Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিশ্ব নবীর (সা.) মি’রাজ ও বরকতময় পরিবেশ

পীরজাদা মুহাম্মদ এমদাদুল্লাহ্ শাজলী | প্রকাশের সময় : ১২ মার্চ, ২০২১, ১২:০৭ এএম

পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত ও ৪৫ জন বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ছাহাবীর বর্ণনা অনুযায়ী হাদিছ দ্বারা প্রমাণিত নবীকুল শিরোমনির মি’রাজ। প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গ্রন্থ লিখন, কলাম লিখন, বর্ণনা- বিবৃতি কোন কিছু দিয়েই এমন অলৌকিকতার বয়ান বুঝানো বা শেষ করা সম্ভব নহে। তাই ভাবছি অক্ষম হস্তে -নরাধমের কলম দ্বারা কিভাবে ফুটিয়ে তুলব সৃষ্টির দুলালের মি’জারের বৃত্তান্তকে? তবুও ঈমানী জযবা নিয়ে আল্লাহর প্রতি পূর্ণাঙ্গ ভরসা ও মদিনা ওয়ালার নেক নজর কামনা করে শুরু করলাম। বাকী তাঁর দয়ার পথের মুসাফির হয়ে থাকব।

মি’রাজ শব্দের আভিধানিক অর্থ- সিঁড়ি। ইসলামী পরিভাষায় এর অর্থ উচ্চ মর্যাদা, আধ্যাত্যিক পূর্ণতা, উর্দ্ধলোকে গমণ, বিশেষত: আল্লাহর ক্সনকট্য লাভ। রাসুলের মি’রাজকে ইস্রা নামে ও নামকরণ করা হয়েছে। মশহুর গণের মতে, ইস্রা ও মি’রাজ একই বাস্তবতার দুটি ভিনড়ব ভিনড়ব নাম। ইস্রা অর্থ রাত্রিকালীণ ভ্রমণ, ক্সনশ ভ্রমণ, লয়ে যাওয়া ইত্যাদি। যেন স্থান হিসেবে ঐ ভ্রমণের নাম মি’রাজ আর কাল হিসেবে ইস্রা।
মাসজিদুল হারাম হতে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত ইস্রা আর আকসা হতে উর্দ্ধলোক পর্যন্ত ভ্রমণকে মি’রাজ বলেও মন্তব্য পাওয়া যায়। ছাহাবীগণ কখনো ইস্রা শব্দ বলে মি’রাজ বুঝাতেন, আবার কখনো শুধুমাত্র উর্দ্ধলোকে গমণ অর্থেই শব্দটি ব্যবহার করতেন। মি’রাজ বা ইস্রা ঘটনা দুটি রাত্রিকালে সংঘটিত হয়েছিল যে কারণে ইস্রা শব্দটি উভয় ঘটনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মি’রাজ একটি সফর। ঐ সফর ছিল ‘আলমে-মূলক হতে ‘আলমে-মালাকুত ‘আলমে-জাবারুত ও ‘আলমে-লাহুত পর্যন্ত। ‘আলমে মুলক ছিল হাবিবে খোদার (সা:) বাশারী হাকিকতের বিকাশ, ‘আলমে মালাকুতে মালাকী- হাকিকতের বিকাশ, ‘আলমে জাবারুত ও লাহুত ছিল হাক্কী হাকিকতের বিকাশ। ঐ সফর ছিল একজনের ভ্রমণ আর একজনের গ্রহণের সফর। রাসুলে দো’জাহা ছাড়া অন্য কোন নবী-রাসুল, ফেরেস্তা, জীন, মানবসন্তান তথা সৃষ্টিজগত এমন মর্যাদা পূর্ণ সফরের গৌরব অর্জন করতে পারেননি।
মাসজিদুল হারাম হতে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত রাসুলের ভ্রমণ এবং মি’রাজের ঘটনা ২৭ রজব রাতে সংঘটিত হয়েছিল। এরই ধারা বাহিকতায় প্রতি বছর ২৭ রজব মি’রাজের স্মৃতি বার্ষিকী মুসলিম বিশ্বে পালিত হয়ে থাকে।
দয়াল নবীর মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল নবুয়্যতের ১২ সালে। কুরাইশদের তীব্র অত্যাচার, রাসুলের সহধর্মিনী হজরত খাদিজার ইন্তেকাল, চাচা আবু তালেবের মৃত্যু, তায়েফ গমণের হৃদয় বিদারক ঘটনা প্রভৃতি কারণে যখন রাসুল (সা:) সীমাহীন ব্যথিত ছিলেন- তখন পবিত্র মি’রাজের সফরে হাবীবকে ধন্য করেন আল্লাহ তায়ালা।
কুরআন মাজিদের সুরা বাণী ইসরাইলের ১নং আয়াতে সুরা নাজম এর ১-১৮নং আয়াতে এবং সুরা তাকভীর এর ১৯-২৪নং আয়াত সমূহে মি’রাজের ঘটনা উল্লেখ আছে। এর মধ্যে সুরাতুল ইসরার (বাণী- ইসরাইল) সমগ্র অংশেই মি’রাজের বিভিনড়ব অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। প্রথম দিকে রাসুল (সা:) এর মাসজিদুল হারাম হতে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণের বর্ণনা, মধ্য ভাগে উপদেশ ও নসিহত। অত:পর পার্থিব দুঃখ কষ্ট ভোগ করার কারণে মু’মিনগণ যাতে ব্যথিত ও ভারাক্রান্ত হৃদ্বয় না হয়, তদুদ্দেশ্যে পূর্বযুগীয় নবী-রাসুলদের ঘটনাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে।
এতদসহ ইসলামের শত্রু কুরাইশদের শান্তি সমন্ধে সতর্ক করে দেয়া, প্রসঙ্গক্রমে ইঙ্গিতে রাসুল (সা:) কে হিজরতের আদেশ দেয়া, অত:পর মুসলিম উম্মার প্রতি মি’রাজের প্রতিক্রিয়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সবশেষে মু’মিনদের মধ্যে সাহস সঞ্চালনের উদ্দেশ্যে মুসা (আ:) মিশর হতে হিজরতে বাধ্য হওয়ার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। বন্ধুর মি’রাজের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ কুরআন মাজিদের সুরা নাজম এর ১-১৮ ও সুরা তাকভীর এর ১৯-২৪নং আয়াতে মানবাত্মার আধ্যাত্যিক পূর্ণতালাভের সর্বশেষ স্তরের কথা বর্ণনা করেছেন। কতটা কাছে আল্লাহ তাঁর হাবিবকে (সা:) নিয়েছিলেন কুরআনের বর্ণনা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়- “ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুক পরিমাণ অথবা তারচেয়েও অল্প দুরত্ব রহিল” (সুরা নাজম; আয়াত-৯)। বলা প্রয়োজন এ স্তরে পৌঁছা সত্বেও মানবাত্মা মানবাত্মা-ই থেকে যায়, সে আল্লাহ্ হয়ে যায় না। সে নিশ্চই আল্লাহ্তে আত্ম বিলীন হয়ে যায়। আল্লাহ্র মুখ দিয়ে কথা বলেন এবং তার ইচ্ছানুযায়ী প্রতিটি কার্য করে থাকেন।
মি’রাজ বিষয়ক আলোচনায় সালাতের বর্ণনা অত্যন্ত গুরুত্বের অধিকারী। একারণেই হাদিছে সালাতকে মু’মিনের মি’রাজ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র মহিমা, নিজের অক্ষমতা এবং তার প্রতি স্বীয় দাসত্ব প্রকাশের উদ্দেশ্যে বান্দা সিজদায় লুটিয়ে পড়ার পর যখন নিজেকে আল্লাহ্র দরবারে সম্পূর্ণরূপে উপস্থিত অথবা উপস্থিত হওয়ার যোগ্য দেখে তখন সে তার খিদমাতে যাবতীয় তাহিয়্যাত, সম্মান ও সালাম পেশ করেন এবং নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তাঁর পথ প্রদর্শক রাসুল (সা:) ও যখন আল্লাহ্র দরবারে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন, তখন আল্লাহ্ রাসুলকে “হে নবী! আপনার প্রতি সালাম, আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত সমূহ নাজিল হউক।” এ তুহফা দ্বারা সম্মানিত করেছিলেন। আল্লাহ্ পাকের জানড়বাতী অভিবাদন পাওয়ার পর রাসুল (সা:) “আমাদের প্রতি এবং আল্লাহ্র নেককার বান্দাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হউক।” বলে জবাব প্রদান করেছিলেন। মি’রাজের রাতে রাসুল (সা:) হযরত আবু জার গিফারীর ঘরে মতান্তের হযরত উম্মে হানীর ঘরে মতান্তরে- কা’বার হাতীমে নিদ্রাবস্থায় ছিলেন। জিব্রাইল (আ:) তাঁর নিকট আগমন করেন এবং বুরাক মারফত মি’রাজে রওয়ানা হন। হাবিবে খোদা মি’রাজের জন্য উর্দ্ধলোকে গমণের পূর্বে-আম্বিয়া কিয়ামদের রুহ সমূহ বাইতুল মাকদিসে রাসুলকে (সা:) অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। তিনি সেখানে ২ রাকাত সালাত আদায় করেন। সালাতে সবাই রাসুলকে নিজেদের ইমাম মনোনীত করেছিলেন। বাইতুল মাকদিস থেকে উর্দ্ধলোকেগমণ করলে প্রতিটি আসমানে রাসুলগণ সাদর সম্ভাসন জানিয়েছেন রাসুলে খোদাকে (সা:)। প্রথম আসমানে আদম (আ:) দ্বিতীয় আসমানে ইয়াহয়িয়া ও ঈসা (আ:) তৃতীয় আসমানে ইউছুফ চতুর্থ আসমানে ইদ্রিস পঞ্চম আসমানে হারুন ষষ্ঠ আসমানে মুসা এবং সপ্তম আসমানে ইব্রাহিম (আ:) সাদর সম্ভাসন জানিয়েছেন।
রাসুল যখন এক আসমান হতে অন্য আসমানে উঠতেছিলেন জিব্রাইল তাঁর জন্য প্রতিটি আসমানের দরজা খুলে দেওয়াইতেছিলেন। এভাবে উর্দ্ধে আরোহন করতে করতে রাসুল এমন এক স্থানে পৌঁছলেন- যেখান হতে দফতরে কলম চলার আওয়াজ আসতেছিল। ঐস্থানে সালাত ফরজ হয়। সালাতের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- “তোমার পরিবার বর্গকে সালাতের আদেশ দাও এবং তুমি নিজেও উহাতে অবিচল থাক........” (সুরা তা-হা; আয়াত-১৩২)।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিশ্ব নবীর (সা.)
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ