পশ্চিম তীরে সহিংসতা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ
জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনের
সউদী নেতৃত্ব, বিশেষ করে দেশটির প্রবল ক্ষমতাশালী ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এখন কিছুটা অস্বস্তিকর সময় পার করছেন। সউদী আরবের ভেতর এমবিএস নামে পরিচিত প্রিন্সের জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ রয়েছে ঠিকই, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে ২০১৮ সালে সউদী সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যায় তার জড়িত থাকার অভিযোগ নিয়ে যে সন্দেহের বাতাবরণ রয়ে গেছে তা তিনি এখনও ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। এরই মধ্যে নব নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্পষ্ট বলে দিয়েছেন কোন কোন সউদী ইস্যুতে তিনি তার পূর্বসুরীর চেয়ে কঠোর অবস্থান নেবেন।
তবে বর্তমানে যে তিনটি বিষয় নিয়ে প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে রয়েছেন তার মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ইয়েমেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ, লড়াইয়ে জড়িত প্রায় সব পক্ষের জন্যই একটা বিপর্যয়, বিশেষ করে ইয়েমেনের দরিদ্র এবং পুষ্টিহীন জনগোষ্ঠীর জন্য। সউদী আরব এই যুদ্ধ শুরু করেনি- করেছিল হুথিরা, যখন তারা ২০১৪ সালের শেষ দিকে রাজধানী সানায় অভিযান চালিয়ে বৈধ সরকারকে উৎখাত করে। হুথিরা ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকার একটি উপজাতি গোষ্ঠী এবং সংখ্যার হিসাবে তারা দেশটির জনসংখ্যার ১৫ শাতংশেরও কম। মার্চ ২০১৫ সালে এমবিএস যখন সউদী প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন, তিনি কয়েকটি আরব রাষ্ট্রকে নিয়ে গোপনে একটি জোট গঠন করে ইয়েমেনে বিশাল বিমান আক্রমণ চালান। তারা আশা করেছিলেন এই প্রবল বিমান হামলার মুখে হুথিরা কয়েকমাসের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু প্রায় ছয় বছর ধরে লড়াইয়ে কয়েক হাজার নিহত ও বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হবার পরেও সউদী নেতৃত্বাধীন এই জোট সানা এবং ইয়েমেনের জনঅধ্যুষিত পশ্চিমাঞ্চল থেকে হুথিদের হঠাতে পারেনি। এই ছয় বছরে দুই পক্ষই যুদ্ধাপরাধও সংঘটিত করেছে। ইরানের সহযোগিতায় হুথিরা ক্রমশই আরও নির্ভুল নিশানার ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিস্ফোরক ড্রোন ছুঁড়েছে সউদী আরবকে লক্ষ্য করে। তাদের ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র এমনকি জেদ্দা পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং তেল স্থাপনাগুলোকে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছে।
অর্থের হিসাবে এই অচলাবস্থা সউদীদের জন্য বেশ ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বহু শান্তি পরিকল্পনাই একের পর এক ভেস্তে গেছে। বারাক ওবামা, ২০১৬ সালে তার ক্ষমতার শেষ দিকে সউদী আরবের প্রতি মার্কিন সহায়তা অনেকটাই খর্ব করেছিলেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা নেয়ার পর সেটা উল্টে দেন এবং রিয়াদ যতধরনের গোয়েন্দা তথ্য এবং সামরিক সরঞ্জাম চেয়েছে আমেরিকা তার পুরোটাই দেয়। এখন বাইডেনের প্রশাসন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এই সহায়তা দেয়া বন্ধ করে দেয়া হতে পারে। ফলে যে কোন ভাবে এখন এই যুদ্ধ শেষ করার জন্য চাপ বাড়ছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে নারীদের নিয়ে। সউদী আরবের তেরজন শান্তিপূর্ণ নারী আন্দোলনকারীকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। এবং এদের কাউকে কাউকে ভয়ানকভাবে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। এদের অপরাধ কার্যত নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার দাবি করা এবং পুরুষ অভিভাবকের অধীনে থাকার ‘চরম অন্যায্য পদ্ধতি’র অবসান চাওয়া। তাদের অনেককেই গ্রেফতার করা হয় ২০১৮ সালের ২৪ জুন সউদীতে নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার ঠিক আগে আগে। এদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত বন্দী লুজাইন আল-হাথলুল। সউদী কর্মকর্তারা এখনও অভিযোগ করছেন যে, হাথলুল গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং তিনি ‘বিদেশি শক্তির কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেছেন’, কিন্তু এর স্বপক্ষে তথ্যপ্রমাণ সউদী কর্তৃপক্ষ দেখাতে পারেননি। ইয়েমেন যুদ্ধের মতই এই বিষয়টাতেও সউদী নেতৃত্ব নিজের জন্য নিজে হাতেই কবর খুঁড়ে রেখেছে এবং এখন মুখ রক্ষা হয় এমন এটা নিষ্কৃতির উপায় খুঁজছে। লুজাইন আল-হাথলয়ুল ও অন্য নারী বন্দীদের মুক্তির দাবি উঠেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। দ্য হেগের সউদী দূতাবাসেও এই মর্মে আবেদন জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীরা ধারণা করা হচ্ছে নতুন বাইডেন প্রশাসন এই বিষয়টি সউদীদের সাথে উত্থাপন করতে যাচ্ছেন।
তৃতীয়টি হচ্ছে কাতার বয়কট। দৃশ্যত, এই ইস্যুটি পর্দার আড়ালে দীর্ঘ দিন ধরে চালানো কুয়েতী মধ্যস্থতায় সমাধান হয়ে গেছে বলেই মনে হবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এই সমস্যার শেকড় অনেক গভীরে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৭ সালে রিয়াদ সফর করার কয়েকদিনের মধ্যেই সউদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহারাইন এবং মিশরের সাথে মিলে তাদের উপসাগরীয় প্রতিবেশি দেশ কাতারকে খোঁড়া করে দেবার মত বিধ্বংসী বয়কট বা বর্জনের পদক্ষেপ নেয়। তাদের যুক্তি ছিল কাতার ইসলামপন্থী যে দলগুলোকে সমর্থন করছে তাদের কর্মকান্ড সন্ত্রাসবাদের পর্যায়ে পড়ে, এবং এটা অগ্রহণযোগ্য।
ইয়েমেনে হুথিদের মতই সউদীদের একটা ভুল প্রত্যাশা ছিল যে কাতারীরা চাপের মুখে নতি স্বীকার করবে এবং তাদের শেষ পর্যন্ত বশ্যতা মেনে নেবে। তারা তা নেয়নি। এর কারণ অংশত কাতারের রয়েছে বিপুল সম্পদ। কাতারে উপক‚লবর্তী তেল উৎপাদনের ক্ষেত্র রীতিমত বিশাল, এবং শুধুমাত্র ব্রিটেনের অর্থনীতিতেই কাতারের বিনিয়োগের পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন পাউন্ড (৫৩ বিলিয়ন ডলার) - এছাড়াও তাদের পেছনে রয়েছে তুরস্ক ও ইরানের সমর্থন। এর ফলে যেটা দাঁড়িয়েছে সেটা হল, মধ্য প্রাচ্যে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে একটা বিরাট বিভাজন রেখা তৈরি হয়ে গেছে। এর একদিকে আছে তিনটি রক্ষণশীল, সুন্নি উপসাগরীয় আরব রাজতন্ত্র- সউদী আরব, ইউএই এবং বাহরাইন, সাথে তাদের মিত্র দেশ মিশর। অন্যদিকে আছে কাতার, তুরস্ক এবং রাজনৈতিকভাবে ইসলামী যেসব আন্দোলনকে তারা সমর্থন করে, যেমন মুসলিম ব্রাদারহুড এবং গাযায় হামাস গোষ্ঠী। আর এই ধরনের অর্ন্তবর্তীকালীন আন্দোলন গোষ্ঠীগুলো এই চার দেশের জোটের অপছন্দের কারণ এদের তারা নিজেদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসাবে দেখে। এই বিবাদ মীমাংসার ব্যাপারে চাপ দিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দূত হিসাবে জারেড কুশনার উপসাগরীয় এলাকা সফরে গেছেন। এবং বাইডেনের প্রশাসনও নিঃসন্দেহে চাইবে এই সমস্যার সমাধান। এর আরও একটা কারণ হল কাতারের আল-উদাইদে রয়েছে বিদেশে পেন্টাগনের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি। কিন্তু মধ্যস্থতার মাধ্যমে যে সামাধান মীমাংসাই হোক, সেটার বাস্তবায়নই সবচেয়ে বড় কথা। প্রতিবেশি দেশগুলোকে ক্ষমা করতে কাতারের হয়ত অনেক বছর সময় লেগে যাবে। এবং অন্যদিক থেকে কাতারের ওপর বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের জন্যও এই চারটি দেশ হয়ত অনেক বছর সময় নেবে। সূত্র : বিবিসি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।