পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দরিদ্র জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক মুক্তি বলতে বোঝে ‘অভাব’ থেকে মুক্তি। পেট ভরে দুই বেলা খেতে পারাটাই তাদের কাছে সুখ হিসেবে বিবেচিত। ফলে তাদের এই মৌলিক চাহিদা মেটানোকে রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা সহজ। দরিদ্র মানুষকে অল্পতেই তুষ্ট করা যায়। গড় আয়, গড় আয়ু এবং ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির জরিপ শুনিয়ে খুশি করা যায়। তাই শ্রদ্ধা-ভালবাসায় ক্ষমতাবানকে খুশি করে দেয় তারা। এসব দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিজেরা নেতৃত্ব চায় না। এমপি-মন্ত্রী হওয়ার কথা ভাবে না। এমপি-মন্ত্রীসহ ক্ষমতাবানরা তাদের মৌলিক চাহিদাটুকু পূরণ করতে পারলেই তারা খুশি।
বর্তমানে আমাদের দেশে দারিদ্র্য ও দরিদ্র কমছে বলে খবর ও তথ্যের শেষ নেই। বলা হচ্ছে, দারিদ্র্য কমছে, দরিদ্রও কমছে। গরিব খুঁজে পাওয়া যায় না- এমন কথাও শোনানো হয়। এ সংক্রান্ত জরিপ-গবেষণাও প্রচুর। সর্বশেষ এক জরিপে বলা হয়েছে, এক দশকে দেশে অন্তত ১০ হাজার কোটিপতি হয়েছে। আরেক জরিপ বলছে, এই ১০ হাজারের মধ্যে হাজার খানেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকসহ নানা জায়গায় এন্তার অভিযোগ রয়েছে। তাদের উত্তরসুরীও অনেক। স্বার্থ ও শ্রেণি বিবেচনায় তারা সবসময় দলে-বলে শক্তিমান। বলার অপেক্ষা রাখে না, স্বাধীনতার ৫০ বছরে মুক্তির যাবতীয় সুখ-সম্ভোগ লুটে নিয়েছে এই শ্রেণীটি। দেশের রাজনীতি চলে গেছে পুরোপুরি তাদের দখলে। সংসদেও তাদের আধিপত্য।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ যতটা এগিয়ে যাওয়ার কথা রাজনীতিতে সংঘাত, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধপরায়নতা এবং রাজনীতিবিদদের অন্যৈক্যের কারণে ততটা এগিয়েছে কিনা, তা নিয়েও রয়েছে নানা মত। আর কেনই বা জনকল্যাণমুখী না হয়ে রাজনীতি ঘুরপাক খেয়েছে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর আলোচনা। তথ্য-জরিপ যাই থাকুক, বৈধ-অবৈধ নিয়ে যত কথাই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত এর কুফলের শিকার হতে হয় দরিদ্র সাধারণ জনগণকে। কারণ, শত শত মানুষ মেরে রানা প্লাজার মালিক এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে। হলমার্কের তানভীররাও ভালো আছেন। শাহেদ, শামীম, সাবরিনা, পাপিয়ারাসহ অন্যান্যরাও জেলে আরামে-আয়েশে আছে। ঋণখেলাপিরা রাষ্ট্রের অর্থ লুটে দিব্যি ঘোরা-ফেরা করছে। আবার এর বিপরীতে কোনো ব্যাংক বা এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে হতদরিদ্রদের আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে দেখা যায়। ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় অনেকের ঘরের টিনের চাল খুলে নেওয়া, ঘরের বাছুর নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। শহুরে কোন মধবিত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি তুলে বা ফ্ল্যাট কিনে ঋণের টাকা শোধ করতে না পারলে তাকেও নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। কিস্তির পর কিস্তি দিয়েও মূল টাকার পরিমাণ কমে না। অনাদায়ী ঋণের দায়ে বাড়ি-ঘর নিলাম হতেও দেরি হয় না। কিন্তু, বড় বড় ঋণ খেলাপিদের কারও গাড়ি, বাড়ি ব্যাংক জব্দ করার খবর শোনা যায় না। মোটকথা, সাধারণ মানুষকেই যত নিয়ম-কানুনের বেড়াজালে আটকা পড়তে হয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের পুনর্গঠন বলতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভের পরে দক্ষিণ এশিয়ার নবগঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশের ধসে পড়া অর্থনীতি, রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, প্রতিরক্ষাসহ দেশ পরিচালনার সক দিক কী করে পুনর্নিমাণ করা হয়, সেই প্রক্রিয়াটিকে বোঝানো হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভের পরে বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুবই নাজুক ছিল। ১৯৭০-এর বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কা (যাতে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়) কাটিয়ে না উঠতেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ওই আড়াই লাখ মানুষও দরিদ্র। যুদ্ধে হতাহত লাখ-লাখ মানুষের বেশিরভাগও গরিব ঘরের সন্তান। এই গরিব শ্রেণীটকে রাজনীতির মারপ্যাঁচে ফেলে স্বার্থ হাছিল করা সবসময়ই সহজ। তারা বুঝে-না বুঝে রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে। সময়ভেদে কেউ কেউ তাদের প্রিয় দল ছেড়ে অন্য দলকে সমর্থন করে। নির্বাচনের মাঠ গরম রাখতে রাজনৈতিক দলগুলো এদের ব্যবহার করে। দুই-চারশ’ টাকার বিনিময়ে মিছিল করা থেকে শুরু করে ভাংচুরের কাজে যুক্ত করা হয়। রাজনৈতিক দল ও নেতারা দারিদ্র্যের এ সুযোগটা কাজে লাগান। তাদের কাছে এটা অন্যায় মনে হয় না।
রাজনীতি এখন ব্যবসার সম্প্রসারণের অংশ আর টাকা দিয়ে নির্বাচনে জেতার পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলগুলোর ভেতরে অর্থ ও পেশিশক্তি প্রবেশ করছে। ফলে রাজনীতি পরিণত হয়েছে ধনীদের খেলা। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক শৃঙ্খলাকে ক্ষয় করছে। অর্থ ও পেশিশক্তির কুশীলবরা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দখলের সুযোগ পাওয়ায় দলগুলোতে দুর্বৃত্তায়ণ সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনীতিতে এ যেন নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সুশাসনের ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে। ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন লুটপাটের মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকে জনগণের টাকা গচ্ছিত থাকে। সে অর্থ লুট হয়ে যাচ্ছে তথাকথিত ঋণের আবরণে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন শুধু সুশাসনের ব্যত্যয় নয়, দেশের অর্থনীতিকেও বিপজ্জনক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন রাজনীতিকরা গৌরবের সঙ্গে পেশা হিসেবে রাজনীতিকে পরিচয় দিতেন। এখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। একসময়ের অনেক পেশাদার রাজনীতিকও এখন সরাসরি বিভিন্নভাবে ব্যবসার সাথে জড়িত। নামে-বেনামে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তারা ব্যবসায় সম্পৃক্ত ছিলেন-আছেন। মাঠ থেকে শুররু করে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একই অবস্থা। এমনকি ডান-বামসহ সব ধরনের নেতাই এখন ঝুঁকছেন ব্যবসার দিকে। দলে দলে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলে যোগ দিচ্ছেন ব্যবসার কারণেই। ছাত্র-যুব সব পর্যায়ের রাজনীতিতেই এখন একই চিত্র। আবার এমপি হওয়ার পরই পাল্টে গেছে কারও কারও পেশা। আগে ব্যবসা না করলেও এমপি হওয়ার পর জড়িয়েছেন ব্যবসার সঙ্গে। নামে-বেনামে গড়ে তোলেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কোথাও তাদের তেমন বাধায় পড়তে হয় না। থামতেও হয় না। মাঝে মাঝে শুধু ছন্দ পতন হয় মাত্র। আবার ঘটনাচক্রে থমকে যেতে হয় অনেককে। গ্রেফতার হয়ে কয়েকজন এখন কারাগারে। এসব অপকর্মের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোন কোন সদস্যসহ অনেক রাঘববোয়াল জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এসব ঘটনার কোথাও কিন্তু দরিদ্রদের সম্পৃক্ততা নেই। আবার শোভন-রাব্বানী-খালেদ-ফিরোজ-লোকমানরাই শেষ বা শুরু নয়। এরা উপসর্গমাত্র। এর শিকড় বহু গভীরে। রাজনীতি তাদের চেয়েছে। কোনো গরিবকে চায়নি। চায়ও না। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি গরিবদের সঙ্গী করে না। দুষ্টু ও খলনায়ক খোঁজে। তৈরি করে। লালনপালন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ভয়ঙ্কর করে তোলে। এই শ্রেণীও রাজনীতিতে জড়ায় নগদ প্রাপ্তির আকর্ষণে। রাজনীতিতে ভিড়লে নানা ধরনের অন্যায় সুযোগ-সুবিধা হাছিলের সত্যতা এখন ওপেন সিক্রেট। কোনো গোপন ব্যাপার নয়। তাদের কাছে লজ্জার নয়, বরং গৌরবের। সব দলেই এমন প্রবণতা রয়েছে। তবে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া দলগুলোতে তা বেশি। কেবল রাজনীতিকে দূষলে কিছুটা একতরফা হয়ে যায়। দুর্বৃত্তায়ন চলছে জাতীয় জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে। যে যত বড় মাপের দুর্বৃত্ত, সে তত বড় ক্ষমতাবান। সমাজে সে তত উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত, তত বেশি সম্মানের। তারা স্তাবক, অস্ত্রধারী, বন্দুকধারী, লাঠিয়াল বাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত। দেশের নদ-নদী, পাহাড়-বন, কবরস্থান সবদিকেই তাদের নজর। সর্বত্রই তাদের দখলদারিত্ব। কোথায় তাদের ক্ষমতা ও অর্থের উৎস, তা কারো অজানা নয়।
বৈদেশিক ব্যাংকে এই দেশ থেকে পাচার হওয়া বিশাল অঙ্কের টাকা দিনে দিনে বাড়ছে। দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে লাখ-লাখ কোটি টাকা। দুর্নীতিবাজরা সেকেন্ড হোম গড়ছে কানাডা, মালয়েশিয়া, দুবাই, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মরিশাস, সাইপ্রাসে। শেয়ারবাজার লুট, ডেসটিনি, হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংকে দুর্নীতির একেকটি উপাখ্যান মাত্র। এরকম আরো ঘটনা যে নেই বা বৃদ্ধি পায়নি, তা হলফ করে বলা যায় না। এসব ঘটনা দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি ও অপরাজনীতির সমার্থক হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দরিদ্রের সক্ষমতা কতটুকু বেড়েছে? ধনী-গরিবের ব্যবধান কতটুকু কমেছে? এসব প্রশ্ন এখন গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিৎ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।