চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মুফতী পিয়ার মাহমুদ
॥ এক ॥
আর হামুর রাহিমীন আল্লাহ তাআলা স্বীয় অনুগ্রহে মুমিন বান্দাকে এমন কিছু ইবাদত দান করেছেন যা দ্বারা সে আত্মার প্রশান্তি ও দুনিায়া আখেরাতের সীমাহীন বরকত ও কল্যাণ লাভ করে থাকে। এ জাতীয় ইবাদতেরই একটি হলো হজ। হজের ফযীলত বর্ণনায় সাহাবী আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি- ‘যে ব্যক্তি অশ্লীলতা ও কটূক্তি থেকে বিরত থেকে হজ কার্য সম্পন্ন করে সে সদ্যপ্রসূত সন্তের ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে।’ (বুখারী:১৫২১) সাহাবী আবু হুরায়রার রা. অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করা হলো, কোন আমলটি সর্বোৎকৃষ্ট? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনা। আবার প্রশ্ন করা হলো, এরপর কোন আমলটি সর্বোৎকৃষ্ট? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। আবার প্রশ্ন করা হলো, এরপর কোন আমলটি সর্বোৎকৃষ্ট? তিনি বললেন, হজে মাবরুর (যে হজ আল্লাহর দরবারে কবূল হয়েছে)।’ (বুখারী:১৫১৯) আম¥াজান আয়শা রা. বলেন, ‘আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল! জিহাদ অতি উৎকৃষ্ট মানের একটি আমল। অতএব আমরা কি জিহাদ করব না? তিনি বলেলন, না, তোমরা জিহাদ করবে না। তবে তোমাদের উৎকৃষ্ট জিহাদ হলো, হজে মাবরুর।’ (বুখারী:১৫২০) অন্য এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তিন ব্যক্তির দায়িত্ব ভার আল্লাহ তাআলা গ্রহণ করেছে। ১. যে ব্যক্তি কোন মসজিদের দিকে বের হয়। ২. যে ব্যক্তি আল্লাহ পথে জিহাদে বের হয়। ৩. যে ব্যক্তি হজের উদ্দেশে বের হয়। (হিলয়াতুল আওলিয়া:৯/২৬২) এছাড়াও বহু হাদীসে হজের বিভিন্ন ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সঠিক মাসআলা জানা না থাকার কারণে সম্মানিত হাজী সাহেবান হজের ফযীলত থেকে মাহরুম হয়ে থকেন এবং অনেক সময় অজান্তেই তা ফসিদ হয়ে যায়। মাসআলা জানা না থাকর ফলে পরবর্তীতে তা আর কাযাও করা হয় না। তাই আমরা বক্ষমান প্রবন্ধে হাজীগণ হজ আদায় করতে গিয়ে সাধারণত যে সব ভুলভ্রন্তি করে থাকেন, সেসব ভ্রান্তি ও সমাধান নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
হজ ফরজ হওয়ার আলোচনা: ১. অনেকে মনে করে থাকেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত নগদ ক্যাশ না থাকলে হজ ফরজ হয় না। ফলে হজ করা থেকে বিরত থাকেন। অথচ নগদ ক্যাশ ছাড়াও তার এ পরিমাণ সম্পদ রয়েছে যার উপর হজ ফরজ হয়। এমনকি অনেকে এই ভ্রান্তিতে থেকেই মৃত্যু বরণ করেন। তাই এ ব্যাপারে সঠিক মাসআলা জেনে আমল করা উচিত। এ ক্ষেত্রে সহীহ মাসআলা হলো, কারো নিকট নগদ ক্যাশ নেই বটে, তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি, ঘর, প্লট, ফ্ল্যাট, আসবাবপত্র, ব্যবসার সামগ্রী ইত্যাদি রয়েছে এবং তা বিক্রি করলে হজের খরচ ও হজ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবার-পরিজনের যাবতীয় খরচের ব্যবস্থা হয়ে যায়, তাহলে তার উপর হজ ফরজ। (রদ্দুল মুহতার: ৩/৪৬০-৪৬১; হিন্দিয়া:১/২১৭-২১৮; মুআল্লিমুল হুজ্জাজ: ৮১; আহসানুল ফাতওয়া: ৪/৫৪২) ২. অনেক বিত্তশীল মানুষকে দেখা যায় যে, তারা হজ বিলম্বে করে থাকেন। এবং বলেন যে, চুল-দাড়ী পাকেনি; চুল-দাড়ী সাদা হলে হজ করব। অনেকে আবার ¯্রফে অলসতা করে বিলম্ব করে থাকেন। অথচ এরূপ করা সম্পূর্ণ নিষেধ। যে বৎসর হজ ফরজ হবে সে বৎসরই হজ করা ওয়াজিব। শরয়ী ওযর ব্যতীত বিলম্ব করা জায়িয নেই। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত। (রদ্দুল মুহতার:৩/৪৫৪-৪৫৫; হিন্দিয়া:১/২১৬; হিদায়া:১/২৩২;আহসানুল ফাতওয়া ৪/৫৩৮) ৩. অনেকে ধারণা করে, শেষ বয়সে হজ করব। এ ধারণা মারাত্ম ভুল ও অজ্ঞতার পরিচায়ক। কারণ হজের ক্রিয়াদী কষ্টসাদ্য। বৃদ্ধ বয়সে সঠিকভাবে তা আদায় করা সম্ভবপর হয়ে উঠে না। তাই যৌবনকালেই হজ করা উচিত, যেন হজের ক্রিয়াদী সহজে সঠিকভাবে আদায় করা সম্ভব হয়।
ইহরামের আলোচনা: ৪. অনেক হাজী সাহেব ইহরাম বাঁধার আগের দই রাকআত নামাযকে জরুরি মনে করে থাকেন। তাই এই দুই রাকআত নামাযের সুযোগ না পওয়ার কারণে ইহরাম বিলম্বিত করতে থাকেন। এমনকি এ নামায পড়তে না পারার কারণে অনেকে মীকাতের ভিতর পর্যন্ত চলে যায়। এটা ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে সহীহ মাসআলা হলো, ইহরামের আগে দুই রাকআত নামায পড়া মুস্তাহাব; জরুরি কিছু নয়। পক্ষান্তরে ইহরাম ছাড়া মীকাত অতিক্রম নাজায়িয। তাই ইহরামের আগে এ নামযের সুযোগ পেলে আদায় করবে। সুযোগ না পেলে এ কারণে ইহরাম বাঁধতে কোন প্রকার বিলম্ব করবে না। (মুসলিম:১/৩৭৬; মানাসিক: ৯৯; গুনয়াতুন নাসিক: ৭৩, হিদায়া: ১/২৩৬-২৩৭) ৫. অনেকে মনে করেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি উরীদুল হাজ্জা ফা ইয়াসসিরহু লী ওয়া তাকাব্বাল মিন্নী’। এই দুআটি পড়লেই ইহরাম বাঁধা পূর্ণ হয়ে যায়। এ ধারণা ভুল। কারণ কেবল এ দুআ পড়লেই ইহরাম পূর্ণ হয় না; এটি কেবল নিয়তের বহি:প্রকাশ। বরং নিয়তের পর তালবিয়াও পড়তে হবে। তাহলেই ইহরাম পূর্ণ হবে। (তিরমিযী:১/১০২; হিদায়া:১/২৩৬-২৩৭) ৬. অনেকেই মনে করেন যে, ইহরাম বাঁধলেই ইহরামের যাবতীয় হুকুম-আহকাম আরোপিত হয়ে যাবে। এই ভয়ে জিদ্দায় ইহরাম বাঁধার ইচ্ছায় ইহরামকে জিদ্দা পর্যন্ত বিলম্বিত করে থাকেন। অথচ সহীহ মাসআলা হলো, মীকাতের বাইরের হাজীদের ইহরাম ব্যতীত মীকাত অতিক্রম করা জায়িয নেই। উপমহাদেশের হাজীগণের মীকাত হলো কারনুল মানাযিল ও যাতুল ইরক। যা অতিক্রম করেই বিমান জেদ্দায় অবতরণ করে। তাই বিমানে উঠার আগ মুহূর্তে কিংবা বিমানে উঠে মীকাত অতিক্রমের আগেই ইহরামের নিয়ত করে তালবিয়া পড়ে ইহরাম সম্পন্ন করে নেয়া উচিত। আর যদি ঢাকা থেকে সরাসরি মদীনা মুনাওয়ারা যাওয়া হয়, তাহলে মদীনা থেকে মক্কা যওয়ার সময় কিংবা মদীনাবাসীর মীকাত যুল হুলাইফা (যা বর্তমানে বীরে আলী নামে পরিচিত) থেকে ইহরাম বেঁধে নিবে। যদি কেউ ইহরাম ব্যতীত মীকাত অতিক্রম করে, তাহলে পুনরায় মীকাতে ফিরে এসে ইহরাম বাঁধা জরুরি। যদি না করে তবে দম ওয়াজিব হবে। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা চাই। (হিদায়া:২/২৩৪; গুনয়াতুন নাসিক:৫০; আহকমে হজ:৪১) ৭. অনেক হাজী সাহেবকে দেখা যায় যে, ইহরামের কাপড় না পড়েই বিমানে উঠে যায়। পরে যখন বিমানে থাকা অবস্থায় পরিধানের কাপড় পাল্টিয়ে ইহরমের কাপড় পরিধান কষ্টকর হয় অথবা কাপড় লাগেজে থেকে যায়, তখন তারা সেলাইবিহীন কাপড় না পাওয়ার কারণে ইহরাম বাঁধতে বিলম্ব করেন। এমনকি এক পর্যায়ে ইহরাম ছাড়াই মীকাত অতিক্রম করে ফেলেন। ফলে দম ওয়াজিব হয়। এক্ষেত্রে উচিত ছিল সেলাই করা কাপড় পরিহিত অবস্থায়ই ইহরামের নিয়ত করে তালবিয়া পড়ে ইহরাম সম্পন্ন করে নেয়া এবং বিমান থেকে নেমেই ইহরামের কাপড় পড়ে নেয়া। তাহলে তার অপরাধটা দম ওয়াজিব হওয়ার মতো বড় হত না; বরং তখন একটি পূর্ণ সদকায়ে ফিতর আদায় করে দিলেই চলত। কারণ ইহরাম অবস্থায় সেলাইযক্ত কাপড় পরিধান করে ১২ ঘন্টা বা এর বেশি থাকলে দম ওয়াজিব হয়। এর কম অন্তত ১ ঘণ্টা থাকলে একটি পূর্ণ সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয়। আর এক ঘণ্টার কম থাকলে সামান্য কিছু দিলেই চলবে। (তিরমিযী:১/১৭১; মানাসিক, মুল্লা আলী কারী: ৩০০-৩০১; রদ্দুল মুহতার:৩/৫৭৭) ৮. অনেক হাজী সাহেবকে দেখা যায় যে,ইহরামের কাপড়টি ইহরাম থেকে হালাল হওয়ার আগ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না। তাদের ধারণা এমনটি করা যাবে না। মূলত এটি একটি ভুল ধারণা। সঠিক মাসআলা হলো, ইহরামের কাপড় নাপাক না হলেও পরিবর্তন করা যাবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: হাদীস:১৫০১০-১৫০১১; মানাসিক:৯৮) ৯. অনেক তামাত্তু হজকারী হজ ও উমরার ইহরাম এক সাথে বেঁধে থাকেন এরূপ করা ঠিক নয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।