Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী আন্দোলন তুরস্ক মডেল

প্রকাশের সময় : ৩০ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মু. সগির আহমদ চৌধুরী

॥ এক ॥
১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কে খিলাফত বিলুপ্ত করে কামালাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। সুদীর্ঘ সাত শতাধিক বছর ধরে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বদানকারী তুর্কি জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় নাস্তিক্যবাদ। রাষ্ট্র, আইন-আদালত, শিক্ষাঙ্গন, সংস্কৃতি, ভাষা-সাহিত্য সবখান থেকে ইসলাম বিতাড়িত হলো। মাদরাসা-মকতব বন্ধ হয়ে গেল। মসজিদসমূহ জাদুঘরে পরিণত হল। আরবি ভাষা ও হরফ নিষিদ্ধ হল। ওলামায়ে কেরাম, পীর-মাশায়েখ ও বুযুর্গানে দীন দলে দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে গেলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো এতো সব সত্ত্বেও তখনকার সময়ে মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় কামালা পাশা বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন। আরও অবাক করা বিষয় হচ্ছে, তুর্কি ওলামায়ে কেরাম তখন দলে দলে দেশ ছেড়ে হিজরত করছিলেন, কামালাবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-প্রতিরোধ কিংবা প্রতিবাদ করেননি। কামালাবাদের বিরুদ্ধে মিছিল-বিক্ষোভ সংঘটিত হয়নি, কোনো মানুষজনও প্রতিবাদ করতে গিয়ে মারা যাননি।
তুর্কি জনগণের ওপর এমন অন্ধকার-অমানিশার সময় একজন বদীউজ্জমান সাঈদ নুরসী (রহ.) এগিয়ে এসেছিলেন। ওয়ায-বয়ান ও খুরধার লেখনী দ্বারা তিনি তুর্কি মুসলমানদের সুপ্ত ঈমানি চেতনাকে জাগ্রত করতে অশেষ প্রয়াস চালান। রুহানি তত্ত্বজ্ঞান, যৌক্তিক আলোচনা এবং বাগ্মিতাপূর্ণ বক্তব্য দ্বারা ধর্মহীনতার পরিণতি, ধর্মনিরপেক্ষতার অসারতা এবং প্রগতি-আধুনিকতার নামে আদর্শিক দেউলিয়াত্বের বিরুদ্ধে তুর্কি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে সচেষ্ট হন। তিনি তুর্কি জনগণকে পূর্ণাঙ্গ মুসলমানি আদর্শ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন, ঈমান-আমলে সালিহসমৃদ্ধ ও জাগিতকভাবেও নিজেদেরকে একটি বলিষ্ঠ জাতিতে পরিণত হতে উৎসাহিত করেন। তিনি নিজেকে রাজনীতিতে জড়াননি, সরাসরি ইসলামী হুকুমতের ডাকও দেননি, এরচেয়ে ভবিষ্যৎ হুকুমতের জন্য যে ধরনের যোগ্য কর্মী এবং জনমানসিকতা প্রয়োজন সেটাই তিনি প্রস্তুত করে গেছেন।
১৯৬০ বদীউজ্জমান সাঈদ নুরসী (রহ.) ইন্তিকাল করেন। তাঁর ইন্তিকালের অব্যবহিত পর তাঁর অনুসারীদের মধ্যে দুটো ধারার সৃষ্টি হয়। তাঁদের একদল ইসলামপন্থিদের রাজনীতিক শক্তি অর্জনের তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। আর তাঁদের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. নাজমুদ্দীন আরবাকান। অন্য একদল রাজনীতি এড়িয়ে আধ্যাত্মিক উন্নতি, অর্থনৈতিক ভিত্তি অর্জন এবং ঈমান-আমলের মজবুতির মাধ্যমে জাতিকে পূর্ণরূপে ইসলামে ফিরিয়ে আনার কৌশল অবলম্বনের পক্ষপাতি ছিলেন। এই শেষোক্তদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হলেন মুহাম্মদ ফতহুল্লাহ গুলেন। ১৯৫০ সালের নির্বাচনে কামালাবাদী রিপাবলিকান পিপলস পার্টির সাবেক দু’জন এমপি ‘জেলাল বায়ার’ ও ‘আদনান মেন্দেরেস’-এর নেতৃত্বে গঠিত ডেমোক্রেটি পার্টি বিজয়ী লাভ করে এবং তাঁদের সরকার আরবিতে আজান, কুরআন শেখা, নামাজ পড়ার অনুমতি এবং মুসলিমদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চর্চার ওপর থেকে বেশকিছু বিধি-নিষেধ তুলে নেন। তখন থেকে মূলত তুর্কি মুসলমানদের সচেতন ধর্মীয় জাগরণের সূচনা ঘটে।
১৯৬৯Ñ২০০০ সময়টা বিবেচনা করলে তুর্কি মুসলমানদের দুটো অবস্থা পরিষ্কার বোঝা যায়। ১. ব্যক্তিগতভাবে ধর্ম-কর্ম পালন ও চর্চার অবস্থা এবং ২. ইসলামী শক্তির রাজনীতিক অবস্থা। এই সময়ের মধ্যে ইসলামী শক্তি ও রাজনীতিক দলসমূহ নানা বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছে বটে কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ধর্ম-কর্ম চর্চার ব্যাপারটি ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়েছে। রাজনীতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের দরুণ ইসলামপন্থিরা বারবার ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়েছেন, পক্ষান্তরে রাজনীতির বাইরে থাকা ইসলামী নেতৃবৃন্দ ক্রমান্বয়ে স্বাধীন এবং উন্মুক্তভাবে ইসলাম প্রচারের ধারাবাহিক সুযোগ পেয়েছেন। এখানে আরও পরিষ্কার যে, নানা বাধা-বিপত্তির ফলে ইসলামী রাজনীতিক শক্তিসমূহ যেমন আরও উদ্দীপ্ত হয়েছে, তেমনিভাবে এসব জুলুম-নিপীড়নের কারণে জনগণ ইসলামপন্থিদের ওপর আরও বেশি পরিমাণে সহানুভূতিশীল হয়েছে এবং এটা ইসলামপন্থিদের জন্য জনশক্তি বৃদ্ধিতে বড়ই সহায়ক হয়েছে। অন্যদিকে রাজনীতি এড়িয়ে চলার দরুণ ধর্মীয় নেতারাও ইসলাম প্রচার করতে পেরেছেন অনেকটা নিরাপদে। অর্থাৎ বলতে গেলে দু’দিক থেকেই ইসলাম লাভবান হয়েছে, দুটো ধারাই আত্মনিবেদিত হয়ে ইসলামের খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন।
অতঃপর ভীষণ বাধা-বিপত্তি এবং বারবার ইসলামী দলসমূহকে নিষিদ্ধ করা এবং সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইসলামের অগ্রযাত্রা রুখে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী দলসমূহের মধ্যে রাজনীতিক কলা-কৌশলে পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এমন প্রেক্ষাপটে আবদুল্লাহ গুল এবং তরুণ তুর্কি নেতা রজব তাইয়েব এরদুগান নুরসী অনুসারীদের বিদ্যমান দুটো ধারাকে সমন্বিত করার একটা কৌশল অবলম্বন করেন। এর অংশ হিসেবেই ফতহুল্লাহ গুলেনের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন তিনি। এরদুগান তাঁর রাজনীতিক গুরু ড. নাজমুদ্দীন আরবাকানের রক্ষণশীল নীতি থেকে কিছু সরে এসে ফতহুল্লাহ গুলেনের নীতির সাথে একাত্ম হন এবং অনেকটা সংস্কারবাদী ও উদারনৈতিক নীতি-কৌশল অবলম্বন করেন। আর বতর্মান একে পার্টি সেসব নীতি-কৌশলের ফল একেবারে নাগাদ পেয়েছে এবং এর বদৌলতে একে পার্টি ক্ষমতায় এসেছিল। ইদানীং ফতহুল্লাহ গুলেনের সাথে এরদুগানের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করলেও এখনও একে পার্টি গুলেনের নীতি-কৌশল নিয়ে চলছে বা তা থেকে সরে আসার কিছু নেই এরদুগানের। গুলেনের নীতি-কৌশলগুলোর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে,
বলা হচ্ছে, ‘গুলেন নাকি মনে করেন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রয়োজন নেই।’ কথাটা ঠিক সেভাবে নয়। ইসলামী রাষ্ট্রের বিষয়টা তিনি অস্বীকার করেন এ ধরনের বক্তব্য তাঁর থেকে প্রমাণিত নয়। তবে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের চেয়ে ইসলামী রাষ্ট্রগঠন উপযোগী কর্মী এবং জনমানসিকতা তৈরির প্রতিই অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাঁর মতে ইসলামী রাষ্ট্র গঠনই বড় কথা নয়, সেটা টেকসই করা এবং সেটা টিকিয়ে রাখতে পারাই বড় চ্যালেঞ্জ। তাই তিনি ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের চেয়ে মানুষির নৈতিক-আধ্যাত্মিক উন্নতি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, জ্ঞান-বিজ্ঞানে দক্ষতা এবং দেশ পরিচালনায় যোগ্য একদল তৈরিতে অধিক মনোযোগ দেওয়ার জন্য গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাঁর এই নীতি-কৌশল এরদুগানের একে পার্টি গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এরদুগান এই নীতি-কৌশল অবলম্বন করেছেন দীর্ঘ একযুগের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও তড়িৎ গতিতে দেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করেননি এরদুগান। এরদুগান এখনো জনমানসিকতা তৈরির কাজটাই করছেন। সেক্ষেত্রে তিনি অনেকটা সফল প্রমাণিত হয়েছেন, আইনের শাসন, সামাজিক সুবিচার, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক উন্নতির মাধ্যমে জনহৃদয় জয় করছেন তিনি। ফলে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থান রুখে দিয়েছেন খোদ জনগণই।
গুলেন মনে করেন, ‘অনেক মুসলিম রাষ্ট্রের চেয়েও আমেরিকা বা ইউরোপে ইসলাম অনেকটা স্বমহিমায় সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং স্বাধীনভাবে বিকশিত হচ্ছে।’ এর কারণ ওখানকার গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং স্বাধীনতা। কাজেই মুসলিম বিশ্বে ইউরোপ-আমেরিকা মডেলের গণতন্ত্র বিকশিত হলে ইসলামের বিজয় আরও তরান্বিত হতো বলে তিনি দৃঢ় বিশ্বাস করেন। হ্যাঁ! এটা তো সত্যি যে, মধ্যপ্রাচ্য-আরব বিশ্বসহ অন্যান্য মুসলিম দেশে স্বৈরচারী শাসকের বদলে আমেরিকা ধাঁচের গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং স্বাধীনতা প্রচলিত থাকলে এখানকার শাসকযন্ত্রের কল-কব্জা এতো দিনে ইসলামপন্থিদের হাতে থাকতো! গুলেনের এ নীতি-কৌশলও এরদুগানের একে পার্টি গ্রহণ করেছিল। তুরস্কে এরদুগান সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলামী আন্দোলন তুরস্ক মডেল
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ