Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ব্যাংকিং খাত টিকে থাকার চ্যালেঞ্জে

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি পর্যালোচনা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩১ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

করোনা মহামারির থাবায় শিল্প উৎপাদন এখনো নেতিবাচক। লক্ষমাত্রার থেকে অনেক দূরে রয়েছে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ। ব্যাংকে অলস অর্থের পরিমাণ প্রায় দুই লাখ কোটি। আমানত সুদহার মূল্যস্ফীতির নিচে নেমেছে। ঋণাত্মক হয়েছে মানুষের প্রকৃত আয়। এর ফলে দেশের ব্যাংকগুলোর টিকে থাকা কঠিন হবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

দীর্ঘ ছয় বছরের বিরতির পর ঘোষিত মুদ্রানীতির পর্যালোচনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবারের মুদ্রানীতির পর্যালোচনায় এসব তথ্যই উঠে এসেছে। ঘোষিত মুদ্রানীতির আলোকে পর্যালোচনাটি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানা গেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি কেমন ছিল, তা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয় মনিটরিং পলিসি রিভিউ ২০২০-এ। স¤প্রতি পর্যালোচনাটি সম্পন্ন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

মূলত, সরকারের জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নকে সামনে রেখেই মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতি বছর দু’বার মুদ্রানীতি ঘোষণা করে আসছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু বর্তমান গভর্নর ফজলে কবির গত বছরে তা একবার করার সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে জাতীয় বাজেট ঘোষণার পর প্রতি অর্থবছরের জন্য একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য স¤প্রসারণমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতোমধ্যে অর্থবছরের ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের ছয় মাস ও আগের অর্থবছরের শেষ ছয় মাস মিলিয়ে ২০২০ সালের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতির পর্যালোচনা করলো বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে, সর্বশেষ ২০১৪ সালে মুদ্রানীতির পর্যালোচনা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এবার সাংবাদিকদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুদ্রানীতি পুনরায় পর্যালোচনার আশ্বাস দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তথ্য অনুযায়ী, এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যালোচনাটি চারটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। আর্থিক সূচকগুলোর ওপর করোনা মহামারির প্রভাব কোথায় কতটুকু পড়েছে, তা তুলে ধরা হয়।

করোনাকালেই ব্যাংকের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে এনেছে সরকার। গত বছরের এপ্রিল থেকে এটি কার্যকর করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে শুধু ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ধরনের ব্যাংকঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নিতে পারবে ব্যাংকগুলো। এ বেঁধে দেয়া সুদহারের চেয়ে কোনো অবস্থাতেই বেশি নিতে পারবে না ব্যাংকগুলো। এর ফলে আমানতের সুদহারেও ১১ শতাংশ থেকে নামিয়ে পাঁচ শতাংশের ঘরে এনেছে সব ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোতে গড় আমানতের সুদহার দাঁড়িয়েছে চার দশমিক ৬৪ শতাংশ। অন্যদিকে ঋণের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে সাত দশমিক ৬২ শতাংশে। আগে যা ২২ শতাংশ পর্যন্ত ছিল। করোনায় বিনিয়োগ চাহিদা কমে যাওয়ায় বাজারে জমেছে পর্যাপ্ত পরিমাণে অতিরিক্ত তারল্য। অর্থের চাহিদা না থাকায় কলমানি বাজারেও সুদহার কমে গেছে।

মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে বলা হয়, গত বছরের মার্চ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি পাঁচ দশমিক ৬০ শতাংশের ঘরেই ছিল। করোনার প্রাদুর্ভাব প্রকাশে তা বাড়তে থাকে। পর্যায়ক্রমে তা অস্থিতিশীল হয়ে যায়। গত অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছয় দশমিক ৪৪ শতাংশে উন্নীত হয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে এটি হয়েছে। চাল ও দানাদার জাতীয় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এটি হয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংক উল্লেখ করে। অবশ্য ডিসেম্বরে কমে পাঁচ দশমিক ২৯ শতাংশে পৌঁছায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আমানতের সুদহার চার দশমিক ৬৪ শতাংশ। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে পাঁচ দশমিক ২৯ শতাংশ। এ হিসাবে আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতিরও অনেক নিচে নেমে গেছে। এতে ব্যাংকের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। গত বছরের এপ্রিল থেকেই প্রকৃত আমানত সুদহার ঋণাত্মক। মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় একজনের সুদ আয়ের চেয়ে বেশি দরে পণ্য কিনতে হচ্ছে। ফলে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে মানুষের।

প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বৈশ্বিকভাবে। এর ফলে বিদায়ী ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে এর প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতে; যা এখনো বিদ্যমান। অর্থবছরটি শেষে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয় পাঁচ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরে অর্জিত আট দশমিক ১৫ শতাংশের চেয়ে অনেক কম। ১০ শতাংশের ওপরে থাকা শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছর শেষে হয়েছে ছয় দশমিক ৪৮ শতাংশ। গত বছরে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে শিল্প উৎপাদন ছিল ঋণাত্মক ১৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এর ফলে ঋণ চাহিদা কমেছে ব্যাংক খাতে। বেসরকারি খাতে গত নভেম্বর শেষে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়ায় আট দশমিক ২১ শতাংশ। অথচ মুদ্রানীতিতে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১১ দশমিক পাঁচ শতাংশ। আগামী জুন পর্যন্ত যা ১৪ দশমিক আট শতাংশে উন্নীত হওয়ার কথা। এ হিসাবে ঋণ চাহিদা লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও নেই।

অন্যদিকে সরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আগামী জুন পর্যন্ত যা ৪৪ দশমিক ৪০ শতাংশ হওয়ার কথা। করোনার প্রভাব পড়েছে সেবা খাতের ওপরেও। যদিও তা শিল্প খাতের তুলনায় কম। দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে পাইকারি, খুচরা, যোগাযোগ, পণ্য মজুদ, পরিবহন, আর্থিক খাত ও এ খাতের ওপর নির্ভরশীল উপ-খাত, শিক্ষা, আবাসন ও সাধারণ ব্যবসায়িক কার্যক্রমে অচলাবস্থা দেখা দেয়। প্রণোদনা ঋণ প্যাকেজ ঘোষণায় গত বছরের শেষ প্রান্তিকে তৈরি পোশাকের ওপর ভর করে শিল্পোৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হয় সাত দশমিক ৯৪ শতাংশ। আমদানি-রফতানি বিষয়ে বলা হয়, গত বছরের মে মাসের পর থেকে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে কিছুটা গতি আসে; যা নভেম্বর শেষে করোনা পূর্বাবস্থার মতো হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে বন্দর দিয়ে ৮০ লাখ টনের ওপর পণ্য আমদানি-রফতানি হয়।

বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে বিষয়ে পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়, গত বছরের শুরুর দিকের তুলনায় মধ্যবর্তী সময়ে ইউএস ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার কিছুটা বেড়ে যায়। অর্থাৎ ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যায়। জানুয়ারিতে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার অবস্থান ছিল ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। গত জুন শেষে তা দাঁড়ায় ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সায়। গত ডিসেম্বরে তা আবার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় নামে। টাকার বিনিময় হার ধরে রাখতে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাজার থেকে ডলার কিনে নেয় নিয়মিত। ফলে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় গত বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক অতিরিক্ত ডলার কিনে নেয়। এভাবে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার নির্ধারণ করে।

ব্যালান্স অব পেমেন্টের বিষয়ে বলা হয়, গত চার বছর ধরেই এ খাতে বড় ঘাটতিতে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু করোনা মহামারিতে জুলাই-নভেম্বর’২০ সময়ে ব্যালান্স অব পেমেন্টে উদ্ধৃত দেখা দেয় ৪১০ কোটি ডলার। রফতানি কিছুটা বাড়লেও আমদানি প্রবণতা ছিল ঋণাত্মক। ফলে বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের ডলার খরচ হয় কম। এর ফলে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টেও ৯৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত থাকে গত নভেম্বর শেষে। যদিও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এ হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৭৬৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

এ খাতে উদ্বৃত্তের কারণ হচ্ছে, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) রেকর্ড পরিমাণ বাড়ে। সামগ্রিকভাবে গত নভেম্বর শেষে ব্যালান্স অব পেমেন্টে উদ্বৃত ছিল ৫০০ কোটি ডলার। করোনা মহামারিতেও বেড়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে এ খাতে প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে ৩৭ দশমিক ছয় শতাংশ। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত নভেম্বর শেষে দাঁড়ায় ৪১ বিলিয়ন ডলার; যা দিয়ে দেশের আট মাসের আমদানি দায় মেটানো সম্ভব।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিষয়ে বলা হয়, কভিড-১৯কে সামনে রেখে চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে সাত দশমিক চার শতাংশ। এজন্য স্বল্প সুদে ঋণ, প্রণোদনা, সুদ ভর্তুকি ও নীতিসহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক আশাবাদী হয়ে উল্লেখ করে, ব্যাংক রেট, রেপো সুদহার, সিআরআর কমিয়ে আনায় ব্যাংক খাতে তারল্যর অভাব নেই। যদিও ব্রড মানি (এম২) এখনও সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ অর্থনীতিতে পূর্বের মতো প্রভাব ফেলবে না বলেই আশা করা যায়। করোনার ভ্যাকসিন প্রয়োগ একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে অর্থনীতিতে। এর ফলে চলতি বছরে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে গতি বাড়বে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্যাংক

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ