Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সিলেট ওসমানী এয়ারপোর্ট দিয়ে লন্ডনে পাচার করা হয়েছিল এক তরুনীকে!

সিলেট ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৬:৫৩ পিএম

বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে সিলেটের এক তরুণীকে (২২) যুক্তরাজ্যে পাচারের চেষ্টা করেছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক জাইন দীন (৪৫)। ভুক্তভোগী তরুণীকে পাচারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে রুবিনা নামের এক ব্রিটিশ পাসপোর্ট। ইমিগ্রেশন পুলিশের কয়েকজন অসাধু সদস্যের সহযোগিতায় ভুয়া পাসপোর্টে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পার করতে পারলেও ধরা পড়েন লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে নেমে ওই তরুণী। পাসপোর্ট আটক রেখে বিমানবন্দর থেকেই দেশে ফেরত পাঠায় লন্ডন পুলিশ তাকে।

পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি দেশে ফেরত আসেন ঘটনার শিকার তরুণী। এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি সিলেট বিমানবন্দর থানায় জাইন দীন, মোকারম ও আশরাফ নামে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানবপাচারের আইনে মামলা করেন তিনি। সেই মামলার তদন্তে নেমে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তথ্য পেয়েছে আরও চাঞ্চল্যকর।

সিআইডির সূত্র মতে, ২০১৮ সালের শেষের দিকে লন্ডনি যুবক মোকাররম আলীর সঙ্গে প্রেম হয় সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকায় বসবাসকারী এই তরুণীর। মেয়েটির সঙ্গে মোকাররমের পরিচয় আত্মীয় আশরাফ ওরফে বেনু সূত্রে। মোকাররমের দেশের বাড়িও সিলেটে। তার বাবা লাল দীঘির পাড় হকার্স মার্কেটে কাপড়ের ব্যবসায়ী। তরুণী সিলেটের একটি সরকারি ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী। প্রেমের এক পর্যায়ে মোকাররম তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তারপর কিছুদিনের মধ্যে মেয়ের পারিবারিক পর্যায়ে গড়ায়। মেয়েটির মা-বাবা সিদ্ধান্ত নেন, পরের বছর (২০১৯) ১৪ই ফেব্রুয়ারি মোকাররমের কাছে লন্ডনে যাবে তাদের মেয়ে। সেখানেই বিয়ের পর তারা সংসার করবেন। কিন্তু মোকাররম ছুটি না পাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক জাইন দীনের সঙ্গে লন্ডন যেতে বলেন তরুণীকে। পাসপোর্ট ও ভিসা সহ সব ব্যবস্থা করবেন জাইন দীন বলে মেয়েটিকে জানায় মোকাররম।

সিআইডি জানায়, ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া জাইন দীনের বাড়িও সিলেটে। তবে তিনি বা তার কেউই দেশে থাকেন না। এর আগে তিনি তিন-চার বার দেশে এসেছিলেন তিনি। সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, একই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ থেকে নারীপাচারের অভিজ্ঞতা তার আগেও ছিল। এই তরুণীকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার জন্য ২০১৯ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে আসেন জাইন দীন। তার পাসপোর্ট নম্বর ৫২১৫৬১৭০৫। পরে একই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভুক্তভোগী তরুণীকে নিয়ে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হন জাইন দীন। যাত্রার আগে তরুণীর হাতে ধরিয়ে দেন অন্য এক নারীর ব্রিটিশ পাসপোর্ট। ২০১৯ সালে ২৩ ফেররুয়ারি দায়ের করা মামলার এজাহারে বাদী ওই তরুণী অভিযোগ করেন, তার কাছে থেকে মোকাররম পাসপোর্ট ও ভিসার জন্য শুধু ছবি নিয়েছিলেন। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি রুবিনা খাতুন নামে তার নিজের ছবি সম্বলিত একটি ব্রিটিশ পাসপোর্ট তাকে ধরিয়ে দেন জাইন দীন। সেই পাসপোর্টেই ১৪ ফেব্রুয়াারি বিকাল ৫টায় বিজি ৪০৬ বিমান যোগে সিলেট থেকে লন্ডন যান তারা। সিআইডি সূত্র জানায়, বিমানবন্দরের সিসিটিভি ক্যামেরাতেও জাইন দীনের সঙ্গে বিমানবন্দর পার হতে দেখা গেছে এই নারীকে। সিআইডি আরও জানায়, ২০১৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জাইন দীনের সঙ্গে রুবিনা নামে কোনও নারী আসেনি দেশে। তবে ব্রিটিশ ওই পাসপোর্টটি ইমিগ্রেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় এন্ট্রি করিয়ে নেন জাইন। পরবর্তীতে দেশে এন্ট্রি করা এই পাসপোর্ট নিয়ে ওই ভুক্তভোগী তরুণী সহ বাংলাদেশ ত্যাগ করেন তিনি।

সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, ব্রিটিশ নারীর পাসপোর্ট দেশে এন্ট্রি করানো এবং তার ৬ দিন পর ওই ভুয়া পাসপোর্টের আড়ালে ভুক্তভোগী তরুণীকে বিদেশে পাঠানোর পেছনে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের একাধিক কর্মকর্তা জড়িত থাকতে পারেন। কারণ, এ কাজ সম্ভব নয় ইমিগ্রেশনের সহায়তা ছাড়া। এ কাজে মোটা অঙ্কের টাকাও লেনদেন হয়েছে বলে ধারণা সিআইডির। সেকারনের মালিক ছাড়াই ই-পাসপোর্টটি দেখানো হয়েছে এন্ট্রি। পরে ভিকটিম তরুণীকে নিয়ে যাওয়ার দিন পাসপোর্টধারী ব্যক্তির নাম-পরিচয় যাচাই না করেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নারীপাচারের এ কাজে বিমানবন্দরে কর্মকর্তারা ডিউটিতে ছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে মনে করছে সিআইডি।

সিলেট বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন পুলিশের ওসি সাইফুল ইসলাম জানান, এই বিষয়ে কোন তথ্য নেই তার কাছে। ওই সময়ে নিজে ডিউটে ছিলেন না তিনি।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ভুক্তভোগী তরুণীর বরাত দিয়ে জানিয়েছে, এই তরুণী যখন লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছায়, সেখানকার ইমিগ্রেশন পার হতে গিয়ে ধরা পড়েন। তারপর ব্রিটিশ পাসপোর্টটি রেখে তরুণীকে দেশে ফেরত পাঠায় লন্ডন ইমিগ্রেশন পুলিশ। কিন্তু ঘটনার পরও সটকে পড়েন জাইন দীন।

২ লাখ ৬২ হাজার টাকা বিমান ভাড়া দিয়ে স্বজনরা তাকে বাড়ি নিয়ে আসেন। সিআইডি তদন্তে নেমে প্রথমেই ইন্টারপোলের মাধ্যমে লন্ডন পুলিশের কাছে জাইন দীন ও মোকাররম সম্পর্কে তথ্য জানতে চায়। দীর্ঘদিন পর লন্ডন পুলিশ জাইন দীনের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে সিআইডিকে মেইল করে। জাইন দীন এ ঘটনার সঙ্গে কীভাবে জড়িত সিআইডির কাছে তা জানতে চেয়েছে লন্ডন পুলিশ।
এই মামলার তদারকি কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা লন্ডন পুলিশের কাছে থেকে চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়াারি একটা মেইল পেয়েছি। ফিরতি মেইলে জাইন দীনের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলতে চেয়েছি। তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে এ ঘটনার আরও বিস্তারিত তথ্য যাবে জানা।

অভিনব পদ্ধতিতে নারীপাচারের বিষয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল ইসলাম বলেন, বিষয়গুলো যাদের নজরদারি করার কথা, সেই জায়গায় সিস্টেমের বদলে মানুষটাই যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যায়, তাহলে বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। এসব ঘটনায় ইমিগ্রেশন পুলিশ যদি যুক্ত থাকে, তাদের জন্য শাস্তিটা আরও বেশি হওয়া উচিত। কেননা, যারা দায়িত্বে আছেন, তারা যদি এগুলো ঘটান, তাহলে কীভাবে হবে।’ তিনি বলেন,‘সিলেটে থেকে যেহেতু লন্ডনে সরাসরি ফ্লাইট যায়, সে কারণে সিলেটে এমন ঘটনাও বেশি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সিলেট


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ