Inqilab Logo

বুধবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

বঙ্গবন্ধু: যার অবস্থান মানুষের হৃদয় গভীরে

ড. এম এ মাননান | প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়। তিনি নিজেই একটি দেশ, যার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু, দুটিই অবিচ্ছেদ্য। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নেতা হিসেবে সুপরিচিত বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনটা ছিল বহু ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ এক বিভীষিকাময় জীবন। বার বার তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু পেছনে হটে যাননি কখনো। ষড়যন্ত্র তার পিছু ছাড়েনি, তিনিও ষড়যন্ত্রের শেকল দলিত-মথিত করে পথ চলেছেন অটল চিত্তে। হরেক রকমের ষড়যন্ত্রের ঘেরাটোপে থেকেও তিনি নিজ যোগ্যতাতেই হয়ে উঠেছেন জাতির জনক, পরিণত হয়েছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায়। তার অনুভবে ছিল বাংলার স্বাধীনতা, ছিল শোষকদের কবল থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি। তিনি তো চেয়েছিলেন সবার বাকস্বাধীনতা, অর্থনৈতিক শোষণমুক্তি, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে বাঙালির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, সার্বিকভাবে সকল নাগরিকের কল্যাণময় জীবন। তাঁর এ চাওয়াটুকুই সহ্য হয়নি শাসকদের, তাদের এদেশীয় দোসরদের আর আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের চক্রান্তকারীদের। তারা পরিকল্পিতভাবে তার বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু এতো ষড়যন্ত্র করেও পারেনি হিমালয়সম শির উঁচু করা মানুষটিকে নামত করতে। তিনি এখন মহাশূন্যে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কল্যাণে, যা উড্ডীন হয়েছে তারই যোগ্যকন্যা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার উদ্যোগে আর তার যোগ্য নাতি জয়ের পরিকল্পনায়। এ দু’জনের দৃঢ় সংকল্প আর শুভ প্রচেষ্টা আজ বঙ্গবন্ধুকে চির অ¤øান রূপ দিয়ে চক্রান্তকারীদের সকল অশুভ চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছে।

ষড়যন্ত্র করেছিল তারা, যারা চায়নি এদেশ স্বাধীন হোক, দেশের মানুষ শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হোক, দেশটি পৃথিবীর মানচিত্রে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হোক। তারা ষড়যন্ত্র করে তাকে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়ে যা পেয়েছে, তাহলো মৃত্যুর পরে তার জীবন্ত অবস্থান মানুষের হৃদয়ে, অন্তরের মণিকোঠায়, বেঈমান ব্যতীত সকল বাঙালির চিন্তাচেতনায়। ষড়যন্ত্রকারীরা সংখ্যায় কম হলেও তাদের হাত ছিল অনেক দীর্ঘ। তারা ছিল বহুরূপী। ছিল দলের ভিতরে, ছিল বাইরে, ছিল দূরদূরান্তের দেশে। ষড়যন্ত্রের বিস্তার ঘটিয়েছে তারা হাতে হাত রেখে। ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের জাল বিছিয়ে ওরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই দাবিয়ে রাখতে চায়নি, তারা সকল বাঙালিকেও দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল। শাসকদের চক্রান্তের পর চক্রান্ত আর বছরের পর বছর জেল-জীবন দেশের মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা একটুও কমাতে পারেনি। পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতন, ষড়যন্ত্র, মামলা-হামলা কোনো কিছুই তাকে এক চুলও নড়াতে পারেনি তার অবস্থান থেকে। বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী সুবিশাল হৃদয়ের এ মানুষটিকে বিশ্বাসঘাতকরা বাঁচতে দেয়নি। স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জাতির পিতাকে সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ভাগ্যক্রমে তাঁর দুই কন্যা বিদেশে অবস্থান করার কারণে বেঁচে যান। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের শোকাবহ দিনটিতে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে এদেশে শুরু হয় হত্যা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ঘৃণ্য রাজনীতি।

তাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন এমন একজন মহামানব যিনি ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে সারাটা জীবন বাঙালির মুক্তি-ভাবনা বুকে নিয়ে অবর্ণনীয় জেলজুলুম-কষ্ট-যাতনা-নির্যাতন সহ্য করেছেন, আর ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি থেকে শুরু করে ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত সময়ে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের সাত কোটি মানুষকে বাঁচানোর জন্য অনেকগুলো অভাবনীয় পদক্ষেপ নিয়ে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে তিনি যখন সৃষ্টির পতাকা উড্ডীন করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন এসব সহ্য হচ্ছিল না স্বাধীনতা-বিরোধী যড়যন্ত্রকারীদের। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত কোনো দেশেই স্বাধীনতার পর পর এতো অল্প সময়ে এতো বেশি উন্নয়নমূলক কর্মকাÐ সংঘটিত হয়নি। তিনি কী না করেছিলেন এদেশের জন্য? বাহাত্তরের ১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকেই শুরু হয় তার বিচক্ষণতায় ভরপুর রাজনৈতিক-কূটনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রচেষ্টা। ২৪ দিনের মাথায় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করে ১২ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ ভূখÐ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্য ফিরিয়ে নিতে সম্মত করান, যা ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। সাতচল্লিশ দিনের মাথায় সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) গিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে ডুবে যাওয়া জাহাজ আর পাকিস্তানি সৈন্যদের লুকিয়ে রাখা মাইন অপসারণে সে দেশের সাহায্য নিশ্চিত করেন। তাঁর আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক উদ্যোগের কারণে পরাজয়ের গøানিতে ডুবে থাকা পাকিস্তান ১৯৭৪-এর ২২ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। তারই একক প্রচেষ্টায় একই বছর ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ নবীন বাংলাদেশকে সদস্যভুক্ত করে নেয়। অনেক দেশের স্বীকৃতি আদায়সহ খুব অল্প সময়ে দেশের ভেতরে অনেক কিছু করেছেন তিনি তার কৌশলী নেতৃত্বের মাধ্যমে। মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানসহ তাদের কল্যাণের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণট্রাস্ট গঠন, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি, ১১ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন, ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্রিজ-কালভার্ট-রাস্তাঘাট-রেলপথ মেরামত করে ব্যবহারের উপযোগীকরণ, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নসহ প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন, সকল প্রাইমারি স্কুলে বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ, এগার হাজার প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা, চল্লিশ হাজার বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল সরকারিকরণ, ব্যাংক-বীমাসহ পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ৫৮০টি শিল্পকারখানা জাতীয়করণ, বন্ধ কলকারখানা চালু করে কর্মহীন মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাকরণ, রেসকোর্স ময়দানে ঘৌড়দৌড়-এর নামে জুয়ার বিস্তার আর হোটেল-ক্লাবে মদ্যপানসহ ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ নিষিদ্ধকরণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, এক বছরের মাথায় জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান, অর্থনৈতিক নীতিমালাকে ঢেলে সাজিয়ে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে দুর্নীতি দমনসহ সকল সেক্টরে উৎপাদন বৃদ্ধি, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং আরও অনেক কিছু। ২০১৮ সালের ১৪ জুলাই তাঁরই কন্যার হাতে যাত্রা শুরু হওয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের প্রথম উদ্যোক্তাও তিনি। তাঁর অবিশ্রান্ত উদ্যোগের ফলে দেশ যখন দ্রæত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখনই কুচক্রীরা তাদের ছোবলটি মারে বাংলার বুকে, ঠিক হৃৎপিন্ডের মধ্যখানে। তারপর শুরু হয় দেশটিকে পেছনে টেনে নিয়ে যাওয়ার অভিযান। রাজনীতি-অজ্ঞ ব্যক্তিরা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে হাত মিলিয়ে নতুন দেশটাকে টানতে থাকে শূন্যের দিকে। শুরু হয় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পাক-আমলের প্রতিক্রিয়াশীল ধারায় দেশটাকে ফিরিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা। স্বাধীনতার পরম শত্রæ রাজাকার-আলবদর বাহিনীর হোতারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গাড়িতে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে এর মর্যাদাকে করে ভূলুণ্ঠিত। অভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীতে সৃষ্টি হয় অস্থির অবস্থা, খাল খনন আর ছাগল প্রকল্পের নামে দেশটাকে পরিণত করা হয় হাস্যকর রাষ্ট্রে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে করে দেয়া হয় অকার্যকর, শুরু হয় শিক্ষাঙ্গনে অস্ত্রের ঝনঝনানি, মেধাবী ছাত্রদের হাতে তুলে দেয়া হয় বইয়ের বদলে মারণাস্ত্র, সেশনজটের কবলে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তুলে দেয়া হয় মাস্তানদের হাতে, শিক্ষানীতির অভাবে আর মিস্ম্যানেজমেন্টের কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় নেমে আসে ধ্বস, আর উন্নয়নের নামে শুরু হয় অর্থনৈতিক অরাজকতা, যার ফলে দেশবাসী দেখেছে বিদ্যুতের পরিবর্তে শুধু খাম্বা। গণতন্ত্রকে উর্দির ভেতরে বন্দি করে পরে ছেড়ে দেয়ার অভিনয় করা হয়েছে সেনানিবাসের ভেতরে দলছুটদের নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে। দেশের মানুষ মনের ভেতর কষ্টের পাহাড় জিঁইয়ে রেখে হৃদয় নিংড়ে ঢেলে দেয় বিন¤্র শ্রদ্ধা জাতির পিতার চরণে। মুছতে পারেনি তারা বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে। বরং ইতিহাস আরও বেশি বাঙময় হয়ে উঠেছে। এক মুজিব শহীদ হয়েছেন কিন্তু বাংলার হাজারো মুজিবের বুকে লুকিয়ে আছে অমর সেই এক মুজিব।

যে নামটি স্যাটেলাইটের বদৌলতে এখন আকাশের গায়ে সসম্মানে ঠাঁই নিয়েছে সে নামটি কি মুছে ফেলা সম্ভব? আমরা রাতের আকাশের তারায় খুঁজতে থাকি মহাকালের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে নামখোদিত বাঙালির মুক্তির দূতকে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের রূপকারকে, যিনি পূর্ববঙ্গের নিপীড়িত বাঙালিদের মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তেইশ বছরের লড়াকু জীবনকালে এক যুগেরও বেশি সময় ছিলেন পাকিস্তানি শাসকদের হাতে কারাবন্দি। আসুন, মুজিববর্ষে জাতির স্থপতিকে ধারণ করি আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায়, প্রোথিত করি অন্তরের অন্তঃস্থলে, অনুশীলন করি তাঁর আদর্শকে আর পথ চলি তাঁর রাজনৈতিক-সামাজিক শিষ্টাচারকে স্মরণে রেখে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট; উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বঙ্গবন্ধু

৮ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন