বিজয় দিবসের কবিতা
তুমি বাংলা ছাড়ো আবদুল হাই শিকদাররক্তচোখের আগুন মেখে ঝলসে যাওয়া আমার বছরগুলোআজকে যখন হাতের মুঠোয়কণ্ঠনালীর খুনপিয়াসী
মনিরুল বিয়ে করেনি- একথা পুরনো দু’একজন কলিগ ছাড়া আর কেউ জানে না। সে যখন বিয়ের জন্য ছুটি চাইল- অবাক কৌতূহল নিয়ে তাকাল সবাই- অফিসে অনেক দিন পর যেন একটা খবর তৈরি হল- খবরটা সবচেয়ে বেশি হতচকিত করেছে নতুন জয়েন করা কম্পিউটার অপারেটর মেয়েটিকে।
চেহারায় আদুরে মিষ্টতা ছড়ানো শ্যামলা মেয়েটি জয়েন করার পরদিন মনিরুলকে বলল, স্যার আমাকে একটু হেল্প করবেন- জানেন তো আজকাল নিজস্ব কম্পিউটার না থাকলে শুধু ইন্সটিটিউটে শিখে স্পিড তোলা যায় না- মাসখানেক লাগবে স্যার- আমাকে এই সময়টুকু হেল্প করবেন না স্যার- আমি তো আপনার মেয়ের মতই!
বিব্রত মনিরুল বলল, তাতো বটেই- তা তো বটেই-
মেয়েটি আশ্বস্ত হয়েছে- স্পিড নিয়ে টেনশন আপাতত কমল। মনিরুল ভেবেছে পুঁচকে মেয়েটা ভারী ফাজিল তো! এক কথায় বাবা বানিয়ে দিল। বলতে পারত- আমি তো আপনার বোনের মতই। ইচ্ছে করেই বলল না- আর বলবেই বা কী করে! ভাই-বোনের সম্পর্ক পাতাবার নিরাপদ সময় তো আর নেই। সময়টাই বিদ্ঘুটে রকমের অচেনা হয়ে পড়ছে- সম্পর্ক আর আচরণে কোন সঙ্গতি কোথাও নেই- সমাজে-পরিবারে এমনকি দাম্পত্যজীবনেও সঙ্গতিহীনতাই এখন যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। আজকাল রিকশাচালকরা আংকেল বলে- বাসের কন্ডাক্টররা বলে- মামু। আংকেল বলে সেকেলে ঠাওরানো আর মামু বলে বাবার সঙ্গে রসঘন সম্পর্কের ইঙ্গিত এক প্রকার অভ্যবতা হলেও এই সময় দু’টাই দিব্যি চালু হয়ে গেছে। মেয়েটি মনিরুলকে এসব কথা প্রথম মনে করিয়ে দেয় তা নয়- সে এরকম আরও অনেক কিছুই নিজের মত করে ভাবে। মনে করে সঙ্গতিহীনতার যত বিষয়-আশয় সব যেন তার জীবনের সঙ্গে একই সমতলে দাঁড়িয়ে- থেকে থেকে ঢুস মারছে।
মনিরুল আজ যখন ডিরেক্টরের কক্ষে ঢুকল তখন মেয়েটি শওকতের টেবিলে এসে বলল, স্যার একটু বসি-
শওকত অবাক- ওতো ইমপ্লিমেন্টেশন সেলে- ওই সেলের চার্জে তো মনিরুল।
বলল, কি ব্যাপার কিছু বলবেন?
মেয়েটি চেয়ারে বসে নিজেকে গুছিয়ে নিতে নিতে বলল, একটা কথা বলি স্যার-
শওকত বলল, ওহ সিওর-
মেয়েটি অবাক কণ্ঠে বলল, স্যার- মনিরুল স্যারের স্ত্রী মারা গেছেন, এটা কখনও শুনিনি- কবে মারা গেলেন- কি হয়েছিল-
শওকত গম্ভীর হয়ে গেল, মনিরুল সাবের স্ত্রী মারা গেছেন- মানে?
মেয়েটি বলল, তাহলে- স্যার যে বিয়ে করছেন!
শওকত বলল, মনিরুল সাবের স্ত্রী ছিল আপনি শুনেছেন এটা?
মেয়েটি ফিক করে হেসে ফেলল, এটা আবার শুনতে হয় স্যার!
শওকতের কণ্ঠ আরও গম্ভীর, কোন বিষয় না জেনেশুনে কিছু বলা ঠিক কি না- নিজের টেবিলে বসে ভাল করে ভাবুন আর নিজের কাজ করুন-
মেয়েটি থমকে গেল- শওকতও আর কিছু বলল না। সে সকাল থেকেই খানিকটা বিরক্ত। মনিরুল প্রথম যখন কথাটা তাকে বলল তখন যতটা গোপন সংবাদ ভেবেছিল অল্পক্ষণের মধ্যেই দেখল ততটাই প্রকাশ্য- এ যেন অনেকটাই দৈনিক পত্রিকার ব্যানার হেডিংয়ের মত। তার ধারণা হয়েছে মনিরুল একটা তামাশা শুরু করেছে। এই বয়সে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ে করার কোন অর্থ হয়! সে শুধু মনিরুলের কথা শুনে গেছে কিছু বলেনি।
রাশভারী ডিরেক্টরের চোখে-মুখেও কৌতুক ঢেউ খেলে গেল, গুড মনির সাব- জানেন তো লেট ইজ বেটার দ্যান নেভার- হা হা হা-
মনিরুল এই প্রথম এবং আচমকা লজ্জা পেয়ে গেল। সকাল থেকে শওকত আর ওই নতুন জয়েন করা মেয়েটি ছাড়া বাকি সবাই হৈ চৈ করে একটা আমুদে পরিবেশ তৈরি করে ফেলেছে- এর মধ্যে হঠাৎ হাত লেগে লজ্জা-ভর্তি দোয়াত থেকে বেশ খানিকটা গড়িয়ে পড়ে বিদ্ঘুটে যে অবয়ব ধারণ করল তাতে ডিরেক্টরের ‘লেট’ শব্দটা কিলবিল করছে। এই ইরেজি শব্দের মধ্যে একটা খোঁচা লকলকিয়ে ওর বুকের বাম পাশটায় হুল ফুটাচ্ছে।
মনিরুলের মনে পড়ে গেল : ক’দিন আগে ডিরেক্টর সাব এডিশনাল ডিরেক্টরের সঙ্গে ডিজি সাবকে নিয়ে কথা বলছিল। বলছিল লেট ম্যারিজ- বুঝেন তো বুড়ো বয়সে যুবতী স্ত্রী মানে- খালি হাত ফসকে গড়িয়ে পড়তে চায়- হাতের ঘের থেকে আমের সাইজ বড় হলে যা হয়- সামলান যায় না কিছুতেই-
মনিরুলেরও কী এরকম হবে- বউ নামের আমটা তার পৌরুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠবে আর সে সামলাতে পারবে না? এই ইঙ্গিতই কী-!
ডিরেক্টর সাব তার দরখাস্তে সই করে দিল- না দিয়ে উপায় কী! অফিসে সবচেয়ে কম ছুটি ভোগকারী অফিসার মনিরুল। ফাইলটা হাতে নিতে নিতে একটা ড্যামকেয়ার ভাব মনিরুলের ভেতর লকলকিয়ে উঠল : যাই ভাবুন আর যে ইঙ্গিতই দিন না কেন তাতে তার কিছু যায় আসে না। তার মনের হদিস তিনি পাবেন কি করে?
কাল রাতেই ভেবে রেখেছে আজ সারাদিন অফিসে হাসি-খুশি থাকবে। সবাই দেখুক-বুঝুক মনিরুল আনন্দ থই থই একটা ঘরের দরজা খুলতে যাচ্ছে- এ সময় হাসি-খুশি থাকতে হয়। ছোটবেলায় পড়া চিত্রালী পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে একটা প্রশ্ন এবং তার জবাব অনেকদিন পর কাল রাতে মনে পড়েছে। জনৈক পাঠক প্রশ্ন করেছিল- আচ্ছা বলুনতো কে বেশি সুখি- যে বিয়ে করেছে নাকি যে বিয়ে করেনি? জবাব দেয়া হয়েছিল- এদের কেউই সুখি নয় সুখি সে-ই যে বিয়ে করবে-করবে ভাবছে কিংবা বিয়ে করতে যাচ্ছে। মনিরুলকে এখন হাসি-খুশি থাকতে হবে- ডিরেক্টরের কক্ষে ঢোকার আগ পর্যন্ত সে তাই ছিল।
বাড়ি থেকে টেলিফোন পাওয়ার পর রাতে হঠাৎই কথাটা তার চিন্তার মধ্যে ঢুকে পড়ে- ঘণ্টা দু’য়েকের মধ্যে খবরটা তৈরি হয়ে যায়- আর ক’বছর পর সম্ভব হবে না- তখন বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। এখনও সম্ভব এ কারণে যে বয়সটা যত এগিয়েছে শরীরটা ঠিক তত এগোয়নি- সারাজীবনে এটাই একটা প্লাস পয়েন্ট তার। এটাও ডিজি অফিসের ইউডি রাহেলা আকতার গত বছর তার মগজে গেঁথে দেয়।
শওকত তখন চাপা হেসে বলেছে, রাহেলা ভালই জানে ব্যক্তিত্বহীন মানুষের চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে নাÑ
রাহেলা কবিতা লেখে তার স্বামীও কবি। দুই কবি তো আর এক ছাদের তলায় শান্তিতে বসবাস করতে পারে না। এই শ্রেণীর কবিরা শুধু প্রশংসা চায়Ñ খাতির চায়Ñ সেবা চায়Ñ দিতে পারে না কাউকে এসবের কিছুই! কাজেই বিরোধ অনিবার্যÑ রাহেলা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় মনের মত একটা ঘর গড়ে তোলার জন্য এই ঘরটা এবার সে ভাঙবেÑ ভেঙে ফেলবে। তার নজর পড়ে মনিরুলের ওপর যে অকাতরে নিজের যৌবনের মধু-সময়ের বেশ অনেকটুকুই বিলিয়ে দিয়েছে ভাইবোনের জন্য। ত্যাগের অনুশীলন আছে তারÑ বেশ ভালই আছে। এই লোকটার ওপর কেন আগে নজর পড়েনি এই দুঃখবোধ নিয়ে একটা চমৎকার কবিতা খাড়া করা যাবে!
মনিরুল ভেবেছিল বিয়ে এতদিন পরÑ তাই কবিবউ একটা বাড়তি অর্জনÑ রাজি হয়ে গেল। সে কী জানতো রাহেলার স্বামী বেচারাও রাজি হয়ে যাবেÑ কবিতা ছেড়ে দিতে!
ধাক্কাটা মনিরুলের বেশ কঠিনভাবেই লেগেছিলÑ রক্ষা জানাজানি হয়নি। হলে আজ যে খবর হয়েছে তার চেয়ে অনেক বড় খবর তাকে নিয়ে তখনই অফিসের চেয়ার-টেবিল-দেয়াল ছাপিয়ে বাইরে ছড়িয়ে যেত।
শওকত টের পেয়েছিল কিন্তু মুখ খুলেনি। আজ খবরটা প্রথম ফাঁস করে শওকতের কাছেই। শওকতই তার পুরনো কলিগÑ কয়েক বছর পর চাকরিতে ঢুকলেও বয়স তাদের কাছাকাছি। শওকত তার মত এইচএসসি পাস করেই ঢুকেনিÑ ঢুকেছে এমএ পাস করে। শওকতের বড় ছেলে মেলবোর্নে এমবিএ করতে গেল গত মাসেÑ মেয়ে মাস্টার্স করেছে বিয়েও ঠিক হয়ে আছে। ছেলের জন্য অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল বলে মেয়ের বিয়েটা ছ’মাস পিছিয়ে দিয়েছে। শওকত সবকিছুই খোলাখুলি বলে ওর সাথেÑ সাফল্যের কথা নির্ভরযোগ্য কাউকে না কাউকে মানুষ বলতে চায়। সবাইকে তো বলা যায় নাÑ অনেকে ঈর্ষান্বিত হয়Ñ অনেকে আবার আড়ালে হাসি-মশকরায়ও মেতে ওঠে। মনিরুল নির্ভরযোগ্যÑ যে কোন খবর গভীর মনোযোগে শোনেÑ তাল মেলায়Ñ কোন বেয়াড়া প্রশ্ন করে না।
শওকত বলে, জানিস আমার ছেলে কি বলে? বলে আব্বু তোমাদের কাল থেকে পৃথিবী অনেক এগিয়ে এসেছেÑ স্বামী-স্ত্রী দু’জনে চাকরি করবে এটাই এখন স্বাভাবিক। মা এসএসসি-এইচএসসি-বিএ-তে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েও হাউস ওয়াইফ হয়ে থাকল সারাজীবনÑ এটা ম্যানপাওয়ারের মিসইউজÑ
শুনতে শুনতে একেক সময় মনিরুলের মনে হতে থাকে শওকত তার বন্ধু নয় সিনিয়র কেউ! শওকত এগিয়েছে সে এগোয়নিÑ তার বয়স বাড়েনি। শওকতের ছেলেমেয়েরা যেমনটা ভাবছে মনিরুলও ঠিক তেমনটা ভাবতে পারে অনায়াসেই। শওকতের ছেলে বিয়ে নিয়ে-বউ নিয়ে ভাবছে। তার মধ্যেও তো এসব ভাবনা আছেÑ বহু বছরের পুরনো ভাবনা। ভেতরে ভেতরে এক সময় চমকে ওঠেÑ সামলে নেয় যাতে মুখে বেফাঁস কিছু বলে না বসে। আজকাল এ প্রশ্নটা তার বারবার মনে পড়ছেÑ বিয়ে না করলে সহজে কি ম্যাচিউরিটি আসে না?
লাঞ্চ আওয়ারে অফিস অনেকটা ফাঁকাÑ মনিরুল বসে বসে খরচপত্রের হিসাব করছে। ঘটক বলেছে বিদেশি কাপড়ের ভাল স্যুট-জুতা আর ঘড়িটা অরিজিনাল কেনার জন্য। সে নিজের স্যুটের দিকে তাকায় এখন আর পরা যায় নাÑ ফেড হতে হতে একদম বিবর্ণ। প্রতিবার ভাবেÑ শুধু ভাবেই স্যুট বানান আর হয় না। কাপড় যদিওবা হাজার বারোশ’য় পাওয়া যায় সেলাই আড়াই হাজার। বছর বছর স্যুট বানাবার লোকই আলাদা! সাধ-আহ্লাদে মনিরুল নিজেকে তাদের দলভুক্ত করেনিÑ তার কষ্টগুলো খুব শক্ত করে ছিপিমারাÑ খুবই সতর্কতার সাথে নাড়াচাড়া করে যাতে আবার আরব্য রজনীর ওই দৈত্যের মত বেরিয়ে পড়ে মনিরুলের এক চিলতে আকাশ ঢেকে না ফেলে।
লাঞ্চের পর মনিরুল নিজেকে নিয়ে মেতে থাকেÑ আচমকা কম্পিউটার অপারেটর মেয়েটি কক্ষের কোণে ছোট পার্টিশনে আড়াল-করা তার টেবিল ছেড়ে লঘু পায়ে এগিয়ে আসে।
চোখে-মুখে খুশির আভা ছড়িয়ে বলল, স্যার বিয়ের পর ঢাকায় নিয়ে আসবেন তো! আমরা স্যার একটা রিসিপশনের ব্যবস্থা করবÑ আপনি কিন্তু স্যার অমত করবেন না। আনন্দের ক্ষুদ্র সুযোগটিও আমাদের কাজে লাগান দরকারÑ স্যার আমাদের জীবনে আনন্দ ক্রমাগত সংকীর্ণ হয়ে আসছেÑ নেক্সট জেনারেশনে আনন্দ শব্দের ব্যবহার কী রূপ পাবেÑ কে জানেÑ
মনিরুল বিহŸল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল অনিকা শ্যামলীর মত অদ্ভুত নামের মেয়েটির দিকে। মনে হচ্ছে মেয়েটি স্বপ্নের মধ্যে কথা বলছেÑ অনেক পুরনো স্বপ্ন বলে মেয়েটির লাবণ্য অস্পষ্ট তবে ফিগারটা বোঝা যাচ্ছে। তার চোখের ভাষা ঘোলাটেÑ কষ্টের দ্বারা কলুষিত। মনিরুলের কষ্টের রূপটাও কী এরকম মাঝে-মধ্যে বেরিয়ে পড়ে যা সে নিজে দেখতে পায় না!
মনিরুল হাসল লজ্জার রঙ-মাখা আনন্দময় হাসিÑ বানান হাসি সশব্দ বা নি:শব্দ যাই হোক তার রঙটা হয় বেশ উজ্জ্বলÑ তার হাসির ঔজ্জল্যে শ্যামলীর হাসিও ঢেকে গেল।
আচমকা শ্যামলী বলল, স্যার চা খাবেনÑ আমি রঙ-চা নিয়ে আসিÑ দিই এক কাপÑ
মনিরুল চা খায়নি। হিসেব করা চা তারÑ অফিসে এসে-দুপুরে লাঞ্চের পর এবং বের হবার আগমুহূর্তে। শর্করা নয় তার সমস্যা অর্থকড়ির।
আজ মনিরুল একটু আগেই বের হল। কিছু কেনাকাটা করবে বাকিটা কাল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে করবেÑ ছুটি পরশু থেকে। বের হওয়ার সময় শওকতের সামনে গিয়ে বসল। শওকত ওর দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণÑ মনিরুলের ভেতরের কষ্টগুলো পাঠ করতে চাইল। ওর সমস্যাগুলো সব না হলেও কিছু কিছু তার জানাÑ এক সময় সে দু’কূল সামলাবার নানা রকম ফর্মুলাও দিয়েছে মনিরুলকে।
কয়েকদিন ভেবে-চিন্তে মনিরুল জানিয়েছে, নারেÑ হবে নাÑ কোন উপায় নেইÑ দু’কূল সামলান আসলে কোন কূলই না সামলাবার মতÑ
শওকত বলল, তোর একেবারে ছোট বোনটির তো বিয়ে হয়নিÑ
মনিরুলের নিরুদ্বেগ জবাব, হবেÑ
শওকতের কণ্ঠে কৌতূহল, হবেÑ মানেÑ
মনিরুল বলল, আগামী তিরিশে ওর বিয়েÑ
শওকত অবাক, তাহলে তোরÑ
মনিরুল উঠে পড়ল, চলি ভাই দোয়া করিসÑ
শওকতের বিস্মিত দৃষ্টির ফাঁক গলিয়ে মনিরুল বেরিয়ে এল অফিস থেকে ফুটপাতের জনারণ্যেÑ ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার ভেতর সে এক ধরণের নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততার বিরল স্পর্শ লাভ করে। এখানে কত কষ্ট-কত সুখ-কত শঠতা-কত সততা-কত ন্যায়নিষ্ঠা-কত ¯েœহপ্রীতি-কত হিং¯্রতা নীরবে-নি:শব্দে পাশাপাশি চলছে! মনিরুল বহু সময় ঢাকা নগরীর ব্যস্ত ফুটপাতগুলোতে অচেনা-অজানা মানুষের সাথে হেঁটে কাটিয়েছেÑ যতক্ষণ ফুটপাতে মানুষের মধ্যে থাকে ততক্ষণ নিরুদ্বেগ থাকে এবং এক রকম নিরাপত্তার বোধ তাকে ঘিরে থাকে। যেখানে অনেক মানুষ সেখানে শক্তি-সাহস-সততা-ন্যায়বোধ বিশাল ওই আকাশের মত ছায়া বিস্তার করে থাকেÑ
ফুটপাতে জনারণ্যে মিশে যাবার পর অনেকক্ষণ কেটে গেছেÑ আজ কেন নিজেকে জনতার অংশ মনে করতে পারছে না! দশজনের পায়ের তালে তালে পা ফেললেও মনে হচ্ছে সে যেন এই জন¯্রােতের বাইরে! এই অস্বস্তির বোধ কিছুতেই চাপা দিতে পারছে নাÑ অস্বস্তিটা গালিভারের মত তাকে হাতের তালুতে নিয়ে তীক্ষè দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছেÑ আলট্রাসনোর মনিটরে মনিরুলের ভেতরটা এখন চলমান দৃশ্যাবলী। সে চোখ বন্ধ করে ফেললÑ রমনা ভবনে বোনের বরের জন্য স্যুটের কাপড় কিনতে যাওয়ার কথা। কী করে সে চলে এল রমনা পার্কেÑ জনতায় নির্জনতা অনুসন্ধানে ব্যর্থ মনিরুল রমনার সবুজ প্রকৃতির ছায়ায় অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে এর জবাব খুঁজল।
বৈকালিক ভ্রমণকারী প্রৌঢ়দের হাতের ছড়ি ঘাসের ডগায় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে রেখে এগোচ্ছে। তারা জীবন নামক জাল সংসার-সাগরে ছুঁড়ে দিয়ে এখন গুটিয়ে এনেছেন। মনিরুলও একটা ছোট্ট জাল নিয়ে নেমেছিল জীবন-সাগরেÑ সেই জাল ছিঁড়েফেঁড়ে গেছে কবেই তার উপর গড়িয়ে গেছে কত অথৈই তরঙ্গÑ কত ব্যর্থতার কুঞ্চন-রেখাÑ
বিয়ে-সংসার পুরনো এই ভাবনা আবার ক্লান্ত অবসন্ন ডানা মেললÑ বিয়ে করতে যাচ্ছে বলে আজ যে খবরটা অফিসে ছড়িয়েছে তা এই ক্লান্তি ও অবসাদের ভেতর থেকেই কী উত্থিত হয়েছে? আগামী পরশু সর্বশেষ বোনটির বিয়ে হয়ে যাবার পর মনিরুল মুক্তÑ এই ছুটিতে না হোক আগামী ছুটিতে সে বিয়ে করবেÑ হয়ত করবে। দীর্ঘ অবদমনে তার বিয়ের আকাক্সক্ষা আজ বড় নড়বড়েÑ বড় শিথিলÑ শরীরের ভেতরকার কামনা-বাসনার মত!
পার্কের সবুজ সম্পন্ন গাছপালায় বিলি কেটে আচমকা এক ঝাপটা সতেজ বাতাস মনিরুলের সব গøানি ধুয়ে মুছে নিয়ে গেল। ছোট ভাই টেলিফোনে জানিয়েছেÑ অনেকদিন বাবার কবরটা অবহেলায়-অনাদরে পড়ে ছিলÑ এবার গ্রামের তরুণরা একটা সুন্দর বোর্ড লাগিয়ে দিয়েছেÑ
‘এই দেশকে ভালবেসে যাঁরা দিয়ে গেছেন প্রাণÑ তাঁদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোবিন বীরপ্রতীক এইখানে শায়িতÑ তিনি দেশ-মায়ের এই সেবার কোন বিনিময় গ্রহণ করেননিÑ তিনি অল্পে তুষ্ট ছিলেনÑ শেষ পর্যন্তও কষ্টকর জীবন লালন করে গেছেন.....’ এবার ডিসেম্বরের দুই তারিখে তারা স্মরণ সভারও আয়োজন করেছেÑ তুমি থাকলে ভাল লাগবেÑ মিনির বিয়ের জন্য ছুটিটা একটু বাড়িয়ে নিলেই হবে...’
রচনাকাল : ডিসেম্বর ২০০৫
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।