে। অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তেও তিনি অনুরূপ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হোন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।