Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় আরো সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ২০ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

করোনা ভাইরাসের মহামারিতে বিশ্বের প্রায় সব দেশই আক্রান্ত হয়েছে এবং তাতে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। এসবের মধ্যে পুরুষ ও বয়স্করা বেশি। ইউনিসেফ জানিয়েছে, করোনায় সংক্রমিত ৯ জনের মধ্যে ১ জন শিশু। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর যারা সুস্থ হয়েছে, তাদেরও বেশিরভাগ দীর্ঘমেয়াদী মানসিক সমস্যায় পড়বে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। করোনায় প্রাণীরাও আক্রান্ত হচ্ছে। অপরদিকে, করোনা মোকাবেলায় দীর্ঘকালীন লকডাউনে ‘বৈশ্বিক মহামন্দা’ সৃষ্টি হয়েছে, যা ৩০-এর দশকের মন্দার চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। জাতিসংঘ জানিয়েছে, করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে হত দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪০% বেড়েছে। তাই ২০২১ সালে ২৩.৫ কোটি মানুষের জরুরি মানবিক সাহায্য প্রয়োজন। এ জন্য সংস্থাটির প্রয়োজন ৩.৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এ বছর দাতা দেশগুলো রেকর্ড ১,৭০০ কোটি মার্কিন ডলার দান করেছে, যা দিয়ে নির্ধারিত লক্ষ্যের প্রায় ৭০% মানুষের কাছে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব। অবশ্য, ওইসিডি বলেছে, ‘চলতি বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতি ৪.২% সংকুচিত হবে। তবে ২০২১ সালেই বৈশ্বিক অর্থনীতি ৪.২% প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে।’ আইএলও বলেছে, ‘করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকের মজুরি কমেছে। কোটি কোটি মানুষ কর্ম হারিয়েছে। সর্বোপরি কর্মজীবীদের মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে প্রযুক্তি। তবুও করোনাকালে প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপক বেড়েছে। ফ্লেচার ও মাস্টারকার্ডের মতে, ‘কভিড-১৯ মাত্র কয়েক মাসে ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের উন্নয়ন ঘটিয়ে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে প্রযুক্তির প্রচলন ও ব্যবহারকে অন্তত পাঁচ বছর এগিয়ে দিয়েছে।’ বিশ্বের অন্য অঞ্চলেরও অবস্থা তদ্রুপ। করোনা পরবর্তী অটোমেশনের ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে বলে বিবিসির খবরে প্রকাশ। এভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়ছে, মানুষের কর্ম তত কমে যাচ্ছে। ইউনিসেফ বলেছে, করোনায় গত ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৩২ কোটি শিশুর ক্লাস বন্ধ আছে। এতে তারা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে। অন্য এক খবর মতে, করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার আশংকাজনকভাবে বাড়ছে। ইউএনডিপি বলেছে, ‘করোনা ভাইরাস মহামারি ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে নতুন করে ২০.৭০ কোটির বেশি মানুষকে চরম দারিদ্র্যে ঠেলে দেবে। ফলে এই সময়ের মধ্যে বিশ্বের মোট চরম দরিদ্রের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে ১০০ কোটির ওপরে।পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’ ‘ক্ষুধার মহামারি করোনাভাইরাস মহামারি থেকে ভয়ঙ্কর হতে পারে’ বলে জানিয়েছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়া বলেছে, ‘বিশ্বে প্রতি ১০টি দেশের মধ্যে ছয়টিরও বেশি করোনা মহামারির কারণে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে, যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি হুমকিস্বরূপ।’ বিভিন্ন সংস্থার তথ্য মতে, ‘করোনাকালে নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে অনেক।’ এই অবস্থায় করোনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। এতে ইউরোপের দেশগুলো, আমেরিকা ও ভারতে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসি বলেছেন, ‘বড়দিন পরবর্তী করোনার অবস্থা থ্যাংকস গিভিং ডে এর চেয়ে আরও ভয়াবহ হতে পারে।’ তাই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য কোথাও কোথাও লকডাউন/কারফিউ শুরু হয়েছে। এভাবে বৈশ্বিক আর্থিক অবস্থা অবর্ণনীয় ক্ষতির মুখে পড়ছে, যা সামাল দিতে অনেকদিন লেগে যাবে। জাতি সংঘের মহাসচিব বলেছেন, ‘করোনা ভাইরাস মহামারির পরও এর ধাক্কার বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে লড়াই করতে হবে পৃথিবী বাসীকে।’

করোনা মোকাবেলার লক্ষ্যে প্রাণপণ চেষ্টা করার পর এর ব্যয়বহুল টিকা প্রায় চূড়ান্ত করেছে চীন, রাশিয়া ও অক্সফোর্ড। ইতোমধ্যেই কোনো কোনো দেশে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে ট্রায়াল চূড়ান্ত হওয়ার আগেই। যেমন: রাশিয়া। আবার কোথাও কোথাও টিকা দেওয়ার লোকও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া, সব ট্রায়াল শেষে ফাইজারের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে যুক্তরাজ্য। আরও কয়েকটি দেশ ফাইজারের টিকা অনুমোদন করেছে। তবে যুক্তরাজ্যের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলেছে, ‘মারাত্মক অ্যালার্জিজনিত সমস্যা রয়েছে এমন মানুষের ফাইজারের ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত নয়।’ ‘করোনার টিকা নেওয়ার পর ২ মাস পর্যন্ত মদ্যপানে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন’ রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ। তবুও ‘হু’ বলেছে, ‘করোনা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে টিকা।’ তাই মানুষকে করোনার টিকা নিতে উৎসাহী করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, ‘যখন করোনার ভ্যাকসিন সহজলভ্য হয়ে যাবে তখন তিনি ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে চান এবং তিনি জনসম্মুখেই ভ্যাকসিন নেবেন।’ ব্রিটেনের রানীও বলেছেন, ‘তিনি করোনার টিকা নেবেন।’ রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা একজোট হয়ে তাদের টিকা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং স্পুৎনিক ভি’র সম্মিলিত পরীক্ষা চালাবেন। তারা দেখতে চান, মানবদেহে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে অধিকতর অ্যান্টিবডি তৈরি হয় কিনা। অপরদিকে, অনেক টিকা ট্রায়ালে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন: অস্ট্রেলিয়ান সিএসএল ও কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করেছিল। অস্ট্রেলিয়া সরকার সেটির ৫০ লাখ ডোজ ক্রয়াদেশও দিয়েছিল। কিন্তু ট্রায়ালে কয়েকজনের ক্ষেত্রে অনাকাক্সিক্ষত ফলাফল আসায় অস্ট্রেলিয়ার সরকার এখন বিকল্প খুঁজছে। করোনার টিকা ক্রয়ের জন্য প্রচন্ড প্রতিযোগিতা শুরু করেছে ধনী দেশগুলো। তাই পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স বলেছে, ‘২০২১ সালে বিশ্বের জনবহুল ৭০টি নিম্ন আয়ের দেশের ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই করোনার টিকা থেকে বঞ্চিত হবে। কারণ, পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত ও ধনী দেশগুলো ইতোমধ্যেই করোনার সম্ভাব্য টিকাগুলোর ৫৩% আগাম ক্রয়াদেশ দিয়েছে, যাদের জনসংখ্যার হার বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৪%।’ যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায়ও বলা হয়েছে, ‘ভ্যাকসিন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে।’ অপরদিকে, উন্নত দেশগুলোতে হিমাঙ্কের নিচে শীতলতম সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থা সহজসাধ্য হলেও বাংলাদেশসহ বহু দেশ কোল্ড চেইন সিস্টেমের চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি। ফরচুন ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে, ‘ফাইজারের টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি আর মোডার্নার টিকা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। তাই এ দু’টি টিকা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য সংগ্রহ করা খুব কঠিন ও ব্যয়বহুল হবে।’ অবশ্য, চীন বলেছে, ‘তাদের জাতীয় ওষুধ ও সিনোভেক্স-এর টিকা এতো তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে না। উপরন্তু চীনের টিকা বিশ্বের টিকার চাহিদা পূরণ করতে পারবে।’ করোনার টিকা পাওয়া, মূল্য, সরবরাহ ও ব্যবহার নিয়ে চরম দুঃশ্চিন্তায় পড়েছে গরীব ও উন্নয়নশীল দেশের মানুষ। তাদের এ দুঃশ্চিন্তা দূর করা আবশ্যক। সে লক্ষ্যে করোনা টিকা জাতি সংঘের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সমবণ্টন ও বিনামূল্যে প্রদান করার ব্যবস্থা করা অপহিহার্য। নতুবা গরীব দেশগুলোর মানুষ ব্যাপক হারে আক্রান্ত হওয়া ও মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। করোনার টিকা পাওয়া নিয়ে চরম সামাজিক ও রাজনৈতিক গোলযোগ সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনার টিকাকে গ্লােবাল কমন গুড ঘোষণার দাবি উঠেছে।গ্লোবাল কমন গুডের অর্থ হচ্ছে- করোনার ভ্যাকসিনের উপর বিশ্বের সব মানুষের সমান অধিকার থাকতে হবে, যেমন আলো-বাতাসের উপর সবার সমঅধিকার রয়েছে। এ নিয়ে কাজ করছে পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স। এই অবস্থায় করোনার টিকা কেনা ও এর যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্য ৯ বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল গঠন করেছে এডিবি। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৬৮ দেশ এডিবির সদস্য। বাংলাদেশসহ সব দেশই এর সুবিধা পাবে। একই উদ্দেশ্যে বিল গেটস ২৫০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। করোনাকালের খারাপ খবরের মধ্যে একটি ভালো খবরও আছে। সেটা হচ্ছে: গ্লােবাল কার্বন প্রজেক্টের বার্ষিক রিপোর্ট মতে, লকডাউন এবং যোগাযোগ ও চলাচলের বিধিনিষেধের কারণে ২০২০ সালে কার্বন নিঃসরণ রেকর্ড ৭% কমেছে।

পত্রিকার খবর মতে, বাংলাদেশে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেড় কোটি মানুষের জন্য নিশ্চিত হয়েছে। এটা মোট জনসংখ্যার ৯%। আর গ্যাভির মাধ্যমে প্রায় ৭ কোটি ডোজ করোনা ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে, যা ২০২১ সালে মধ্যে আসবে। দেশে ভ্যাকসিন পরিবহন, সংরক্ষণ ও প্রয়োগ, অতিরিক্ত লোকবলের প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত পরিমাণে কোল্ড চেইন সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এখনো সম্ভব হয়নি বলে খবরে প্রকাশ। এছাড়া, করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থাও অপ্রতুল বলে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। অন্য এক খবরে প্রকাশ, ‘করোনাভাইরাসের দীর্ঘ ১০ মাসেও স্বাস্থ্য খাতে কাটেনি বেহাল দশা। করোনার পাশাপাশি এখনো সাধারণ রোগীরা হাসপাতালে গিয়ে নানা ভোগান্তিতে পড়ছে। ঢাকাসহ সারা দেশেই এখনো আইসিইউ সংকট রয়েছে। জেলা সদরের অধিকাংশ হাসপাতালই চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী সংকটে। অধিকাংশ হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। যেগুলো রয়েছে সেগুলোও দিনের পর দিন বিকল হয়ে আছে। এসব সমস্যা যেন দেখার কেউ নেই।’ সর্বোপরি দেশে করোনার টিকা বিতরণে দলীয়করণ নিয়েও মানুষের মধ্যে চরম উদ্বেগ রয়েছে। কারণ, দলীয়করণ বর্তমানে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। করোনার ক্ষেত্রে সেটা হলে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে। কারণ, এর সাথে জীবন-মরণ সম্পর্ক জড়িত। তাই এই টিকা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাকুরীজীবী, পেশাজীবী ও ষাটোর্ধ্ব মানুষকে দেওয়া দরকার পরিচয়পত্র দেখে। তারপর অন্যদেরকে। তাহলে এ ব্যাপারে কোনো সংকট সৃষ্টি হবে না।

করোনা মহামারিতে বাংলাদেশেও ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে ক্ষতির পরিমাণ আরও ব্যাপক হতে পারে। কিন্তু প্রথম ঢেউয়েই দেশের যে ক্ষতি হয়েছে তা সহজে পূরণ হবে না। যেমন: বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং আক্রান্ত হয়েছে অসংখ্যজন। প্রতিষ্ঠানের দিক দিয়ে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা, ব্যবসা ও প্রবাসী খাত। বিডা ও আইএফসি’র যৌথ জরিপ রিপোর্ট মতে, ‘করোনার প্রভাবে দেশের ৮৮% ব্যবসায়ী বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এই সময়ে শিল্প কারখানায় ব্যাপক হারে বিনিয়োগের পাশাপাশি উৎপাদনও কমেছে।’ গত নভেম্বরে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রকাশিত রিপোর্ট মতে, ‘সংস্থাটির তালিকায় থাকা কারখানার সংখ্যা ৫৮,৮৩৬টির মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ৮,০২৯টি। এর মধ্যে গার্মেন্ট ৭১৩টি ও অন্য কারখানা ৭,৩১৬টি। বন্ধ হওয়া এসব কারখানার অধিকাংশের ক্ষেত্রেই করোনার প্রভাব পড়েছে।’ দেশের ব্যবসা খাতের এই ক্ষতি সহজে পূরণ হবে না। কারণ, দেশের সর্বাধিক শ্রমঘন খাত হচ্ছে গার্মেন্ট। মোট রফতানির ৮৪% আয়ও এই খাতের। সে গার্মেন্ট রফতানি অনেক হ্রাস পেয়েছে। এর প্রধান রফতানিস্থান হচ্ছে পশ্চিমাদেশগুলো। সেখানে সর্বাধিক আঘাত হেনেছে করোনা।ফলে দেশগুলোর আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে, যা কয়েক বছরেও পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে পারবে না। ফলে আমাদের গার্মেন্ট রফতানি সহজে বৃদ্ধি পাবে বলে মনে হয় না। অবশ্য, সরকার দেশের ব্যবসা খাতকে রক্ষা করার জন্য এক লাখ কোটি টাকার ওপর স্বল্প সুদে ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু বড় শিল্প সে সহায়তা কিছু পেলেও এসএমই সে সহায়তা তেমন পায়নি। অথচ এসএমই ফাউন্ডেশনের গবেষণা প্রতিবেদন মতে, ‘দেশের মোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ৯৮ ভাগের বেশি এসএমই।’ আইডিএলসি ও পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের যৌথ গবেষণা রিপোর্ট মতে, ‘পাঁচ বছরের ব্যবধানে গড়ে নতুন চাকরির সুযোগ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এসএমই- ১০৫.৭ শতাংশের বেশি, আর সেবামূলক প্রতিষ্ঠান- ১৭৪.২ শতাংশের বেশি।’ কিন্তু সেই এসএমই খাত করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। তবুও করোনা সহায়তা প্যাকেজের হার এসএমই খাতেই সবচেয় কম। উপরন্তু যে সামান্য সহায়তা ঘোষণা করা হয়েছে, তার তেমন বাস্তবায়ন হয়নি ব্যাংকগুলোর গড়িমসির কারণে ও সরকারের কঠোর তদারকির অভাবে। একই অবস্থা হয়েছে সেবাখাতেও। সর্বোপরি সিপিডি বলেছে, ‘করোনা মহামারীতে সৃষ্ট সঙ্কটে যে ক্ষতি হয়েছে তা পোষাতে সরকার যেসব নীতি ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা যথেষ্ট নয়।’

করোনায় দেশের বেশিরভাগ মানুষ চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। ব্র্যাকের হিসাবে এ কারণে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৩২% মানুষ কাজ হারিয়েছে। আর আয় কমেছে ৮৪% মানুষের। যারা কাজ হারিয়েছে বা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ব্র্যাক, ডেটা সেন্স ও উন্নয়ন সমন্বয়-এর এক যৌথ সমীক্ষা রিপোর্ট মতে, করোনায় বাংলাদেশের ১০.২২ কোটি মানুষের আয় কমে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে করুণ অবস্থায় রয়েছে মধ্যবিত্ত। স্থানীয় সরকারমন্ত্রীও বলেছেন, ‘করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির থাকায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর প্রভাব পড়েছে। তবে মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।’ এক গবেষণা রিপোর্ট মতে, ‘করোনার প্রভাবে দেশের দারিদ্র্য বেড়ে ৪০% হয়েছে।’ পিপিআরসি ও বিআইজিডি’র গবেষণা মতে, ‘করোনাকালে রাজধানী ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে অন্তত ১৬% দরিদ্র মানুষ। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা খরচ, যোগাযোগের ব্যয় এবং অন্য নানামুখী ব্যয় মেটাতে না পেরেই এসব মানুষ ঢাকা ছেড়েছে। তবে করোনার প্রভাব বেড়ে গেলে ঢাকা ছাড়ার সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাবে।’ একই অবস্থা দেশের প্রায় সব শহরেরই। কিন্তু শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়া এই লোকদের বেশিরভাগেরই বাড়ি ও জমি নেই। উপরন্তু কর্মও তেমন নেই এখন গ্রামে। ফলে তারা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে নিপতিত হয়েছে গ্রামেও। সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেছেন, ‘কোভিডের কারণে আমাদের অর্থনীতি যে সমস্যায় পড়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য অন্তত তিন থেকে পাঁচ বছর লেগে যাবে।’

সরকার করোনায় আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে অনেক সহায়তা পেয়েছে। আরও সহায়তা পাবেন বলে অনুমেয়। সরকার উন্নয়ন ব্যয় ২৫% কাটছাঁট করছে। উপরন্তু করোনা মহামারির বিপর্যয়ের কারণে স্বল্পোন্নত দেশের প্রাপ্য সুবিধাগুলো ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বহাল রাখার জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদন করেছে। এসব ভালো উদ্যোগ। কিন্তু করোনার ভয়াবহ ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য ব্যাপক দুর্নীতি, অপচয়, কর্মকর্তাদের ব্যয়বহুল বিদেশ ভ্রমণ ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। নতুবা করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। আয় বৈষম্যও কমবে না। করোনা মহামারির শেষ কবে, তা কেউ বলতে পারে না। সকলেই নিশ্চিত যে, এই মরণঘাতি ব্যাধি বিদায় নিতে যত দেরি হবে তত প্রাণহানি, আক্রান্ত ও আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। তাই এসব সামাল দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে প্রতিটি দেশকেই এবং বৈশ্বিকভাবেও।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনা

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন