Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে রাজনৈতিক সমঝোতা জাতীয় ঐক্য এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ একটি বিস্ময়ের নাম। একটি অস্বাভাবিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের সময় ধর্মের ভিত্তিতে বৃহৎ বাংলাকে ভাগ করে অর্ধেক পাকিস্তানের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছিল। এর প্রায় চার দশক আগে ১৯০৫ সালে প্রশাসনিক সুবিধার্থে ঢাকাকে রাজধানী করে আসামসহ পূর্ব বাংলাকে আলাদা প্রদেশের মর্যাদা দিয়েছিল বৃটিশ সরকার। কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকরা ‘বঙ্গভঙ্গ’ মেনে না নিয়ে একটি প্রবল আবেগী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করেছিল। ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি নিয়ে ভারত শাসন করা বৃটিশরা ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর দাবি মেনে নিয়ে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করে দেয়। বঙ্গ মায়ের অঙ্গহানির কষ্ট তাদের লাঘব হলেও পিছিয়ে পড়া অবহেলিত পূর্ব বাংলার উন্নয়নের সম্ভাবনা আবারো থমকে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নতুন বিশ্বরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য দেশভাগ পরিকল্পনার শুরুতেই ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব অনুসারে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেশভাগের প্রস্তাব উঠে আসে। প্রথমত বাংলাকে অবিভক্ত রাখার ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্পিরিট এবং দ্বিতীয়ত: লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাবকে সামনে রেখে ভারত ভাগের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলা অখন্ড বা অবিভক্ত রাখাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ১৯৪৭ সালে এসে পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের বঙ্গভঙ্গের চেতনা পুরোপুরি উল্টে গিয়েছিল। এ সময় তারা বাংলাকে ভাগ করে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গকে ভারতীয় ইউনিয়নভুক্ত করার অনড় অবস্থান নিশ্চিত করেছিল। তা নাহলে, অবিভক্ত বাংলা হয়তো ভারতীয় উপমহাদেশের সবেচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে পারতো। বৃটিশ-ভারতের ডেমোগ্রাফিক বাস্তবতায় সীমান্ত অঞ্চলগুলোর মানুষের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা না ভেবে বৃটিশ আইনবিদ স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফ টেবিলে বসে যে সীমারেখা এঁকেছিলেন তা ভারতীয় উপমহাদেশে একটি স্থায়ী অনাস্থা ও অবিশ্বাসের বীজ বপণ করেছিল। রেডক্লিফ লাইনে একদিকে বাংলা অন্যদিকে পাঞ্জাব ও বেলুচিস্তানকে এমনভাবে ভাগ করা হয়েছিল যা’ অবাস্তব এবং দুই স্বাধীন রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রে আত্মঘাতী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মাউন্টব্যাটন ও র‌্যাডক্লিফের পরিকল্পনার ধারাবাহিকতায় ভারতের পরবর্তী রাজনৈতিক উত্তরসুরিরা কাশ্মীর, হায়দারাবাদ ও সিকিমের স্বাধীনতা হরণ করে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক সংকটকে আরো জটিল করে তুলেছেন।

বৃটিশদের হাতে ১৯০৫ সালে পূর্ববাংলা ও আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ সৃষ্টির পর বাংলার রাজনীতিতে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। বাংলাকে ভাগ করার বেদনায় অতি কাতর কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী সমাজ এ বিষয়ে এত বেশি প্রতিক্রিয়া ও হইচই সৃষ্টি করেছিলেন যে, অবহেলিত পশ্চাৎপদ পূর্ববাংলার উন্নয়নের সম্ভাবনার প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের নাম দিলেন ‘বঙ্গভঙ্গ’। তাদের আন্দোলনের মুখে ৫ বছরের মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রিক নতুন প্রদেশের যাত্রা রদ করতে বাধ্য হন বৃটিশ সরকার। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রতিক্রিয়া এত বেশি ছিল যে, ভারতের আধুনিক ইতিহাসে খন্ডকালীন ‘বেঙ্গল পার্টিশন’ অন্যতম আলোচ্য ও চর্চিত বিষয়ে পরিনত হয়েছিল। তবে ১৯৪৭ সালে এসে তাদের সুর আমূল পাল্টে যাওয়ার বাস্তবতা ছিল বিস্ময়কর। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিনদের নেতৃত্বে অখন্ড বাংলার রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মুসলমান নেতৃত্ব যখন ক্রমে শক্তিশালী হতে শুরু করেছে তখন কলকাতাকেন্দ্রিক একশ্রেণীর রাজনীতিকের সুর এমন ছিল যে, আর কিছু ভাগ হোক বা না হোক বাংলাকে ভাগ করেতেই হবে। তারা তখন ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাংলাকে অখন্ড রাখার ঘোর বিরোধী। কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা বাংলা ভাগের যুক্তিকে অকাট্য ও অবসম্ভাবী করে তুলেছিল। পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত না করে আসামসহ অখন্ড দুই বাংলাকে নিয়ে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তা উপমহাদেশের অন্যতম শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রশক্তি যে হয়ে উঠতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতায় সে সম্ভাবনাকেই বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়।

সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পূর্ববাংলার ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে পশ্চিমপাকিস্তানী রাজনীতিকদের অসহিষ্ণুতা ও সীমিত জ্ঞানের কারণে এবং ১৯৫৬ সালে পূর্ববাংলা পাকিস্তানের সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার পর থেকেই ভেতরে ভেতরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙ্গালী জাতির হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন। তবে এর পেছনে ভারতের ভূমিকাকে শুধু সরলীকৃত মানবিক বিষয় হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। একাত্তুরের স্বাধীনতাযুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং আত্মত্যাগের অবদানকে আমরা নি:সন্দেহে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। তবে ভারতীয় উপমহাদেশের সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং একটি আত্মমর্যাদাশীল ও সম্ভাবনাময় স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক বিবর্তনের পশ্চাদপট ও ভারতীয় শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দূরভিসন্ধির প্রেক্ষাপটকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পনের ঘটনাবলী, বাহাত্তুরের সংবিধান এবং তিয়াত্তুর-চুয়াত্তুরের দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু এবং গত সাড়ে চার দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বির্বতন, ফারাক্কা ব্যারাজ, তিস্তা ব্যারাজ, ভারতের সাথে অসম বন্ধুত্ব, সীমান্তে বিএসএফ’র হত্যাকান্ড, মাদক চোরাচালান এবং বছরে অর্ধলক্ষ কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য বৈষম্য যেন সেই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দুরভিসন্ধিরই বাস্তব রূপায়ণ। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী, স্বাধীন স্বাবলম্বী আত্মনির্ভর ও আত্মমর্যাদাশীল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কখনোই ভারতের প্রত্যাশিত নয়।

তিস্তার পানিচুক্তি, যৌথ নদী কমিশন, সীমান্ত হত্যাকান্ড, চোরাচালান, বাণিজ্যবৈষম্য, নাগরিকত্ব ইস্যুতে লাখ লাখ ভারতীয় মুসলমান নাগরিককে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি এবং রোহিঙ্গা সংকটসহ বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক সমস্যা নিয়ে ভারতের সাম্প্রতিক ভূমিকা থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে।

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের বিশাল ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে পানিসীমা নিস্পত্তির পর বঙ্গোপসাগরের মৎস্য সম্পদসহ ব্লু-ইকোনমির সম্ভাবনা বাঁচিয়ে রাখা আমাদের রাষ্ট্র তথা নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পর্যাপ্ত নজরদারি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় দশকের পর দশক ধরে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশী জেলেরা প্রতিদিনই ভারতীয় ও মিয়ানমারের জলদস্যুদের হাতে লুন্ঠিত ও হতাহত হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকটে চীন সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করলেও ব্লু-ইকোনমির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তার জন্য চীন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। ২০১৮ সালে চীন সরকার দু’টি সাবমেরিন উপহার দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে একটি ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে পরিনত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করলেও ভারত এটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। তখন ভারতীয় গণমাধ্যম ও রাজনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়া থেকে আমাদের মনে হয়েছে, বাংলাদেশকে তারা বৈরী প্রতিপক্ষ মনে করে। এর প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারকে সাবমেরিন উপহার দেয় ভারত। ভারতীয়রা বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বের অনন্য উচ্চতার দাবি করলেও জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সংকটের ভোটাভুটিতে ভারত কখনোই বাংলাদেশকে ভোট দেয়নি। আমাদের সরকারি দলের রাজনীতিকরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও রোহিঙ্গা সংকটে পাকিস্তান সব সময়ই বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক পেরিয়ে এসে এটাই হচ্ছে ভারত-পাকিস্তানের আঞ্চলিক বাস্তবতা।

১৯৪৭ সালে এসে ভারতীয় রাজনীবিদরা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়ে বাংলা ভাগ পূর্বাংশ পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করতে কণ্ঠিত হয়নি। এর ২৩ বছরের মাথায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে দাঁড়ালেও শত বছরের ভৌগলিক ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহ্য সত্ত্বেও কাশ্মিরের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারত পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করেছে। ভারতের স্বাধীনতার সাত দশক পেরিয়ে এসে সংবিধানের ৩৫-এ বং ৩৭০ ধারা রদ করে কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন ও বিশেষ মর্যাদা হরণ করা হয়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, কাশ্মিরীরা মুসলমান। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, পাকিস্তান আন্দোলনের ঢামাঢোলে পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অংশে পরিনত না হলে কাশ্মীর বা হায়দারাবাদের মত বাংলাদেশ কখনোই হয়তো ভারতের থাবা থেকে বের হতে পারত না। ডিভাইড অ্যান্ড অক্যুপাই, শত্রুর শত্রু মিত্র ফর্মুলায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত তার শক্তি বিস্তার করলেও স্বাধীনতার পর থেকে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদাশীল জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হয়ে ওঠার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছে। এতকিছুর পরও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা রোধ করা যাচ্ছে না। এখন লাখ লাখ ভারতীয় বাংলাদেশের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে কাজ করে শত শত কোটি ডলার দেশে পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশের মেডিকেল ট্যুরিস্টদের উপর নির্ভর করে ভারতের স্বাস্থ্যখাতের বিশাল বিনিয়োগ ও অবকাঠামো টিকে আছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে প্রাপ্ত রেমিটেন্স ভারতের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। বিশ্বের শতাধিক দেশ থেকে ভারত রেমিটেন্স আয় করলেও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে আয় আমেরিকা বা ইউরোপের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। এতকিছুর পরও ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকরা বাংলাদেশকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, হেয় করে ও হুমকি দিয়ে কথা বলতে দ্বিধা করে না। কিন্তু আমাদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতারা শুধুমাত্র দলীয় রাজনীতির স্বার্থে এসব বিষয়ে প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া থেকে বিরত থাকে।

আজ ২০২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ৪৯তম বিজয় দিবর উদযাপন করছি। আর মাত্র ১৪ দিন পরেই আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বর্ষে পদার্পণ করতে চলেছি। এখন আর রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরের সময় নয় এখন সময় হচ্ছে হিসাব মেলাবার। স্বাধীনতার প্রত্যাশা, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি- মুক্তি ও বঞ্চনার হিসাব মেলাতে চায় জাতি। সেই আত্মজিজ্ঞাসা ও লক্ষ্য অর্জনে নতুন গতিপথ নির্ধারণের অবশ্যম্ভাবী সময় এখন। ইতিহাসের গতিপথ এবং আমাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতার শত্রæমিত্র চিহ্নিত করতে না পারলে পূর্বপুরুষের রক্ত-ঘামে কেনা সব অর্জন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিফল হতে পারে। আমরা একাত্তুর সালের স্নায়ুযুদ্ধের সময়কে অতিক্রম করে এক নতুন বিশ্ব বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। বিংশ শতকের একাত্তুর সালের পর উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান মুখোমুখী দাঁড়িয়ে এশিয়ার অন্যতম পারমানবিক পরাশক্তিতে পরিনত হয়েছে। চীন-জাপানের কথা বাদ দিলেও রাজনৈতিক অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সমান্তরালে থাকা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম অর্থনৈতিকভাবে বহুদূর এগিয়ে গেছে। কার স্বার্থে কার প্ররোচনায় আমরা এখনো অতীতমুখী অপরাজনীতির চক্রে ফেলে রাজনৈতিকভাবে জাতিকে দুর্বল ও ক্ষণভঙ্গুর করে তুলছি? এ প্রশ্নের জবাব এখন আর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। জনগণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই জাতি একাত্তুরে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সুশাসন, জননিরাপত্তা, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে লাখো মানুষের রক্তের ঋণে অর্জিত কায়েমি স্বার্থবাদিতার দুর্নীতি-দু:শাসনের থাবার নিচে আবদ্ধ থাকা রাজনৈতিক স্বাধীনতা শেষ পর্যন্ত অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে আমরা কি একটি অর্থবহ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারব?

গত ৪৯ বছরে বাংলাদেশ তার প্রতিদ্বদ্বী ও প্রতিবেশিদের চেয়ে অনেকে ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়লেও অনেক সম্ভাবনাকে এখনো টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। শত প্রকিকুলতা সত্তে¡ও এটা আমাদের জন্য অনেক বড় স্বস্তি ও প্রেরণার উৎস। আমরা যদি শোষনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে পাশ কাটিয়ে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফিরিস্তি টেনে ব্যর্থতাগুলোকে ঢেকে রাখতে চাই এবং আত্মপ্রসাদের ডুগডুগি বাজাতে থাকি, তাহলে আমরা জনগণের প্রত্যাশিত উন্নয়ন ও স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকে আরো দূরে সরে যেতে থাকব। একটা উন্নয়নশীল জাতির জন্য এটা অনেক বড় আত্মঘাতী প্রবণতা। আত্মসমালোচনাসহ জাতির উন্নয়ন ও বিকাশের সঠিক গাইডলাইন নির্ধারণের সময়টিকে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে হানিকর বিভক্তি ও সংঘাতের পথে জাতির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। স্বাধীনতা অর্ধশতক পর আমরা যখন আত্মসমালোচনা করব তখন দেখছি দেশের ক্ষমতাসীন মহল তথাকথিত উন্নয়নের ঢোল বাজিয়ে চলেছে। পক্ষান্তরে সাংবিধানিকভাবে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকলেও কার্যত সরকারের কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেই। আমরা দেখছি, গণতন্ত্র, সুশাসন, বাণিজ্য সক্ষমতা, শিক্ষার মান, সামাজিক নিরাপত্তা, পরিবেশগত সুরক্ষা, বায়ু-পানিদূষণ, জনস্বাস্থ্য, রাজধানী শহরের বাসযোগ্যতার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে বৈশ্বিক মানদন্ডে বাংলাদেশের ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ার দৃশ্যপট। গতমাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশনের (এমসিসি) ২০২০-২১ সালের জরিপে দুর্নীতি ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ২০টি সূচকে ১৩টিতেই রেডজোনে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। সুশাসন ও উন্নয়ন কর্মদন্ডের এ জরিপ সংস্থার বিশাল ফান্ড রয়েছে। এসব মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে পারলেই কেবল কোনো দেশ এ তহবিলের অর্থসহায়তা পেতে পারে। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের আমেরিকা উইংয়ের যুগ্ম সচিব কবীর আহমেদ বলেছেন, এমসিসি ফান্ড থেকে তহবিল পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু সূচকে উন্নতি করা যায়নি বলে ফান্ড পাওয়া যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৭-১৮ সালে এমসিসি জরিপে বাংলাদেশ ৭টি সূচকে রেডজোনে ছিল, ২০১৮-১৯ সালে ১১টিতে এবং ২০১৯-২০ সালে ১২টি সূচকে রেডজোনে ছিল বাংলাদেশ। এর মানে দাঁড়াচ্ছে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অধিকারের সূচকে গত ৪ বছরে বাংলাদেশের ক্রমশ অবনতি ঘটেছে। তিনদিন আগে জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনডিপি) ও মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে(নলেজ ইনডেক্স) বিশ্বের ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনি্ম্ন অবস্থান। এ সূচকে ভারতের অবস্থান ৭৫তম। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল ও ভূটানের চেয়েও জ্ঞান সূচকে ১৭ কোটি মানুষের সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের এমন পিছিয়ে থাকার বাস্তবতা খুবই দু:খজনক। আমরা আগামী দশকের শেষে একটি উন্নত আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। সেখানে দুর্নীতি-লুটপাট, সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, শিক্ষা ও সুশাসনের সব মানদন্ডে বৈশ্বিক তো বটেই, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশিদের চেয়েও পিছিয়ে পড়ার যে চিত্র বিশ্বের সামনে ধরা পড়ছে তা’ জাতি হিসেবে আমাদের আত্মনির্ভরশীলতা ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নে অত্যন্ত গøানিকর। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎযাপনের আগে আমাদেরকে এসব বিষয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
[email protected]

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বাধীনতা


আরও
আরও পড়ুন