Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

কোরবানি : ফাযায়িল ও মাসায়িল

প্রকাশের সময় : ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আতিকুর রহমান নগরী

॥ এক ॥
কোরবানি মহান পালনকর্তার তরফ থেকে বান্দার জন্য একটি স্পেশাল নেয়ামত। নবী হযরত ইবরাহিম খলিলুল্লাহ (আ.)’র ত্যাগের মহিমা মাখা উজ্জ্বল নিদর্শন। প্রভুর হুকুম তামিলে প্রিয়পাত্র হিসেবে নিজ পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)’র গলায় ছুরি চালিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে প্রভুপ্রেমের অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করায় পুত্র ইসমাঈল যাবিহুল্লাহ খেতাবে ভুষিত হলেন। তারই ধারাবাহিকতায় মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর দশ জিলহজ তারিখে প্রভুর নৈকট্য লাভের আশায় পশু কোরবানি করে থাকেন।
কোরবানির দিনের ফজিলত : (১) এ দিনের একটি নাম হলো ইয়াওমুল হাজ্জিল আকবর বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন। যে দিনে হাজিগণ তাদের পশু জবেহ করে হজকে পূর্ণ করেন। হাদিসে এসেছে ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) কোরবানির দিন জিজ্ঞেস করলেন এটা কোন দিন? সাহাবিগণ উত্তর দিলেন এটা ইয়াওমুন নাহার বা কোরবানির দিন। রাসূলে কারীম (সা.) বললেন, এটা ইয়াওমুল হাজ্জিল আকবর বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন। (২) কোরবানির দিনটি হলো বছরের শ্রেষ্ঠ দিন। হাদিসে এসেছে আব্দুল্লাহ ইবনে (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলে কারীম (সা.) বলেছেন, আল্লাহর নিকট দিবসসমূহের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন হলো কোরবানির দিন, তারপর পরবর্তী তিন দিন। (৩) কোরবানির দিনটি হলো ঈদুল ফিতরের দিনের চেয়েও মর্যাদাসম্পন্ন। কেননা এ দিনটি বছরের শ্রেষ্ঠ দিন। এ দিনে সালাত ও কোরবানি একত্র হয়। যা ঈদুল ফিতরের সালাত ও সদকাতুল ফিতরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আল্লাহতায়ালা তার রাসূলকে কাওসার দান করেছেন। এর শুকরিয়া আদায়ে তিনি তাকে এ দিনে কোরবানি ও সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।
কোরবানির দিনে করণীয় : ঈদের সালাত আদায় করা, এর জন্য সুগন্ধি ব্যবহার, পরিচ্ছন্নতা অর্জন, সুন্দর পোশাক পরিধান করা। তাকবির পাঠ করা। কোরবানির পশু জবেহ করা ও তার গোশত আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব ও দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা। এসব কাজের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন ও সন্তুষ্টি অন্বেষণের চেষ্টা করা। এ দিনটাকে শুধু খেলাধুলা, বিনোদন ও পাপাচারের দিনে পরিণত করা কোনোভাবেই ঠিক নয়। কোরবানি পশু উৎসর্গ করা হবে এক আল্লাহর এবাদতের উদ্দেশ্যে, যার কোনো শরিক নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন শুধু তার এবাদত করার জন্য। যেমন তিনি বলেন : ‘আমি জিন ও মানুষকে এ জন্য সৃষ্টি করেছি যে তারা শুধু আমার এবাদত করবে।’ আল্লাহতায়ালা তার এবাদতের জন্য মানব জাতিকে সৃষ্টি করলেন। এবাদত বলে যে সকল কথা ও কাজ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন; হোক সে কাজ প্রকাশ্যে বা গোপনে।৫ আর এ এবাদতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তার উদ্দেশ্যে পশু জবেহ করা। এ কাজটি তিনি শুধু তার উদ্দেশ্যে করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, ‘বল, আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তার কোনো শরিক নাই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।’ ইবনে কাসীর (রাহ.) বলেন : এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নির্দেশ দিয়েছেন যে সকল মুশরিক আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে পশু জবেহ করে তাদের যেন জানিয়ে দেয়া হয় আমরা তাদের বিরোধী। সালাত, কোরবানি শুধু তার নামেই হবে যার কোনো শরিক নাই। এ কথাই আল্লাহতায়ালা সূরা কাওসারে বলেছেন, ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কোরবানি কর।’ অর্থাৎ তোমার সালাত ও কোরবানি তারই জন্য আদায় কর। কেননা মুশরিকরা প্রতিমার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে ও পশু জবেহ করে। আর সকল কাজে এখলাস অবলম্বন করতে হবে। এখলাসের আদর্শে অবিচল থাকতে হবে। যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে পশু উৎসর্গ বা জবেহ করবে তার ব্যাপারে কঠোর শাস্তির কথা। হাদিসে এসেছে আবু তোফায়েল থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : আমি আলী ইবনে আবি তালেবের কাছে উপস্থিত ছিলাম। এক ব্যক্তি তার কাছে এসে বলল, ‘নবী কারীম (সা.) গোপনে আপনাকে কী বলেছিলেন?’ বর্ণনাকারী বলেন : আলী (রা.) এ কথা শুনে রেগে গেলেন এবং বললেন : ‘নবী কারীম (সা.) মানুষের কাছে গোপন রেখে আমার কাছে একান্তে কিছু বলেননি। তবে তিনি আমাকে চারটি কথা বলেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর লোকটি বলল : ‘হে আমিরুল মোমিনীন! সে চারটি কথা কি? তিনি বললেন, ১. যে ব্যক্তি তার পিতামাতাকে অভিশাপ দেয় আল্লাহ তাকে অভিশাপ দেন। ২. যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে পশু জবেহ করে আল্লাহ তার ওপর লা’নত করেন। ৩. ওই ব্যক্তির ওপর আল্লাহ লা’নত করেন যে ব্যক্তি কোনো বেদআতীকে প্রশ্রয় দেয়। ৪. যে ব্যক্তি জমির সীমানা পরিবর্তন করে আল্লাহ তাকে লা’নত করেন। এ কাজগুলো এমন, যে ব্যক্তি তা করল সে ইসলামের গ-ি থেকে বের হয়ে কুফরির সীমানায় প্রবেশ করল। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম নবভী (রহ.) বলেন, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে পশু জবেহ করার অর্থ এমন, যেমন কোনো ব্যক্তি প্রতিমার নামে জবেহ করল অথবা কোনো নবীর নামে জবেহ করল বা কাবার নামে জবেহ করল। এ ধরনের যত যবেহ হবে সব না-জায়েজ ও তা খাওয়া হারাম। ইবনে কাসীর (রাহ.) বলেন, যা কিছু আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে জবেহ করা হয় তা যে হারাম এ ব্যাপারে মুসলিমদের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত।
কোরবানির অর্থ ও তার প্রচলন : কোরবানি বলা হয় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন ও তার এবাদতের জন্য পশু জবেহ করা। আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু জবেহ করা তিন প্রকার হতে পারে : ১. হাদী ২. কোরবানি ৩. আকীকাহ। তাই কোরবানি বলা হয় ঈদুল আজহার দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য জবেহ করা। ইসলামী শরিয়তে এটি এবাদত হিসেবে সিদ্ধ, যা কোরআন, হাদিস ও মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্য দ্বারা প্রমাণিত। কোরআন মজিদে যেমন এসেছে ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কোরবানি কর।’ (সুরা কাউসার) ‘বল, আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তার কোনো শরিক নাই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।’ হাদিসে এসেছে, বারা ইবনে আযিব (রা.) থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ঈদের সালাতের পর কোরবানির পশু জবেহ করল তার কোরবানি পরিপূর্ণ হলো ও সে মুসলিমদের আদর্শ সঠিকভাবে পালন করল। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : আল্লাহর রাসূল (সা.) নিজ হাতে দুটি সাদা কালো বর্ণের দুম্বা কোরবানি করেছেন। তিনি বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবর বলেছেন। তিনি পা দিয়ে দুটো কাঁধের পাশ চেপে রাখেন। তবে বোখারিতে ‘সাদা-কালো’ শব্দের পূর্বে ‘শিংওয়ালা’ কথাটি উল্লেখ আছে কোরবানির বিধান
কোরবানির হুকুম : এ বিষয়ে ইমাম ও ফকীহদের মাঝে দুটো মত রয়েছে। প্রথমত : কোরবানি ওয়াজিব। ইমাম আওযায়ী, ইমাম লাইস, ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) প্রমুখের মত এটাই। আর ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ (রহ.) থেকে একটি মত বর্ণিত আছে যে তারাও ওয়াজিব বলেছেন। দ্বিতীয় মত : কোরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। এটা অধিকাংশ উলামাদের মত। এবং ইমাম মালেক ও শাফেয়ী (রাহ.)’র প্রসিদ্ধ মত। কিন্তু এ মতের প্রবক্তারা আবার বলেছেন, সামর্থ্য থাকাবস্থায় কোরবানি পরিত্যাগ করা মাকরূহ। যদি কোনো জনপদের লোকেরা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সম্মিলিতভাবে কোরবানি পরিত্যাগ করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। কেননা, কোরবানি হলো ইসলামের একটি শিয়ার বা মহান নিদর্শন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কোরবানি : ফাযায়িল ও মাসায়িল

১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ