Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শ্রীলঙ্কায় জোর করে ২০ দিনের মুসলিম শিশুর ম‍ৃতদেহ দাহ, বিশ্বব্যাপি বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড়

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০, ৭:২৬ পিএম

শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে গত ৯ ডিসেম্বর ২০ দিন বয়সী একটি মুসলিম শিশুকে বাবা-মায়ের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও দাহ করার এক ঘটনা দেশ বিদেশে ক্ষোভ ও নিন্দার জন্ম দিয়েছে। ওই ঘটনায় শ্রীলঙ্কা ছাড়াও বিশ্বের আরও অনেক দেশ থেকে ক্ষোভ ও নিন্দার খবর পাওয়া গেছে। কোভিড-১৯ রোগে মরলেই জাতি-ধর্ম নির্বিশেষ মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলার সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু মুসলমানগণ এমনিতেই ক্ষুব্ধ। তাদের কথা, রাজাপাকসের সরকার মুসলমানদের ধর্মীয় স্পর্শকাতরতাকে ইচ্ছা করে অবজ্ঞা করছে। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া ১০৭ জন মুসলমানকে জোর করে দাহ করা হয়েছে। -বিবিসি বাংলা, এএফপি

জানা গেছে, আক্রান্ত সন্দেহে মৃত শেখ নামের শিশুটিকে জোর করে দাহ করার ঘটনা মুসলিমদের ক্ষোভকে আরও উস্কে দিয়েছে। কলম্বোর যে ক্রিমেটোরিয়াম বা দাহ করার স্থানে শিশুটিকে দাহ করা হয়, সেখানে মুসলিমরা রোববার দলে দলে হাজির হয়ে দেয়ালে গেটে সাদা ফিতা ঝুলিয়ে দেয়। সারা শ্রীলঙ্কা জুড়েই বহু মুসলমান তাদের দরজা-জানালায়-দেয়ালে সাদা ফিতা বেঁধে প্রতিবাদ করছে। প্রতিবাদ চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘স্টপফোর্সডক্রিমেশন‘ এই হ্যাশট্যাগে। আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেও প্রবাসী শ্রীলঙ্কান মুসলমানেরা বিক্ষোভ করেছেন। তাদের সাথে যোগ দেন অন্য দেশের মুসলিম এবং মানবাধিকার কর্মীরা। চারজন ব্রিটিশ এমপি এক যৌথ বিবৃতিতে দাহ করার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহারে শ্রীলঙ্কার ওপর চাপ দিতে ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করেছেন। এছাড়া, ৫৭টি মুসলিম দেশের জোট ওআইসি গত সপ্তাহে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মত বিবৃতি জারী করে মুসলিমদের দাহ করার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহারের দাবি করছে।

যে শিশুটির মৃতদেহ জোর করে দাহ করা হয়, তার কোভিড হয়েছিল কিনা সে বিতর্কের এখনও সুরাহা হয়নি। শিশুটির বাবা অটোচালক মোহাম্মদ ফাহিম এবং তার স্ত্রী সাফিনা ছয় বছর চেষ্টার পর ছেলের জন্মের কারণে যারপরনাই খুশী হয়েছিলেন। ৭ ডিসেম্বর বাচ্চাটি অসুস্থ হওয়ার পর দ্রুত তাকে তারা কলম্বোর একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। কোভিড সনাক্ত করতে ডাক্তাররা সেই রাতেই তিনজনের শরীরে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করেন। ফাহিম এবং সাফিনা করোনাভাইরাস নেগেটিভ হিসেবে শনাক্ত হলেও তাদের বাচ্চা পজিটিভ বলে জানানো হয়। ডাক্তাররা বাচ্চাটিকে রেখে রাতেই জোর করে বাবা-মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। মোহাম্মদ ফাহিম বিবিসিকে বলেন, আমি ও আমার স্ত্রী কান্নাকাটি করেছি যেন আমাদের বাচ্চার পাশে থাকতে দেয়া হয়। তারা তা দেয়নি। পরদিন অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর বাবাকে ফোন করে জানানো হয় যে, শিশুটি কোভিডে মারা গেছে। ফাহিম এখনও মানতে চান না যে তার বাচ্চার আসলেই কোভিড হয়েছিল। তার কথা, তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনই যেখানে নেগেটিভ, বাচ্চার কীভাবে কোভিড হয়। শুধু অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে দেওয়া সিদ্ধান্ত তিনি মানছেন না।

কিন্তু শুধু সন্তানের মৃত্যুই নয়, যেভাবে জোর করে তাদের আপত্তি থাকা স্বত্তেও ২০ দিনের বাচ্চাকে দাহ করা হয়েছে, তা নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ পুরো পরিবার। দেশে-বিদেশে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছে যে, বাচ্চার মৃতদেহ নিতে বাবা-মা অস্বীকার করার পর দাহ করার এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মোহাম্মদ ফাহিম অবশ্য বিবিসিকে বলেন, হাসপাতালের কথা “ডাহা মিথ্যা“, বরঞ্চ তাকে ডেকে নিয়ে জোর করে কাগজে সই করার জন্য চাপ দেয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, দাহ করার আগ মূহুর্তে তাকে ফোন করে ক্রিমেটোরিয়ামে আসতে বলা হয়। তিনি গিয়েছিলেন, কিন্তু ভেতরে ঢোকেননি। “আমি কী করে দেখবো যে আমার ২০ দিনের বাচ্চাকে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন কষ্ট যেন আর কাউকে সহ্য করতে না হয়।

শ্রীলঙ্কায় মুসলিম সংগঠনগুলোর জোট 'মুসলিম কাউন্সিল অব শ্রীলঙ্কা'র ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইলমি আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের তোয়াক্কা না করে মুসলমানদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে তা “এক কথায় বর্ণবাদ।’’

তিনি বলেন, "২০ দিনের একটি বাচ্চার মরদেহ জোর করে দাহ করা সমস্ত অসভ্যতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে।’’ মি. আহমেদ বলেন, কোভিড হয়ে মরলে দাহ হতে হবে এই ভয়ে শ্রীলঙ্কার মুসলমানেরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। “শুধু এই ভয়ে অনেক মুসলমান কোভিডের উপসর্গ দেখা দিলেও হাসপাতালে যাচ্ছে না। গোপন রাখছে। আর গোপনে পরিচিত ডাক্তারদের কাছে যাচ্ছে।’’ তিনি বলেন, প্রতিদিন তাদের সংগঠনের কাছে শত শত ফোন আসছে সাহায্য চেয়ে। “তারা বুঝতে পারছেন না কি করবে। সাহায্য চাইছেন,’’ যোগ করেন তিনি।

এপ্রিল মাসে করোনাভাইরাসে মৃতদের জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দাহ করার সিদ্ধান্ত জারীর পর থেকেই দেশটির মুসলিম সংগঠন গুলো এবং মুসলিম রাজনীতিকরা সরকারের সাথে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য দেন-দরবার করছেন। বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে মৃতদেহ দাহ করা ইসলামের অনুশাসন বিরোধী এবং মুসলিমদের কাছে এটি কত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। কিন্তু সরকার এতে কানে দিচ্ছে না। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের কবর দেওয়া পুরোপুরি নিরাপদ বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন এবং ১৯০টি দেশে কবর দেয়া এবং দাহ করা সমান্তরালে এই দুটোই করা হচ্ছে - এসব যুক্তিও সরকার মানছে না। ইলমি আহমেদ বলেন, “সরকার বারবার দোহাই দিচ্ছে টেকনিক্যাল কমিটির পরামর্শে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি, যিনি ওই কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি একজন জুডিশিয়াল মেডিকেল অফিসার, তিনি কোনো ভাইরোলজিস্ট নন। আমরা সত্যিকারের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এই টেকনিক্যাল কমিটির পুনর্গঠন চেয়েছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে নৈতিকতারও একটি বিষয় রয়েছে, কমিউনিটির কথা রয়েছে। কোন কথাই কানে তোলা হচ্ছে না।’’


মুসলিম কাউন্সিল অব শ্রীলঙ্কার ভাইস প্রেসিডেন্ট ইলমি আহমেদ বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, কোভিডের উপসর্গ দেখা দিলেও অনেক মুসলিম ভয়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন না।জনাব আহমেদ আরও বলেন, তারা সরকারকে এমন প্রস্তাবও দিয়েছেন যে কংক্রিটের কাসকেট বানিয়ে মৃতদের কবর দেওয়া হোক, যাতে ভূগর্ভস্থ পানিতে কোন সংক্রমণ না ছড়াতে পারে। “কিন্তু তাও তারা শোনেননি।’’ সরকার যুক্তি দিচ্ছে, বিশেষজ্ঞ কমিটি সরকারকে বলেছে যে শ্রীলঙ্কায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ভূপৃষ্ঠের অনেক গভীরে নয়। ফলে, কোভিড রোগী কবর দিলে ভূগর্ভস্থ পানি দুষিত হয়ে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি তৈরি হবে। মুসলিমরা এখন পর্যন্ত আদালতে এ নিয়ে যত আবেদন করেছে, দেশটির সুপ্রিম কোর্ট তার সবগুলো খারিজ করে দিয়েছে। ইলমি আহমেদ বলেন, তাদের এখন ভয় সরকারের এই “একগুঁয়েমি আচরণের“ প্রভাব মুসলিম তরুণ-যুবকদের ওপর কীভাবে পড়ে তা নিয়ে। “মুসলিম তরুণরা দেখছে, তাদের বাবা-দাদা-চাচাদের কবর না দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা অবশ্যই খুশি নয়। এতে করে অনেকেই হয়ত কট্টরপন্থার দিকে ঝুঁকতে পারে।’’ মুসলিম কাউন্সিল অব শ্রীলঙ্কা'র এই ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস করেন, কোভিডে মারা গেলে মুসলমানদেরও দাহ করার এই সিদ্ধান্তের সাথে শ্রীলঙ্কায় “কট্টর বৌদ্ধ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ“-এর উত্থানের সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, “কট্টর বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা এখন রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। গত নির্বাচনের আগে এসব বৌদ্ধ নেতারা খোলাখুলি বলেছেন শ্রীলঙ্কা একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্র, সুতরাং সরকার হবে বৌদ্ধ সরকার।“
শ্রীলঙ্কার সরকার এখন কোভিডে মৃত মুসলমানদের মৃতদেহ মালদ্বীপে নিয়ে গিয়ে কবর দেওয়ার জন্য সরকার চেষ্টা করছে - এমন একটি খবর শ্রীলঙ্কান মুসলিমদের মধ্যে নতুন ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বার্তা সংস্থার এএফপি জানিয়েছে যে মালদ্বীপের সরকার শ্রীলঙ্কায় কোভিডে মারা যাওয়া মুসলমানদের কবর দেওয়ার অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে। মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহ শহীদ টুইট করেছেন, “প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম মোহাম্মদ সোলিহ ইসলামী ধর্মমতে শেষকৃত্যের বিষয়ে শ্রীলঙ্কাকে সহযোগিতা করা নিয়ে তার মন্ত্রীদের সাথে পরামর্শ করছেন।’’ মালদ্বীপের মন্ত্রী বলেন, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের অনুরোধে মালদ্বীপ সরকার এটি বিবেচনা করছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতা ইলমি আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, পাকিস্তান এবং মালয়েশিয়ায় মরদেহ নিয়ে কবর দেওয়া যায় কি-না, তা নিয়ে কিছু মুসলিম অধিকার কর্মী এবং কয়েকটি মুসলিম ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ শুরু করেছে। তবে বিদেশে নিয়ে কবর দেওয়া নিয়ে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে টুইটারে কলম্বোর সাংবাদিক মুনযা মুশতাক লিখেছেন, “আমরা সংখ্যালঘু হতে পারি, কিন্ত আপনার মতই আমরাও এদেশের নাগরিক। সুতরাং দয়া করে আমাদের এদেশেই কবর দেওয়ার অনুমতি দিন।’’ এবিষয়ে শ্রীলংকান মন্ত্রী কেহেলিয়া রামবুকওয়েলা বিবিসিকে বলেন, মুসলমানদের প্রতি কোনো বৈষম্য করা হচ্ছে না। তার যুক্তি, “বৌদ্ধরাও তো অভিযোগ করতে পারে যে তারাও পুরোপুরি ধর্মমতে শেষকৃত্য করতে পারছে না।’’ অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে টুইট করা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে তার মন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের ডেকে উঁচু কোন জায়গা যেখানে পানির স্তর বেশ নীচে এমন জায়গায় কবর দেওয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন।



 

Show all comments
  • Jack Ali ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০, ৮:৫০ পিএম says : 0
    O'Allah curse SriLankan government and wipe out them by corona virus. Ameen
    Total Reply(0) Reply
  • Younus ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০, ৯:০৪ পিএম says : 0
    20 দিনের শিশুকে দাহ। এর প্রতিবাদ কিভাবে কোন ভাষায় হবে,অবাক হলাম এরা কিনা শিক্ষায় অগ্রসর। সম্পূর্ণ অগ্রহনযোগ‍্য। শ্রীলংকার বর্তমান সরকার যা করছে তা কিছুতেই মানা যায় না। স্পর্ধা কোথায় পেল। এই বৌদ্ধ দেশটার বর্তমান শাসকদের বলপূর্বক মুসলমানদের আগুনে পুরে ফেলার সিদ্ধান্ত বদলান,বাড়াবাড়ি করইয়েন না।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শ্রীলঙ্কা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ