বিজয় দিবসের কবিতা
তুমি বাংলা ছাড়ো আবদুল হাই শিকদাররক্তচোখের আগুন মেখে ঝলসে যাওয়া আমার বছরগুলোআজকে যখন হাতের মুঠোয়কণ্ঠনালীর খুনপিয়াসী
দেশকে ভালবাসা মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি। সচেতন না থাকলেও এটা মানুষের হৃদয়ের গভীরে সুপ্ত থাকে। দেশের অপমান, দেশবাসীর দুঃখ-দৈন্যে, দেশের দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে কিংবা দেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হলে, দেশকে উপহাস বা কটাক্ষ করলে এ অনুভূতি জেগে উঠে। যেমন ১৯৭১ সালে এ দেশের হাজার হাজার তরুণ গেরিলা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে। প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল অকাতরে। দেশের মাটি ও মানুষের জন্যে গভীর মমতা না থাকলে এটা কোনদিন সম্ভব হতো না। মনীষী জ্যাকসন বলেছেন, ‘যে মায়ের সন্তান দেশের জন্যে জীবন দিয়েছে, তার মাতৃত্বের গৌরব চিরভাস্বর।’ দেশপ্রেম থাকা চাই বৈদেশিক আগ্রাসনকে প্রতিহত করার জন্যে। ইতিহাস বার বার এটাই প্রমাণ করেছে, একটা দেশপ্রেমিক জাতি শত্রুর কাছে কখনও পরাজিত হয় না। সে জাতির অন্তরে জ্বলতে থাকে দেশপ্রেমের আগুন অনির্বাণ শিখার ন্যায়। সারা পৃথিবীর মায়া-মমতা, স্নেহ সব একত্রিত করলেও যেমন মায়ের অকৃত্রিম স্নেহের সঙ্গে তুলনা করা যায় না তেমনি সারা পৃথিবীর ঐশ্বর্য-বৈভব ও সৌন্দর্যের সঙ্গে নিজ দেশের কোন তুলনা হতে পারে না। নবীশ্রেষ্ঠ হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, দেশপ্রেম ঈমানেরই অঙ্গ। মানুষ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েই তার আপন জীবনকে বিলিয়ে দিতে পারে। মহৎ প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আলিঙ্গন করতে পারে মৃত্যুকে। কবি বলেছেন, ‘তুমি দেশকে যথার্থ ভালবাস তার চরম পরীক্ষা, তুমি দেশের জন্য মরতে পার কি-না।’ কোথায় যেন পড়েছিলাম, ‘দেশপ্রেম বাইরের কোন প্রদর্শনীর বস্তু নয়, দেশপ্রেম মানুষের অন্তরস্থিত ভক্তি শ্রদ্ধায় গড়া। কবিতার কাব্যে, দেশকর্মী তার সমাজসেবায়, গায়ক তার গানে, শিল্পী তার ছবিতে, বৈজ্ঞানিক তার বিজ্ঞান চর্চায়, শিক্ষক তার একনিষ্ঠ শিক্ষকতায় দেশপ্রেমের পরিচয় প্রদান করতে পারেন।’ মনীষী ওয়ালেস রাইস বলেছেন, বুদ্ধিজীবীর কাছে তার দেশ ও সেবিকার কাছে তার রোগীর একই ভূমিকা হওয়া উচিত। শুধু সংগ্রামী রূপ ধারণ করেই আবির্ভূত হয় না দেশপ্রেম, সত্যিকার দেশপ্রেম হচ্ছে দেশকে গড়ে তোলার এক নিরন্তর সাধনা। দেশের সচেতন নাগরিকদের কারো অজানা নয় যে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করাটাই কঠিন। দেশকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলাটাই দেশবাসীর লক্ষ্য হওয়া উচিত। রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সাথে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বপ্নকে সফল করে তোলাও দেশপ্রেমিকের পবিত্র দায়িত্ব। মনীষী জিপি হল্যান্ডের ভাষায়, যদি মৃত্যুহীন হতে চাও তবে তোমাকে সৎভাবে দেশের জন্য কাজ করে যেতে হবে। মনীষী এডওয়ার্ড ইয়ং তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, দেশকে এবং দেশের মানুষকে ভালবাসতে পারলে জীবন সুখ ও শান্তিময় হয়ে ওঠে। দেশের প্রতি গভীর ভালবাসা, গভীর মমত্ববোধ থেকেই মনীষী সিডলী স্মিথ বলেছেন, আমি আমার নিজের দেশে দরিদ্র হিসেবে জীবন কাটাতে চাই, অন্য দেশে সম্পদশালী হয়ে জীবন কাটাতে আমি বিন্দুমাত্র আগ্রহী নই। দেশের প্রতি গভীর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই মনীষী পি জে বেইলির কথায়। তিনি বলেছেন, আমার দেশ আমার নিকট বড় এবং স্বাধীন দেশ আমার হৃদপিন্ডের মতো, আমার ঠোঁট তাই এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
একথাও সত্য যে, প্রকৃত দেশপ্রেমিক ব্যক্তি কখনও সংকীর্ণ মনের পরিচয় দিতে পারে না। নিজের দেশকে মনে প্রাণে ভালবাসা মানে অন্যদেশের প্রতি শত্রুতা নয়। কাজেই একজন দেশপ্রেমিককে সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে সহমর্মিতাবোধ জাগ্রত রেখেই নিজের দেশকে ভালবাসতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রকৃত দেশপ্রেম নিজের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে বৃহৎ পৃথিবীর মাঝে নিজকে ছড়িয়ে দেয়। মনীষী ডি স্টায়েল এর বানী হচ্ছে, ‘অন্যের দেশকে যত বেশি করে দেখা যায়, নিজের দেশের প্রতি মানুষের ভালবাসাটা ততই বেড়ে যায়।’ মনীষী জর্জ রোর ভাষায়, কখনো বিদেশ যায়নি সে কখনো দেশের মমত্ব বুঝতে পারে না।
একজন সাংবাদিক ও লেখক হিসেবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি যেভাবে তুলে ধরি না কেন, নৈতিক অবক্ষয় সর্বত্র হতাশা, অপহরণ, ছিনতাই, হত্যা, ধর্ষণ, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি নিয়ে যতই সোচ্চার হই না কেন, রাজনৈতিক দলগুলো যতই জনগণকে স্বপ্ন দেখাবার চেষ্টা করুক না কেন, নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক কিছু করার যতই আশ্বাস প্রদান করুক না কেন, তাতে আমরা আশার কোনো আলো দেখি না। আমাদের শঙ্কা রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরকে দোষারোপ করে কাঁদা ছোড়াছোড়ির মাধ্যমে আমাদের এ প্রিয় দেশের বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে। কারণ সত্যিকার অর্থে আমাদের মধ্যে দেশপ্রেমের বড়ই অভাব। আমার এ কথায় কেউ বা মনোক্ষুণœ হতে পারেন, কেউবা বলতে পারেন আমরা কি দেশকে ভালবাসি না? অবশ্যই আমরা সবাই দেশকে ভালবাসি। তবে দেশের প্রতি আমাদের ভালবাসাটা কেমন, কতটুকু তা একটু আলোচনা করলেই বুঝা যাবে। দেশের প্রতি আমাদের ভালবাসা রয়েছে এমন একটা মনোভাবকে হৃদয়ে ধারণ করেই আমরা দেশে বসবাস করি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে দেশের প্রতি আমাদের কোনও মমত্ববোধ আছে কি? আমরা কি দেশের উপকার-অপকার, লাভ-ক্ষতি, সুনাম-দুর্নাম, শত্রæ-মিত্র ইত্যাদি নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করি?
আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতি করি না এবং কোন উচ্চাভিলাষও আমার নেই। তবে আমি রাজনীতি সচেতন। এটা কারো অজানা নয়, বর্তমানে যারা সরকারি দলে তারা এক সময় বিরোধী দলে ছিলেন আর যারা বর্তমান বিরোধী দলে তারা ছিলেন সরকারি দলে। বর্তমান সরকারি দল ভবিষ্যতে হয়তো পুনরায় বিরোধী দলের ভূমিকা নিতে পারে এবং বর্তমান বিরোধী দলকে জনগণ হয়তো আবার সরকার গঠনের সুযোগ দিতে পারে। তাই ক্ষয়-ক্ষতির বর্ণনা কোন পক্ষ-বিপক্ষের হতে পারে না। তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা রাজনৈতিক অস্থিরতার মাধ্যমে দেশের বিপুল ক্ষতি সাধন হয় এ সত্যকেও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিতরা অনুধাবন করতে না পারলেও জ্ঞানীপাপীরা বুঝে না বুঝার ভান করলেও, রাজনীতিবিদরা এ বিপুল ক্ষয়-ক্ষতির গুরুত্ব প্রদান না করলেও, দেশের সচেতন নাগরিকরা বুঝতে পারে, যে কোন রাজনৈতিক দলের ধ্বংসাত্মক ও অপরিণামদর্শী কাজ অপূরণীয় ক্ষতি ছায়া দেশের কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। এ পরম সত্যটি আমাদের দেশের সর্বস্তরের জনগণ তখনই অনুধাবন করতে পারবে যখন তারা সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ হবে, দেশকে মনেপ্রাণে ভালবাসতে পারবে। মনীষী ব্রাউনিং বলেছেন, ‘একমাত্র নিজের দেশকেই অন্ধের মতো ভালবাসা যায়।’ মনীষী ভার্জিলের ভাষায়, ‘সে সবচেয়ে সুখী যে নিজের দেশকে স্বর্গের মতো ভালবাসে’। জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায়, ‘দেশকে ভাল না বাসলে তাকে ভাল করে জানার ধৈর্য থাকে না, আর, দেশকে না জানলে ভাল করতে চাইলেও ভাল করা যায় না।’
সফল কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদ হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এ নশ্বর পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছেন বেশ ক’বছর আগে। তিনি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। সেদিন এক লেখায় দেখলাম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সম্পর্কে লিখতে গিয়ে একজন লেখক একটি অংশে উল্লেখ করেছেন, চৌধুরী সাহেব যখন জীবিত ছিলেন তখন তিনি প্রচুর সভা সমিতিতে যেতেন। অনেক সময় জনগণের চাপে বাধ্য হয়েই যেতে হতো। প্রতিটি অনুষ্ঠানেই তিনি বলতেন কম, শুনতেন বেশি। আর অল্প কথায় যা বলতেন, তা ছিল মাস্টারপিস। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অথবা গবেষণাধর্মী কোনো প্রতিষ্ঠানে গেলে তিনি মানুষ হওয়ার কথা বলতেন, শেকড়ের উৎস খুঁজতে বলতেন, আর বলতেন দেশকে ভালবাসতে। চৌধুরী সাহেব সম্পর্কে লেখার এ অংশটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল চমৎকার। তিনি আমাকে ভালবাসতেন, আদর করতেন; আমিও তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা করতাম। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি প্রায়ই দেশের সার্বিক হাল-অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতেন। উন্নয়নের কথা বলতেন। তার মধ্যে সত্যি সত্যি দেশপ্রেম ছিল, যা আমি অন্তর দিয়ে অনুভব করতে সক্ষম হয়েছি। আজকাল দেশকে ভালবাসার প্রতি কাউকে উৎসাহিত অনুপ্রেণিত করতে দেখি না। রাজনীতিবিদরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের দলের কথা বলেন। গুণকীর্তন করতে থাকেন তাদের দলনেতার। স্কুল, কলেজে যদিও দেশপ্রেমের উপর ছাত্র-ছাত্রীদের রচনা লিখতে বলা হয় তা শুধু লেখার জন্য লেখা। গ্রোথিত হয় না। শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের নয়, দেশপ্রেম আমাদের কারো মনকে নাড়া দেয় না। দেশের প্রতি মমত্ববোধ আমাদের আবেগপ্রবণ করে না। আমাদের দেশে আজ চৌধুরী সাহেবের মতো লোকের বড় বেশি প্রয়োজন অনুভব করি। তিনি সব সময়ই আমাদেরকে দেশের প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত করার কথা বলতেন। ছাত্র-ছাত্রীদের রাজনীতি না করে নিজেদের পড়াশুনায় মনোনিবেশ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশ গড়ার পরামর্শ দিতেন। দেশকে ভালবাসার কথা বলতেন, আমাদেরকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার উপদেশ দিতেন, আমাদের মনুষ্যত্ববোধকে জাগিয়ে তোলার কথা বলতেন।
দেশের উপকারে যিনি নিবেদিত প্রাণ তিনিই প্রকৃত মানুষ। পক্ষান্তরে দেশপ্রেমহীন আত্মকেন্দ্রিক যিনি, তিনি নিঃসন্দেহে অধমের সমান। সমাজ জীবনে প্রতিনিয়ত এহেন মূর্খের মতো বিবেকবর্জিত অমানুষ দেখতেন বলেই হয়তো দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ আমাদের পূর্বসুরি রাজনৈতিক নেতারা প্রথমে মানুষ হওয়ার কথাই বলতেন। কিন্তু সে আদর্শবান পুরুষ বা রাজনৈতিক নেতা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। তাই তাঁদের মূল্যবান কথাগুলো স্মরণীয় ও বরণীয় বাণীতে পরিণত হয়েছে। আমরা সবাই নিজেদের যতই লেখক, জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক বা সচেতন নাগরিক হিসাবে দাবি করি না কেন, আমাদের উচিত হবে আমাদের চিন্তা-চেতনায় সে সব ব্যক্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখা, তাঁদেরকে স্মরণ করা।
দেশের সদাপ্রহরী হচ্ছে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রাজনীতিবিদরা। রাজনীতিবিদদের প্রথম এবং প্রধান শর্তই হল দেশপ্রেম। আমাদের দেশে বিভিন্ন দলের অনেক রাজনীতিবিদরা মহত্তর, বৃহত্তর কল্যাণ বোধ থেকে ভ্রষ্ট। দেশের রাজনীতিবিদদের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় স্বার্থই প্রধান হয়ে দেখা দেয়। দেশের সকল রাজনীতিবিদকে কথায় ও কাজে সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমিক হতে হবে। রাজনীতিবিদদের সার্বিক কর্মকান্ডের উপরেই এ দেশের ভবিষ্যত নির্ভরশীল। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি রাজনীতিতে ব্যবসা বা পেশা হিসাবে নয়, সেবা হিসাবে নিতে পারলেই দেশের বর্তমান ভয়াবহ অবস্থার অবসান হবে। দেশের মঙ্গলে দেশের সকল নাগরিকেরও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। দেশকে প্রাণাধিক ভালবাসতে হবে এবং শুধু ভালবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবেনা, দেশ সেবায় ব্রতী হতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।