চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
শিশুরা জাতির ভবিষ্যত। শিশুদের ভালোবাসা ও তাদের প্রতি আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে ইসলাম যে দিক নির্দেশনা দিয়েছে তা মেনে চললে এ নৈতিক অবক্ষয় থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হত। হযরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন এক বেদুইন নবী (স:) এর কাছে এসে বললো আপনারা শিশুদের চুমু দেন আমরাতো তাদেরকে চুমু দেই না। উত্তরে নবী (স:) বলেন আল্লাহ তাআলা তোমার অন্তর থেকে দয়ামায়া উঠিয়ে নিয়ে গেলে আমি তার কি করতে পারি। (বুখারী) একদা নবী (স:) ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য গৃহ থেকে বের হলেন একটু গিয়ে দেখলেন এক শিশু মলিন বেশে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। নবী (স:) তার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন বাবা তুমি কাঁদছে কেন? শিশুটি জবাবে বলল, আমার বাবা মা বেঁচে নেই আমি অসহায়, ঈদে আমার কোন পোষাক নেই, আমি দু:খে কাঁদছি। নবী (স:) শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে ফিরে এলেন, তাকে গোসল করিয়ে নতুন পোষাক দিলেন এবং বললেন আজ থেকে আমি বিশ্ব নবী মোহাম্মদ (স:) তোমার বাবা, আয়েশা (রা:) তোমার মা, ফাতেমা (রা:) তোমার বোন। নবীজির আদর পেয়ে শিশুটি তার দু:খ ভুলে গেল। ছোট শিশু উমায়েরের একটি ছোট পাখি ছিল। একবার সে বসেছিল তার নিকট পাখিটি ছিলনা। নবীজি (স:) তার নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন বললেন হে উমায়ের তোমার পাখিটি কোথায়? ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দ্বীনি শত ব্যস্ততার মধ্যেও নবী (স:) শিশুটির পাখির বিষয়টি স্মরণ রেখেছেন বলে শিশুটি অবাক হল। নবী (স:) এর দুই নাতি ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন (রা:) কে নবী (স:) কত আদর করতেন তা ইতিহাস খ্যাত। নবীজি ঘোড়ার মত হামাগুড়ি দিয়ে চলতেন আর নাতিরা নবী (স:) এর পিঠ মোবারকে আরোহন করতেন। যায়েদ বিন হারেসা (রা:) শিশু কালে দাস হিসেবে বিক্রি হন। হাত বদল হতে হতে নবী (স:) এর হাতে এসে পড়েন। তার পিতা মাতা তার খোঁজ পেয়ে তাকে মুক্ত করতে নবী (স:) এর কাছে আসেন। নবী (স:) তাকে মুক্ত করে দিয়ে তার পিতা মাতার সাথে চলে যাওয়ার অথবা নবী (স:) এর নিকট থেকে যাওয়ার যে কোন একটি গ্রহনের সুযোগ দিলেন। তিনি নবী (স:) এর সাথে থাকার ইচ্ছা পোষন করলেন। নবী (স:) এর স্নেহের কারণে সে এরূপ করেছিল। পরবর্তীতে নবী (স:) তাকে আপন পালক পুত্র হিসেবে গ্রহন করেছিলেন। অনেক অসহায় পরিবার অভাবের তাড়নায় শিশুদের বাসাবাড়িতে, গ্যারেজে, শিল্পকারখানার কাজে নিয়োজিত করছে। ছোট মানুষ, কাজে তার কিছু ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সামান্য ভুলের জন্য মালিক পক্ষ অনেক সময় তাদের সাথে নির্দয় আচরণ করেন। আপনার ছোট শিশুটির কথা একটু ভাবুন, তাকে কি এ ধরণের কাজে নিয়োজিত করবেন? আর সেই বা এ বয়সে কতটুকু দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারবে? আবু হোরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল (স:) বলেছেন- কেউ তার অধীনস্থ (চাকর) কে অন্যায়ভাবে একটি বেত্রাঘাত করলেও কিয়ামতের দিন তার থেকে তার বদলা নেয়া হবে (তাবরানী)। আবু বকর (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন নবী (স:) বলেছেন- অধীনস্থদের (চাকর) প্রতি ক্ষমতার অপব্যবহারকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা (ইবনে মাজাহ)। মনিব যা খায়, যে ধরণের পোষাক পরে দাস-দাসীদেরকে একই ধরণের খাওয়া ও পোষাক প্রদানের নির্দেশ ইসলাম দিয়েছে। নবী (স:) বলেছেন- তোমাদের কারো খাদেম তার জন্য খাবার নিয়ে এলে তাকে তার সাথে বসিয়ে খাবার খাওয়াতে না পারলে (কমপক্ষে) এক বা দুই লোকমা যেন তার মুখে তুলে দেয়। কারণ সে কষ্ট করে তার জন্য খাবার প্রস্তুত করে এনেছে (বুখারী)। দাস-দাসী কোন ভুল করলে ক্ষমা করা উত্তম। আল্লাহ বলেছেন- ক্ষমা প্রদর্শন কর, ভালো কাজের আদেশ দাও, জাহেলদের থেকে বিমুখ থাক (সূরা আরাফ-১৯৯)। হযরত আনাস (রা:) শিশু বয়সে নবী (স:) এর খাদেম নিযুক্ত হন। তিনি দশ বছর নবী (স:) এর খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বলেন- এ দীর্ঘ সময়ে নবী (স:) কখনো হে আনাস তুমি এটা করলেনা কেন? বা ওটা এরূপ করলে কেন? এরূপ বলেননি। তিনি আরো বলেন- একদা নবী (স:) একটি কাজে আমাকে এক জায়গায় প্রেরণ করলেন। যাওয়ার পথে শিশুরা খেলছে দেখে আমি তাদের খেলা দেখতে লাগলাম এবং কাজের কথা ভুলে গেলাম। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হল হঠাৎ আমার মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে আমি পিছনে তাকিয়ে দেখি নবী (স:) আমার মাথায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভয় পেয়ে গিয়ে বললাম- আমি এখনি যাচ্ছি। নবী (স:) মুচকী হেসে বললেন- তিনি নিজে গিয়ে ঐ কাজটি সেরে এসেছেন, তিনি আমাকে একটু রাগও দেখালেন না। আল্লাহ পাক বলেন- অতএব তুমি ইয়াতিমদের প্রতি নির্দয় আচরণ করো না এবং প্রার্থনাকারীকে ধমক দিওনা (সুরা আদ-দোহা ৯-১০)। নবী (স:) বলেছেন- যে আমাদের ছোটদের প্রতি দয়া করেনা এবং বড়দের অধিকার আদায় (সম্মান) করে না সে আমার উম্মত নয়। শিশু ও সন্তানদের প্রতি আমাদের কর্তব্যও রয়েছে । শিশু মার্তৃগর্ভে আসার পর মায়ের চিন্তা চেতনায় সততা ও ইসলামী ভাবধারা প্রাধান্য পাওয়া উচিত, কারণ তার চিন্তা চেতনা সন্তানের উপর প্রভাব ফেলে। জন্মের সাথে সাথে ছেলে বা মেয়ে যাই হোক না কেন তার ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামাত দিয়ে তাওহীদের বাণী তার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। পূর্ণ দু’ বছর মায়ের দুধ পান করা শিশুর অধিকার। আল্লাহ বলেন- গর্ভধারণ ও দুধপানের সময় সীমা ত্রিশ মাস (সূরা আহকাফ-১৫)। জন্মের সাতদিনের সময় তার আকিকা করা ও মাথার চুল কামানো সুন্নাত, সম্ভব হলে চুলের ওজন পরিমান স্বর্ণ বা রৌপ্য অসহায় দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করে দিতে হবে। সালমান ইবনে আমের জাবি (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন- আমি রাসূল (সা;) কে বলতে শুনেছি সন্তানের আকিকা করা প্রয়োজন সুতরাং তার পক্ষ থেকে তোমরা রক্ত প্রবাহিত কর, তার থেকে কষ্ট দুর কর (বুখারী)। সন্তান পুত্র বা কন্যা যাই হোক ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা নিষেধ ।
নবী (সা:) বলেছেন- যার কন্যা সন্তান রয়েছে সে তাকে প্রোথিত করেনি, অবহেলা করেনি, পুত্র সন্তানকে তার উপর প্রাধান্য দেয়নি আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন (আবু দাউদ)। সন্তানকে দ্বীনি জ্ঞান, নৈতিকতা, সততা শিক্ষা দেয়া প্রত্যেক অভিভাবকের অবশ্য কর্তব্য। শিশুকে সৎ উপদেশ দেয়া প্রয়োজন, লোকমান (আ:) তার ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছেন কুরআনের ভাষায় তা বর্ণনা করা হয়েছে-হে প্রিয় বৎস আল্লাহর সাথে শিরক করো না নিশ্চয়ই শিরক বড় যুলুম। নামায কায়েম করবে, সৎ কাজের আদেশ দিবে, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে, মানুষ কে অবজ্ঞা করে মুখ ফিরিয়ে নিবে না, অহংকার করে জমিনে চলবেনা, আল্লাহ অহংকারীদের ভালোবাসেন না। নিম্ন স্বরে কথা বলবে, গাধার মতো জোরে চিৎকার সবচেয়ে অপছন্দনীয়। (সূরা লোকমান-১৩ এবং ১৬-১৯) পরিবারকে সুন্দরভাবে পরিচালনা ও সন্তানকে মানুষ করার জন্য ব্যয় করার জন্য নবী (সা:) গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি (স:) বলেন- যে লোক (পরকালে) প্রতিদান পাওয়ার আশায় পরিবার পরিজনের জন্য ব্যয় করে তা তার জন্য সাদকাহ হিসাবে গন্য হবে (বুখারী মুসলিম)। অনেক শিশুকে দেখা যায় ভিক্ষা বৃত্তিতে নিয়োজিত, কেউ টোকাই সেজে বাসা বাড়ীতে চুরিতে লিপ্ত হয়। জানাজা বা ভিড়ের মধ্যে বড়দের পাশে দাড়িয়ে পকেট থেকে মোবাইল, টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। এ বিষয়ে অভিভাবক অনেকাংশে দায়ী। আগেই বলা হয়েছে শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। নাটক সিনেমা তাদেরকে বেশি প্রভাবিত করে, এজন্য পাখি জামা, ঝিলিক জামার জন্য আত্নহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। নাটক সিনেমায় ধুমপান, মদপানের দৃশ্য, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের দৃশ্য, শিশুদের ধুমপান, নেশা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের দিকে নিয়ে যায়। এ বিষয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব রয়েছে। আবদুল্লা ইবনে ওমর (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- আমি রাসূল (সা:) কে বলতে শুনেছি- সাবধান! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল, তোমাদের প্রত্যেককে নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে (আখিরাতে) জিজ্ঞাসা করা হবে। দেশের শাসককে তার দেশের নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। একজন পুরুষকে তার পরিবারের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। একজন গৃহিণী তার স্বামীর সংসারে সন্তানাদী দেখাশুনার জন্য দায়িত্বশীল তাকে ঐ দায়িত্বের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। চাকরকে তার মনিবের সম্পদ রক্ষা ও অন্যান্য দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। অতএব সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেককেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে (বুখারী)। তাই আসুন আমরা শিশুদের প্রতি সদয় হই। ঝুকিপূর্ণ ও অনৈতিক কাজে তাদের নিযুক্ত না করি, তাদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তাদের কে আদর্শ, সৎ ও যোগ্য নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলে ভবিষ্যত পৃথিবীকে সুন্দর করার পথ সুগম করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।