Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরী স্মরণ এপিটাফ : জানি ফাগুন আমায় ভালোবাসে না

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ১:২২ পিএম

"তারে বলে দিও
সে যেন আসে না আমার দ্বারে
তারে বলে দিও...
ওই গুণ গুণ সুরে মন হাসে না...
জানি ফাগুন আমায় ভালোবাসে না...।"
একজন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টলবীর।
কখনো সখনো অবসরে গুণ গুণ করে এ গানটি গাইতে শুনতাম তার কণ্ঠে। সাথে স্মিত হাসি। কোনও অনুষ্ঠান হলে হেমন্তের এই গানটি শোনানোর জন্য শিল্পীকে চিরকুট লিখে ফরমায়েশ দিতেন। বেশ কতকবার শুনে ধরেই নিয়েছি এটা তার বিশেষ পছন্দনীয় গান। কিন্তু কেন? কোথাও কোন মান অভিমান? অপ্রাপ্তি?
না। একদম জবাব দিতেই চাননি। রহস্যই রয়ে গেলো। আরেকটি প্রশ্নের জবাব খুঁজতে চেয়ে বিফল হয়েছি, মন্ত্রী মিনিস্টার হওয়ার ডাক পেয়েও অফার ফিরিয়ে দিলেন কেন? শুধুই বলতেন, আমি চাটগাঁর মানুষের পাশে জীবনভর থাকতে চাই। আমি মন্ত্রী হলেও কী আর না হলেও কী?
ঠিক তাই হয়েছে। চাটগাঁবাসীর মাঝে থেকেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি অতিবাহিত করেছেন। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবসের ঠিক আগের দিনেই পৃথিবীর সকল মায়া ছিন্ন করে গেছেন। চট্টগ্রামের একটি ক্লিনিকে ইন্তেকাল করেন তিনি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। রাজনীতিরও বীর পুরুষ। বিপ্লবী নেতা। চাটগাঁ দরদী। ইসলাম দরদী। আলেম-ওলামা মাশায়েখদের অভিভাবক পৃষ্ঠপোষক। সংখ্যালঘুদেরও কাছেও ছিলেন আস্থাভাজন।
চট্টগ্রাম নগরের চশমা হিলের বাড়িটার লম্বা বৈঠকখানায় এখনও যেন দিলখোলা হাসিতে সরস আলাপে আড্ডায় মগ্ন আছেন মানুষটি। আড্ডায় আড্ডায় বেলা গড়িয়ে দুপুর। নাছোড়বান্দা মানুষটি। ভাত না খেয়ে ওঠার সাহস ও সাধ্য কারো নেই! বিকালের আড্ডায় রাত। তখনও সেই মেজ্জাইন্না খানাপিনা। গরুর গোশত, নলাকাঁজি, মাছ, ঝোল, ছোলার ডাল কত কী পদের রান্নাবাড়া চলে দিলভর। আড্ডায় জড়ো হওয়া মানুষগুলোর রাজনৈতিক পরিচয় কারো আছে, কারও নেই। ওদের বড় পরিচয় 'মানুষজাতি'।
'জন্মিলে মরিতে হইবে'। এই অমোঘ সত্যের কাছেই হার মেনে চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী 'নাই' হয়ে গেছেন। চোখের পলকেই যেন তিনটি বছর ঘুরে এসে আজ মঙ্গলবার তার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের আমৃত্যু সভাপতি, তিন তিনবার নির্বাচিত সফল চট্টগ্রাম সিটি মেয়র, অসম তেজস্বী রাজনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা, চাটগাঁর উন্নয়ন, চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা ও উন্নয়নের আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। মার্কিন কোম্পানি এসএসএ'র কব্জায় বিকল্প বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে তিনি জানবাজি করে রাজপথ কাঁপানো আন্দোলন এমনকি সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করে সফল হন।
বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে হজ্ব পালনের সূচনা তারই গড়া মেয়র হজ কাফেলার হাত ধরে। তিনি মেয়র থাকাকালে মসজিদ এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করেন।
মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের স্বার্থের প্রশ্নে আপসহীন আজীবন সংগ্রামী। দলমতের সংকীর্ণ গণ্ডির ঊর্ধ্বে উঠে সমগ্র চট্টগ্রামবাসী এমনকি দেশবাসীর হৃদয়ে সম্মান ও ভালেবাসার স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি। তার চশমা হিলের বাড়িটার দরজা ছিল সবার জন্য খোলা। সেই বাড়িতে চসিকের সুইপার তথা সেবকের মেয়ের বিয়ের আয়োজনও করেন তিনি। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বারবার কারাবরণ করেন। তবে অন্যায়ের কাছে কখনওই মাথা নত করেননি। এ কথাটা তিনি প্রায়ই বলতেন- আমি মহিউদ্দিন চৌধুরী জীবিত থাকতে জনগণের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেবোনা, সে যতই শক্তিশালী হোক। চট্টগ্রামে তার নেতৃত্বেই সর্বপ্রথম সূচনা হয় 'মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা'। যা পরবর্তী সময়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা, মসজিদে গাউসুল আজমের প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশ জামিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি আলহাজ্ব হযরত মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.), ইনকিলাব সম্পাদক ও বাংলাদেশ জামিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি এ এম এম বাহাউদ্দীন-এর সাথে সাবেক সফল সিটি মেয়র চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অত্যন্ত আন্তরিক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তার অসুস্থাবস্থা, কারাবরণ, প্রাণাধিক কন্যা টুম্পার অকাল মৃত্যুসহ বিভিন্ন সময়ে, সুখেদুঃখে ইনকিলাব সম্পাদক খোঁজখবর নিয়েছেন। আবার ইনকিলাবের বিভিন্ন সুখেদুঃখে ও কঠিন সময়েও তিনি ছিলেন অকৃত্রিম শুভাকাঙ্ক্ষী। চট্টগ্রাম ব্যুরো অফিসে ছুটে আসেন সবান্ধবে। মহিউদ্দিন চৌধুরী সবসময়ই ছিলেন সাংবাদিক-বান্ধব হিসেবে অতুলনীয়। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকগণ পেশাগত দায়িত্ব পালনে একটিবারও যদি তার কাছে গিয়েছেন, চিরতরে বন্ধু হয়ে উঠেন। তার সামাজিকতার গুণাবলী বিরল।
চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন চট্টগ্রাম নগর মহিলা লীগের সভানেত্রী। তার সুযোগ্য বড় ছেলে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল নগরীর কেন্দ্রীয় আসন চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য।
চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালন উপলক্ষে আজ নগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে মরহুমের কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ, খতমে কোরআন, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
তার প্রতিষ্ঠিত প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির অডিটরিয়ামে মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে।
নগরের বিভিন্ন থানা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদসহ প্রগতিশীল সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে পৃথক পৃথক কর্মসূচি পালন করছে। অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগে খতমে কোরআন, ফাতেহা, মিলাদ, তবররক বিতরণসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে।
১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর রাউজানের গহিরা গ্রামে সম্ভ্রান্ত বক্স আলী চৌধুরী পরিবারে জন্ম নেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। বাবা রেল কর্মকর্তা হোসেন আহমদ চৌধুরী এবং মা বেদুরা বেগম।
ছাত্রাবস্থাতেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৯৬২ সালে এসএসসি, ১৯৬৫ সালে এইচএসসি এবং ১৯৬৭ সালে ডিগ্রি পাস করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে এবং পরে আইন কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
পরিশেষে চট্টলবীরের বিশেষ প্রিয়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কালজয়ী গানটি দিয়েই এই আলেখ্যটি শেষ করছি:
"তারে বলে দিও,
সে যেন আসে না আমার দ্বারে,
তারে বলে দিও,
সে যেন আসে না আমার দ্বারে
তারে বলে দিও।
ওই গুন গুন সুরে মন হাসে না,
ওই গুন গুন সুরে মন হাসে না
তারে বলে দিও
সে যেন আসে না আমার দ্বারে
তারে বলে দিও।।
ওই ফুল মালা দিল শুধু জ্বালা
ধূলায় সে যাক ঝরে যাক না,
এই ভাঙা বাঁশি ভোলে যদি হাসি
ব্যথায় সে থাক ভরে থাক না।
জানি ফাগুণ আমায় ভালবাসে না
জানি ফাগুণ আমায় ভালবাসে না
তারে বলে দিও,
সে যেন আসে না আমার দ্বারে
তারে বলে দিও।
তারে বলে দিও, সে যেন আসে না
তারে বলে দিও, মন কেন হাসেনা,
তারে বলে দিও,
সে যেন আসে না আমার দ্বারে
তারে বলে দিও।
নেই আলো চাঁদে, যেন রাত কাঁদে
এ আঁধার শেষ তবু হয় না,
যায় প্রেম সরে, ফাঁকি দেয় মোরে
এই ব্যথা প্রাণে সয় না।
হায় স্বপ্নে আঁখি আর ভাসেনা
হায় স্বপ্নে আঁখি আর ভাসেনা
তারে বলে দিও,
সে যেন আসে না আমার দ্বারে
তারে বলে দিও।
ওই গুন গুন সুরে মন হাসে না
ওই গুন গুন সুরে মন হাসে না
তারে বলে দিও
সে যেন আসে না আমার দ্বারে
তারে বলে দিও।।"



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মৃত্যুবার্ষিকী


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ