Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কক্সবাজারে পরিবেশ ও পর্যটন শিল্প ধ্বংসে আশঙ্কা

পাহাড় দখলের মহোৎসব

জাকের উল্লাহ চকোরী, কক্সবাজার থেকে : | প্রকাশের সময় : ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

 কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ও সৈকত সংলগ্ন পাহাড় জুড়ে চলছে দখলের মহোৎসব। ইতোমধ্যে শহরতলীর দরিয়ানগর সৈকতে সাগরলতার বন সমৃদ্ধ বালিয়াড়ি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে একের পর এক স্থাপনা। সৈকত সংলগ্ন বানরের পাহাড় অভয়ারণ্যও ঘেরাবেড়া দিয়ে দখল করে নেয়া হচ্ছে। উখিয়ার সোনারপাড়ায় রেজু নদী সংলগ্ন প্যারাবন ধ্বংস করে সেখানেও চলছে দখলবাজদের থাবা।
কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন সমুদ্র সৈকত ও পাহাড় জুড়ে দখলবাজি প্রশাসনের অগোচরেই চলছে বলে জানান কক্সবাজারের নবাগত জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ। এ ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানান তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জেলা শাখার সভাপতি সাংবাদিক ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, গত কয়েক মাস ধরে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন সমুদ্র সৈকতে দখলের মহোৎসব শুরু হয়। এ বিষয়ে আমরা অনেক প্রতিবাদ-সংগ্রাম চালিয়ে এলেও সংশ্লিষ্টরা কোন কর্ণগোচর করছেন না। ফলে গত কয়েকদিনে দখলের মহোৎসব নতুন করে জোরদার হয়েছে। এখন সমুদ্র সৈকতের পাশাপাশি সৈকত সংলগ্ন পাহাড় ও নদী তীরবর্তী প্যারাবন ধ্বংস করে সেখানেও স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের দরিয়ানগর নামক স্থানে শেষ হয়েছে কক্সবাজার শহর। দরিয়ানগরে বনবিভাগের পিকনিক স্পটের ওপারের রাস্তায় চোখে পড়ে সাগরলতাসহ সৈকতের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস না করতে জেলা প্রশাসনের সতর্কতা সংক্রান্ত বিশাল বিলবোর্ড। আর এ বিলবোর্ডের পাশের রাস্তা ধরে সৈকতে গিয়ে দেখা যায় সাগরলতা ধ্বংস করে বালিয়াড়ির উপর গড়ে তোলা হচ্ছে স্থাপনা।
স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন দরিয়ানগর গ্রীণ ভয়েস সভাপতি পারভেজ মোশাররফ বলেন, গত বছর এপ্রিলে দরিয়ানগর থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত সৈকতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ঘোষণা দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। এরই অংশ হিসাবে দরিয়ানগর সৈকতে কয়েক হাজার বর্গমিটার জুড়ে সাগরলতা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল। আর তা তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল স্থানীয় গ্রামবাসীকে। আমরা বিনা বেতনে গত ১০ মাস ধরে তা রক্ষণাবেক্ষণ করেছি। কিন্তু সেই জেলা প্রশাসনের অনুমোদনেই এখন সাগরলতাসহ সৈকতের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, গত বৃহস্পতিবার থেকে সৈকত সংলগ্ন বানরের পাহাড় অভয়ারণ্যেও শুরু হয়েছে দখল প্রক্রিয়া।
কক্সবাজার শহর থেকে মেরিন ড্রাইভ ধরে প্রায় ১৬ কি.মি পথ গেলেই রামু ও উখিয়া সীমান্ত বিচ্ছিন্নকারী রেজু নদী। এই নদীর দুপারেই রয়েছে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের বাগান। আর গত কয়েকদিন ধরে রেজু ব্রিজের দক্ষিণ পাড়ে উখিয়া অংশে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের বন ধ্বংস করে স্থাপনা গড়ছে একটি পর্যটন কোম্পানি।
স্থানীয় গ্রামবাসী খায়রুল আমিন ও নুরুল কাদের জানান, গত এক যুগেরও বেশি আগে ব্রিজ সংলগ্ন ডা. ফজলে আকবর চৌধুরী গং এর মাথাখিলা খাস জমিতে কোন স্থাপনা না করে তিনি একটি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের বাগান ও তার মাঝখানে স্থানীয় জেলেদের।
পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়থ এনভায়রণমেন্ট ফোরাম (ইয়েস) সভাপতি ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, এখন কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকত ও সৈকত সংলগ্ন পাহাড়ে চলছে দখলবাজদের রাজত্ব। এদের থাবা থামানো না গেলে কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে। আর কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে গেলে পর্যটন শিল্পও ধ্বংস হয়ে যাবে।
বাপা জেলা সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, স¤প্রতি উখিয়ার ইনানী সৈকতকে দ্বি-খন্ডিত করে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। আর শহরের ডায়াবেটিক পয়েন্টে ঝাউবাগান দখল করে ধ্বংস করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এ মহোৎসব অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিৎ।
কক্সবাজার চেম্বার সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, সৈকত সংলগ্ন প্রকৃতির উপর দুর্বৃত্তপনার খবর উদ্বেগজনক। এই দুর্বৃত্তপনা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিৎ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও বনবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মো. কামাল হোসেন বলেন, সৈকতের বালিয়াড়ি তৈরির কারিগর সাগরলতা সাগরপাড়ের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা বায়োশিল্ডের অংশ। আর এই বায়োশিল্ড ধ্বংস হয়ে গেলে সৈকত ক্ষয়ের শিকার হবে।
বাংলাদেশ ফিশারিজ রিচার্স ইন্সটিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, দরিয়ানগর একটি জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চল। এখানকার বড়ছড়া খালের মোহনা সৈকতের প্রধান ‘বায়ো টার্বেটর’ লাল কাঁকড়া ও ‘ইকোসিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ার’ শামুক-ঝিনুকের প্রজনন স্থল। শামুক-ঝিনুক সৈকতের বায়োশিল্ডের একটি অংশ। এছাড়া একুরিয়াম ফিশ থেরাপন জার্বুয়াসহ অসংখ্য সামুদ্রিক মাছের প্রজননক্ষেত্র এই বড়ছড়া খালের মোহনা। এখানে পাখিসহ নানা সরীসৃপ ও কচ্ছপের বিচরণ দেখা যায়।
পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. আনছারুল করিম বলেন, সরকার কক্সবাজারের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। কিন্তু কেউ যদি এই পরিবেশ ধ্বংসের পক্ষে কাজ করে, তাহলে তা সরকারের মূলনীতির বিরোধী।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পর্যটন শিল্প

২৫ অক্টোবর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ