চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
॥ শেষ কিস্তি ॥
প্রশ্ন হ’ল, ঈসা (আ.) কর্তৃক দাজ্জাল নিধনের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় মুসলমানরা কার বিরুদ্ধে যুদ্ধে রত থাকবে? তারা কি তাহলে সকল কবীরা গোনাহগার মুসলমানকে হত্যা করবে? মাথাব্যথা হলে কি মাথা কেটে ফেলতে হবে? নাকি মাথাব্যথার ওষুধ দিতে হবে? অথচ উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যা এসেছে একই অনুচ্ছেদের অন্য হাদিসে। যেখানে রাসূল (সা.) বলেন, ‘চিরদিন আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল হক-এর উপরে বিজয়ী থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ঐভাবে থাকবে’ (মুসলিম হা/১৯২০)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যারা তাদের শত্রুতা করবে, তারা তাদের উপরে বিজয়ী থাকবে’ (মুসলিম হা/১০৩৭)। যার ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারি বলেন, তারা হ’ল শরী‘আত অভিজ্ঞ আলেমগণ। ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন, তারা যদি আহলুল হাদিস না হয়, তাহলে আমি জানি না তারা কারা? (শরহ নববী)। এখানে লড়াই অর্থ আদর্শিক লড়াই ও ক্ষেত্র বিশেষে সশস্ত্র লড়াই দুইই হতে পারে। কেবলমাত্র সশস্ত্র যুদ্ধ নয়। রাসূল (সা.) তাই বলেন, ‘খারেজীদের থেকেই দাজ্জাল বের হবে’ (ইবনু মাজাহ হা/১৭৪)।
(৭) নিসা ৬৫ : ‘তোমার পালনকর্তার শপথ! তারা কখনো মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়ে তোমাকে ফায়ছালা দানকারী হিসাবে মেনে নিবে...’ (নিসা ৪/৬৫)। খারেজী আকিদার মুফাসসিরগণ অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন ‘তাগূতের অনুসারী ঐসব লোকেরা ‘ঈমানের গ-ী থেকে বেরিয়ে যাবে। মুখে তারা যতই দাবি করুক না কেন’ (সাইয়িদ কুতুব, তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন ২/৮৯৫)। অথচ এখানে ‘তারা মুমিন হতে পারবে না’-এর প্রকৃত অর্থ হ’ল, ‘তারা পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না’।
কারণ উক্ত আয়াত নাজিল হয়েছিল দু’জন মুহাজির ও আনছার ছাহাবীর পরস্পরের জমিতে পানি সেচ নিয়ে ঝগড়া মিটানোর উদ্দেশ্যে (বুখারি হা/২৩৫৯)। দু’জনই ছিলেন বদরী সাহাবী এবং দু’জনই ছিলেন স্ব-স্ব জীবদ্দশায় ক্ষমাপ্রাপ্ত ও জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত। অতএব তাদের কাউকে মুনাফিক বা কাফির বলার উপায় নেই। কিন্তু খারেজী ও শী‘আপন্থী মুফাসসিরগণ তাদের ‘কাফের’ বলায় প্রশান্তি বোধ করে থাকেন। তারা আয়াতের প্রকাশ্য অর্থ নিয়েছেন ও সকল কবীরা গোনাহগার মুসলমানকে ‘কাফের’ সাব্যস্ত করেছেন। ফলে তাদের ধারণায় কোন মুসলিম সরকার ‘মুরতাদ’ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার রাষ্ট্রে কিছু কুফরী কাজের প্রকাশ ঘটালো’ (যুগে যুগে শয়তানের হামলা ১৪৫ পৃ.)। অথচ তারা আরবীয় বাকরীতি এবং হাদীছের প্রতি লক্ষ্য করেননি।
যেমন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ্র কসম! ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় (৩ বার), যার প্রতিবেশী তার অনিষ্টকারিতা হতে নিরাপদ নয়’ (বু:মু: মিশকাত হা/৪৯৬২)। এখানে ‘মুমিন নয়’ অর্থ পূর্ণ মুমিন নয়। তারা বলেছেন, মক্কার মুশরিকরা আল্লাহকে বিশ্বাস করার পরেও মূর্তিপূজার অপরাধে তাদের জান-মালকে হালাল করা হয়েছিল। তদ্রুপ বাংলার শাসকবর্গ ঈমান আনয়নের পর মূর্তি ও দেবতা পূজায় লিপ্ত হওয়ার জন্য মুশরিকে পরিণত হয়ে ‘মুরতাদ’ হয়েছে। তাদের জান ও মাল মুসলিমের জন্য হালাল’ (ঐ, ১৫১ পৃ.)। অথচ মক্কার মুশরিকরা ইসলাম কবুল করেনি।
(৮) শূরা ১৩ : আল্লাহ বলেন, ‘...তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর ও তার মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করো না। তুমি মুশরিকদের যে বিষয়ের দিকে আহ্বান কর, তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়...’ (শূরা ৪২/১৩)। অত্র আয়াতে বর্ণিত ‘আক্বীমুদ্দীন’ অর্থ ‘তোমরা তাওহীদ কায়েম কর’। নূহ (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলকে আল্লাহ একই নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সকল মুফাসসির এই অর্থই করেছেন। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল পাঠিয়েছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করো এবং ত্বাগূতকে বর্জন করো’ (নাহল ১৬/৩৬)। এর দ্বারা সার্বিক জীবনে আল্লাহ্র দাসত্ব তথা ‘তাওহীদে ইবাদত’ বুঝানো হয়েছে। কিন্তু খারেজীপন্থী লেখকগণ ‘তোমরা দ্বীন কায়েম কর’-এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন ‘তোমরা হুকূমত কায়েম করো’ (আবুল আ‘লা মওদূদী, খুত্ববাত ৩২০ পৃ.)। এর পক্ষে তারা একটি হাদিসেরও অপব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই বনু ইস্রাঈলকে পরিচালনা করতেন নবীগণ। যখন একজন নবী মারা যেতেন, তখন তার স্থলে আরেকজন নবী আসতেন’ (বুখারি হা/৩৪৫৫)। এখানে এর অর্থ তারা করেছেন ‘নবীগণ বনু ইস্রাঈলদের মধ্যে রাজনীতি করতেন’। আর এটাই হ’ল ‘সব ফরযের বড় ফরয’।
আসল ফরজটি কায়েম না থাকায় নামাজ-রোজা সমাজে ফরজের মর্যাদায় নেই, ‘মুবাহ’ অবস্থায় আছে- যার ইচ্ছা নামাজ-রোজা করে’ (অধ্যাপক গোলাম আযম, রসূলগণকে আল্লাহতায়ালা কী দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন? সূরা হাদীদ ২৫ আয়াতের ব্যাখ্যা)। অর্থাৎ নবীগণ সবাই ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করেছেন। বস্তুতঃ এটি নবীগণের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ছাড়া কিছুই নয়।
(৯) মায়েদাহ ৩ : ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম...। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। বিদায় হজের দিন সন্ধ্যায় অত্র আয়াত নাজিল হয়। অতএব ইসলাম যেহেতু সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে পূর্ণতা পেয়েছে, সেহেতু আমাদেরকে সর্বদা সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে’। অথচ রাসূল (সা.)-এর পূর্ণ জীবনই মুসলমানের জন্য অনুসরণীয়, কেবলমাত্র শেষ আমলটুকু নয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্র রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে ও অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করে’ (আহযাব ৩৩/২১)। বস্তুতঃ রাসূল (ছাঃ) মাক্কী ও মাদানী উভয় জীবনে আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকার-এর নীতিতে মানুষকে আল্লাহ্র পথে দাওয়াত দিয়েছেন। শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসাবে আমাদেরও সেটাই কর্তব্য (আলে ইমরান ৩/১১০)।
(১০) আত্মঘাতী হামলা : রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে মুসলমান ...তার দ্বীন রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ..’ (তিরমিযী হা/১৪২১)। এজন্য তারা আত্মঘাতী হামলা জায়েয মনে করেন। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না’ (নিসা ৪/২৯)। আত্মহত্যা করা মহাপাপ। জিহাদের ময়দানে আহত হয়ে তীব্র যন্ত্রণায় কাতর জনৈক সৈনিক আত্মহত্যা করলে রাসূল (সা.) তাকে ‘জাহান্নামী’ বলে আখ্যায়িত করেন। কেননা তার শেষ আমলটি ছিল জাহান্নামীদের আমল। অতঃপর রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই ফাসেক-ফাজেরদের মাধ্যমে এই দ্বীনকে সাহায্য করে থাকেন’ (বুখারি হা/৩০৬২, ৪২০২)।
পরিশেষে বলব, বিদেশি আধিপত্যবাদীদের চক্রান্তে ও তাদের অস্ত্র ব্যবসার স্বার্থে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে এবং তাদেরই এজেন্টদের মাধ্যমে এটি সর্বত্র লালিত হচ্ছে। অতএব সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ও আলাহভীরু সৎসাহসী প্রশাসনের পক্ষেই কেবল এই অপতৎপরতা হতে দেশকে রক্ষা করা সম্ভব। সেই সাথে আবশ্যক আলেম-ওলামাদের মাধ্যমে ব্যাপক গণজাগরণ সৃষ্টি করে তরুণ বংশধরগণকে আল্লাহ্র পথে ফিরিয়ে আনা। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!।
লেখক : আমীর, আহলে হাদিস
আন্দোলন বাংলাদেশ
শিক্ষক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।