চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মানব চরিত্রের সবচেয়ে মন্দ বৈশিষ্ট্য হলো অহংকারী মনোভাব ও দাম্ভিকতা। ধরাকে সরা জ্ঞান করা দাম্ভিকদের চিরচেনা অভ্যাস। অহংকারী দাম্ভিক কাউকেই পাত্তা দেয় না, নিজেকে সর্বসের্বা মনে করে। বিধাতার বিধানের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, মানবীয় অভ্যাসের বদলে দানবীয় কার্যক্রমই তাদের নিকট সঠিক বলে বিবেচিত হয়। অহংকারী দাম্ভিকদের আল্লাহ পছন্দ করেন না। যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দাম্ভিকদের পরিণতি বেশ নির্মম ও মর্মন্তুদ। মহান প্রভু তাদের হেদায়েতের জন্য তাদের নিকটে বিভিন্ন নবী রাসুলদের প্রেরণ করেন, যাতে তারা অহমিকা, গর্ব ও দাম্ভিকতা ছেড়ে আল্লাহর বড়ত্ব স্বীকার করে। আল্লাহর বিধানকে যথাযথভাবে মান্য করে। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত ক্ষমতাকে আমানত বিবেচনা করে তাঁরই বিধান মোতাবেক রাষ্ট্রীয় শাসন পরিচালনা করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ক্ষমতা পেয়ে অনেকেই দাম্ভিকতার বশে আল্লাহর বিধানকে, আল্লাহর প্রেরিত নবী রাসুল কিংবা তাঁদের প্রতিনিধিদেরকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে বসে। জুলুমকে ক্ষমতা রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। বিধাতার বিধানের বিপরীত বিধানকেই রক্ষাকবচ মনে করে। এমন দাম্ভিকতাপূর্ণ আচরণ আল্লাহ পছন্দ করেন না। তিনি দাম্ভিকদের কৃতকর্মের প্রতিফল স্বরূপ তাদেরকে নির্মম শাস্তিতে নিপতিত করেন। পবিত্র কোরআন ও হাদীস পর্যালোচনা পূর্বক দাম্ভিকদের নির্মম পরিণতি তুলে ধরা হল।
পবিত্র কোরআন মাজিদে দাম্ভিকদের পরিণতি : এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন মাজীদে আল্লাহপাক বলেন, অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (সুরা লোকমান: আয়াত: ১৮)। তিনি অন্য আয়াতে বলেন, অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।‘নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিক আত্ম-গর্বিত ব্যক্তিকে কখনো পছন্দ করেননি। (সুরা আন নিসা: আয়াত: ৩৬)। এভাবে পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমাদের সত্যিকার উপাস্য হচ্ছে এক আল্লাহ, কিন্তু যারা পরকালকে বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর সত্য-বিমুখ এবং তারা অহঙ্কারী। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের গোপন ও প্রকাশ্য অবস্থা সবই অবগত আছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সেই লোকদের কখনও ভালবাসেন না যারা আত্ম-অহঙ্কারে নিমজ্জিত। (সুরা আন নাহল: আয়াত: ২২-২৩)। এখন যাও জাহান্নামের দ্বারসমূহে প্রবেশ কর, সেখানেই তোমাদের চিরদিন অবস্থান করতে হবে, বস্তুত ইহা হচ্ছে অহঙ্কারীদের নিকৃষ্ট বাসস্থান। (সুরা আন নাহল: আয়াত: ২৯)। ‘যা তোমাদের হস্তুচ্যুত হয় এতে যেন তোমরা দুঃখিত না হও, আর যা তোমাদের দান করেছেন এতে যেন তোমরা গর্বিত না হও। আল্লাহ কোন অহঙ্কারী গর্বিত লোককে পছন্দ করেন না।’ (সুরা আল হাদীদ: আয়াত: ২৩)। ‘আমি অপরাধী লোকদের সঙ্গে এরূপই ব্যবহার করে থাকি, তাদেরকে যখন বলা হত আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তখন তারা অহঙ্কারে ফেটে পড়ত।’ (সুরা আস সাফফাত: আয়াত: ৩৪-৩৫)। ‘আমি কত গ্রামগঞ্জ ও বস্তিই না ধ্বংস করে দিয়েছি যার অধিবাসীরা স্বীয় জীবিকা ও সহায় নিয়ে গর্ব অহঙ্কার করতো। এগুলোই তাদের ঘরবাড়ি, তাদের পরে সেখানে কমসংখ্যক লোক বসবাস করেছে। অবশেষে আমিই চূড়ান্ত মালিক রয়েছি। (সুরা আল কাসাস: আয়াত: ৫৮)। ‘সেই সব লোকের জন্য ধ্বংস ও ক্ষতি অবধারিত যারা অপরের দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করে আর পরনিন্দা চর্চায় পঞ্চমুখ হয়। (সুরা আল হুমাযা: আয়াত: ০১)
পবিত্র হাদীস শরীফে দাম্ভিকদের পরিণতি : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেছেন, যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহঙ্কার থাকবে, সে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। এক ব্যক্তি বললো হুজুর কেউ যদি তার লেবাস, পোশাক ও জুতা উত্তম হওয়া পছন্দ করে? (তাহলে সেটাও কি অহঙ্কার) রাসূল (সা.) জবাব দিলেন অবশ্যই আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। প্রকৃতপক্ষে অহঙ্কার হল আল্লাহর গোলামী হতে বেপরোয়া হওয়া এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। (মুসলিম)। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা যা ইচ্ছা খাও এবং যা ইচ্ছা তা পরিধান করো এ শর্তে যে অহঙ্কার ও অপব্যয় করবে না। (বুখারী)। হযরত হারেছা ইবনে ওহাব (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অহঙ্কারী ও অহঙ্কারের মিথ্যা ভানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (আবু দাউদ)। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি- মুমিনের পরিধেয় বস্ত্র পায়ের নলার মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রলম্বিত থাকে। যদি তার নীচে এবং গিরার উপরে থাকে তাহলেও কোন দোষ নেই। আর যদি গিরার নীচে চলে যায় তাহলে তা হবে জাহান্নামীর কাজ একথা রাসূল (সা.) তিনবার বললেন যাতে সবার কাছে এর গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে যায়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন আল্লাহ সে ব্যক্তির প্রতি কিয়ামতের দিন তাকাবেন না যে অহঙ্কারপূর্বক ভূমি স্পর্শকারী পোশাক পরিধান করে। (আবু দাউদ)।
বিভিন্ন যুগে দাম্ভিকদের পরিণতি : কওমে আদ বা আদ জাতিঃ আদ জাতির লোকেরা ছিল উন্নত। নির্মাণশিল্পে তারা ছিল জগতসেরা। তারা সুরম্য অট্টালিকা ও নয়নাভিরাম বাগান তৈরি করত। তাদের তৈরি ইরাম-এর মতো অনিন্দ্য সুন্দর শহর পৃথিবীর আর কোথাও ছিল না। তারা ভাস্কর্য ও অঙ্কন শিল্পে ছিল দক্ষ। জ্ঞান-বিজ্ঞানে তারা যেমন অগ্রসর ছিল, তেমনি সংস্কৃতিতেও অনন্য। আদ জাতির লোকদের সতর্ক করার জন্য আল্লাহ হযরত হুদ (আ.)-কে দুনিয়ায় পাঠালেন। হযরত হুদ (আ.) আদ জাতির লোকদের দাম্ভিকতা পরিত্যাগ করার আহবান জানালেন এবং আল্লাহর ইবাদত করার উপদেশ দিলেন। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে জীবন পরিচালনার কথাও বললেন। হযরত হুদ (আ.) বললেন, ‘তোমরা মজবুত অট্টালিকা বানিয়েছ এ জন্য যে, তোমরা এখানে চিরকাল থাকবে। তোমরা যখন তোমাদের দুর্বলের ওপর জুলুম করো তখন তোমরা স্বৈরশাসকের মতো বর্বর আাচরণ করো। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমাকে মান্য করো। কিন্তু লোকেরা হুদ (আ.)-এর কথা শুনল না, বরং তারা তার কথা প্রত্যাখ্যান করল। তাকে বোকা ও মিথ্যাবাদী বলে গালাগাল দিল। নবীর প্রতি এরূপ অন্যায় আচরণে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হলেন। ফলে আদদের এলাকায় দেখা দিল প্রচন্ড খরা। এতে তিন বছর তারা দুর্ভিক্ষের মধ্যে কাটাল। তারপরও তাদের স্বভাব-চরিত্রে কোনো পরিবর্তন হলো না। এবার সেখানে শুরু হলো ভয়ানক ঝড়। এই ঝড় সাত রাত ও আট দিন ধরে চলল। ফলে গোটা আদ এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলো। আল্লাহ তার রহমতে হযরত হুদ (আ.) ও তার অনুসারীদের রক্ষা করলেন।
কওমে লুত বা লুত (আ.) এর জাতি : পৃথিবীতে সর্বপ্রথম সমকামিতার বিকৃত পাপাচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল লুত (আ.)-এর জাতি। ইরাক ও ফিলিস্তিনের মধ্যবর্তী স্থানে এই জাতিটির বসবাস ছিল। এই জাতির কেন্দ্রীয় শহর ছিল ‘সাদুম’ নগরী। সাদুম ছিল সবুজ শ্যামল এক নগরী। কারণ এখানে পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ ছিল। ফলে ভূমি ছিল অত্যন্ত উর্বর এবং শস্যে ভরপুর। এমন প্রাচুর্যময় জীবনযাত্রা বেপরোয়া করে তোলে তাদের। বেপরোয়া জীবনযাত্রার কারণেই সর্বপ্রথম সমকামিতার প্রবণতা দেখা দেয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে এই জঘন্য অপকর্ম তারা প্রকাশ্যে করে আনন্দ লাভ করত। হযরত লুত (আ.) ও তাঁর কওম সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘আর লুতকে আমি প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম। আমি তাকে এমন এক জনপদ থেকে উদ্ধার করেছিলাম, যার অধিবাসীরা অশ্লীল কাজে লিপ্ত ছিল। তারা ছিল এক মন্দ ও পাপাচারী কওম। আর আমি তাকে আমার রহমতের মধ্যে শামিল করে নিয়েছিলাম। সে ছিল সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভূক্ত।’ (সূরা আম্বিয়া: আয়াত: ৭৪-৭৫)। হযরত লুত (আ.) তার কওমের পাপাচারী দাম্ভিকদেরকে এসব অশ্লীল কাজ ছেড়ে দেয়ার দাওয়াত দেন এবং তাদেরকে তাওবা করার অনুরোধ জানান।
কিন্তু তারা তাঁর দাওয়াতে সাড়া না দিয়ে উল্টো তাঁকে হত্যা করার জঘন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে হত্যা করতে উদ্ধত হয়। অবশেষে একদিন আল্লাহর গজব নাজিল হয় ওই পাপাচারী জাতির বিরুদ্ধে।
তাদের ওপর মহাপ্রলয় নেমে আসে। এক শক্তিশালী ভূমিকম্প পুরো নগরটি সম্পূর্ণ উল্টে দেয়। ঘুমন্ত মানুষের ওপর তাদের ঘরবাড়ি আছড়ে পড়ে। পাশাপাশি আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো কঙ্কর নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। ওই মহাপ্রলয়ের হাত থেকে কেউ রেহাই পায়নি। ওই জনপদের ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান। আল্লাহপাক বলেন, ‘তারা বলল, হে লুত, তুমি যদি বিরত না হও, তবে অবশ্যই তোমাকে বহিস্কৃত করা হবে। লুত বললেন, আমি তোমাদের এই কাজকে ঘৃণা করি। হে আমার পালনকর্তা, আমাকে এবং আমার পরিবারবর্গকে তারা যা করে, তা থেকে রক্ষা করো। অতঃপর আমি তাকে ও তার পরিবারবর্গকে রক্ষা করলাম। এক বৃদ্ধা ব্যতীত, সে ছিল ধ্বংস প্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত। এরপর অন্যদেরকে নিপাত করলাম। তাদের ওপর এক বিশেষ বৃষ্টি বর্ষণ করলাম। ভীতি-প্রদর্শিতদের জন্য এই বৃষ্টি ছিল কত নিকৃষ্ট। নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে; কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী নয়।’ (সূরা শোয়ারাহ : আয়াত: ১৬০-১৭৪)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।