Inqilab Logo

বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মাদকের জালে লক্ষীপুর

এস এম বাবুল (বাবর), লক্ষীপুর থেকে | প্রকাশের সময় : ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

লক্ষীপুর সদরে বসবাস আয়েশা ও আব্দুল্লাহ দম্পতির। বিয়ের ৭ বছরের পর নিঃসন্তান দম্পতির ঘরে জন্ম নিল বহুল প্রতীক্ষিত ছেলে সন্তান। আদর করে নাম রাখেন খোকা। উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া খোকার বেড়ে ওঠায় ছিল নবাবী আমেজ। বংশের বাতিখ্যাত খোকাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত তার পরিবার। সবার স্বপ্ন বড় হয়ে সে ডাক্তার হবে। উজ্জ্বল করবে পরিবারের মুখ। পরিবারের স্বপ্ন পূরণে খোকাও ছিল অবিচল। ৫ম শ্রেণি ও ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়া খোকাকে গ্রাম থেকে নিয়ে ভর্তি করা হয় জেলার একটি সরকারি বিদ্যালয়ে। যেখানে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে জড়িয়ে যায় মাদকের জালে। ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করার স্বপ্নে ডুবে থাকা ছেলেটির মাথায় এখন শুধুই মাদকের নেশা। বিভিন্ন কৌশলে মা-বাবার কাছ থেকে নেশার টাকা সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। ট্যালেন্টপুল বৃত্তি পাওয়া ছেলেটি এসএসসি পরীক্ষায় ৩ বিষয়ে অকৃতকার্য হয়। অবশেষে মা-বাবা বুঝতে পেরে তাকে টাকা দেয়া কমিয়ে দিতেই হিংস্র হয়ে ওঠে সে।

প্রায় বাবা-মাকে মারধর করত সে। নিরুপায় হয়ে তারা দ্বারস্থ হন মাদক নিরাময় কেন্দ্রের। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে সে। একদিন টাকা না পেয়ে মাকে লাঠি দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে । সন্তানের এমন অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কষ্টে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় মা আয়েশা। স্ত্রী মৃত্যু ও সন্তানের এমন কর্মকান্ডের শোক সইতে না পেরে পরকালে পাড়ি জমায় আব্দুল্লাহও। মা-বাবা হারিয়েও থেমে যায়নি খোকা। উচ্চবিত্ত বাবার সকল সম্পত্তি বিক্রি করে নেশায় বুঁদ থাকে সে। একসময় ঘরের সকল আসবাবপত্র, ঘর এমনকি বাড়িভিটাও বিক্রি করে। তাইতো একসময় নরম বিছানায় ঘুমানো খোকার বর্তমান আবাসস্থল বিভিন্ন খোলা মাঠ কিংবা বাগ-বাগিচা।
লামচর গ্রামের দুই সন্তানের জনক জনৈক ব্যক্তি ইয়াবা নামের মরণ নেশার আগ্রাসনে বর্তমানে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পরিবারের একমাত্র উপাজর্নক্ষম ব্যক্তির এমন অবস্থায় স্ত্রী দুই সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে সবাই। বাধ্য হয়ে ঐ স্ত্রী বর্তমানে বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন। জেলার প্রতিটি উপজেলায় এটি হাজারো পরিবারে বর্তমান চিত্র। মাদকের জালে জড়িয়ে হাজারো পরিবার হয়েছে নিঃস্ব।
জানা গেছে, লক্ষীপুরে মাদক ব্যবসায় নারীদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে। জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নিস্ক্রিয়তা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উদাসীনতা, রাজনৈতিক ছত্রছায়া, মাদকের সহজলভ্যতা, মাঝে মাধ্যে র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে মাদকদ্রব্য সেবন কিংবা বিক্রির দায়ে গ্রেফতারকৃতরা সহজে জামিনে বেরিয়ে আসাসহ বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কুমিল্লার পদুয়া, সুয়াগাজি, ফেনীর মোহাম্মদ আলী, বিলোনিয়া, পশুরাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি থেকে বালুর ট্রাক ও মৌসুমী বিভিন্ন ফলের সাথে সড়ক পথে ইয়াবা, মদ, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য লক্ষীপুর সদর উপজেলায় আসে। টেকনাফ ও কক্সবাজার নদী পথে মাদকদ্রব্য রামগতি ও কমলনগর হয়ে জেলা ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। নোয়াখালী জেলার চাটখিল, চাঁদপুর জেলার শাহ্রাস্তি ও হাজিগঞ্জ হয়ে লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলা এবং চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ হয়ে রায়পুর উপজেলায় মাদকদ্রব্য বাজারে আসছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম থেকে ট্রলার, জাহাজসহ বিভিন্ন নৌযানে মাদকদ্রব্য রামগতি ও কমলনগর এলাকায় আসে। সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় বিভিন্ন স্পটে মটরসাইকলে, সিএনজিসহ বিভিন্ন বাহনের মাধ্যমে ভ্রাম্যমান মাদক বিক্রেতারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ইউনিয়ন এবং পৌরসভার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একাধিক স্পটে প্রকাশ্যেই মাদকের ব্যবসা চলছে। দলীয় পরিচয়ে উঠতি বয়সের তরুণ ও যুবকরা অনেক রাত পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা ও মহল্লায় মাদক সেবন করে। জনশ্রুতি রয়েছে, জনপ্রতিনিধি-রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের অনেকেই মাদকের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। এলাকায় তরুণ ও যুবক মাদক সেবীদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধির ফলে অভিভাবক মহল উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠায় রয়েছেন। অভিভাবক মহল মাদকদ্রব্যের মরণ ছোবল থেকে আদরের সন্তানদের বাঁচানোর স্বার্থে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গসহ বিভিন্ন পেশার নাগরিকদের সহায়তা কামনা করেন। এ বিষয়ে লক্ষীপুর জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ইন্সিপেক্টর আলম মন্ডলের মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি ছুটিতে থাকায় কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে লক্ষীপুর সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আজিজুর রহমান মিয়া জানান, লক্ষীপুরে প্রতিনিয়ত মাদক বিরোধী অভিযান অব্যাহত রয়েছে, মাদকের ব্যাপারে পুলিশ জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছে।

কাল পড়ুন : দিনাজপুরে বিপন্ন তরুণসমাজ



 

Show all comments
  • Mohammad Mosharaf Mojumder ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:৩৮ এএম says : 0
    মাদক নির্মুলে সব সময়ই বলা হয় সরকার ও প্রশাসনের শুন্য সহনশীলতার(জিরো টলারেন্স? কথা।কিন্তু বাস্তবতার সাথে তার কোন মিল নেই।কিছু অভিযান হয়,ক্রসফায়ার করে কিছু মানুষকে বিচার বহির্ভূত ভাবে হত্যা করা হয়।এই সবই লোক দেখানো।অথচ যারা মুলহোতা তারা মহান সংসদে বসে থাকে,তাদের কখনো বিচার হয় না।যদি বিচার হতো,জবাবদিহিতা থাকতো,তাহলে মাদক এতোটা সহজলভ্য হতো না।হাজারো পরিবারের স্বপ্নও নষ্ট হতো না।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাদক

২২ অক্টোবর, ২০২২
২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ