চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
কুরআন শিক্ষার প্রাথমিক স্তর মক্তব। মক্তব আরবি শব্দ। অর্থ লাইব্রেরী, গ্রন্থাগার, পাঠশালা। পারিভাষিক অর্থে মুসলিম পরিবারের শিশুদের ইসলামী শিক্ষাদানের জন্য যে সকল স্থানে একত্রিত করা হয়, তাই মক্তব। মক্তব শিক্ষা সর্বযুগে সবার জন্য ছিলো উন্মুক্ত; মসজিদে নববীতে ‘আছহাবে ছুফ্ফা’ নামক সাহাবাদেরকে শিক্ষাদানের জন্য রাসুল সা. একজন শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন, তখন থেকেই মক্তব শিক্ষার যাত্রা। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের মক্তবই হচ্ছে মুসলিম মিল্লাতের প্রথম পাঠশালা। প্রাচীনকাল থেকে মসজিদের বারান্দাকে কেন্দ্র করে চলছে এই মক্তব শিক্ষার কার্যক্রম। শিশুদের মক্তবে যাওয়ার চিরাচরিত এই দৃশ্য এখন আর গ্রামবাংলায় খুব একটা দেখা যায় না।
দুরুদ শরীফ, হামদ-নাত আর আলিফ, বা, তা এর মিষ্টি মধুর সুরের শব্দে মুখরিত হয়ে উঠে না গ্রাম কিংবা শহরের জনপদ। রোজ সকালে কুরআনের আওয়াজ কঁচিকাঁচা শিশুদের কন্ঠ থেকে বের হয় না। তারপরও ইতিহাসে রাজা-প্রজা, ফকির-বাদশা, আমির-উমারা, ওলি-দরবেশ, পীর-মাশায়েখ, প্রভু-ভৃত্য, কৃষক-শ্রমিক সবই ছিলেন মক্তবের ছাত্র। অনেক লোককে বলতে শুনেছি যে, আমি স্কুলের ধারে কাছে কোনো দিন যাই নাই, আবার অনেকে বলেছেন আমি মাদরাসার ধারে কাছে কোনো দিন যাই নাই। কিন্তু মক্তবে যাই নাই, এমন কথা বলার মতো লোক সমাজে সত্যিই বিরল। কারণ একজন ভালো মানুষ হওয়ার জন্য মক্তব শিক্ষার বিকল্প নেই।
বর্তমানে কুরআন শিক্ষার উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। হারিয়ে যাচ্ছে ইসলামের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র। যখন কোনো সন্তানের বয়স চার বছর চার মাস চার দিন পূর্ণ হতো, তখন তার বিদ্যা শিক্ষার সূচনা হতো। বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কুরআনের কিছু অংশ শিশুকে পাঠ করে শোনানো হতো। শিশু তা পুনরাবৃত্তি করত।
এটা ছিল প্রতিটি মুসলিম পরিবারের অপরিহার্য প্রথা।’ নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের মধ্যে গড়ে তোলার পেছনে মক্তব শিক্ষা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের মসজিদগুলোতেও সকালবেলা শিশুদের মক্তব খুলে দ্বীনি শিক্ষা দেওয়ার রেওয়াজ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। মক্তব শিক্ষাই হচ্ছে ইসলামের আদি এবং মৌলিক শিক্ষা।
একসময় বাংলার পথে-ঘাটে ভোরবেলা ছোট ছোট কোমলমতি শিশুরা দল বেঁধে মক্তবে কুরআন শিক্ষার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতো। বর্তমানে তা দ্বীনি শিক্ষার অন্তরায়। জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। বিশেষত ধর্মীয় জ্ঞান না থাকলে ধর্ম মোতাবেক জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। মুসলিম সুলতানি যুগ থেকে শুরু করে মোগল আমল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৮০০ বছর মুসলমানদের নিকট ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব ছিল প্রবল। রাজধানীর কথা না হয় বাদ-ই দিলাম গ্রামের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় হাজারো মক্তব-মাদরাসা ছিল। মুসলমানদের ঐতিহ্যের ধারক মক্তবগুলো আজ বিলুপ্তপ্রায়।
এর প্রভাবে তৈরি হচ্ছে ধর্মীয় জ্ঞানশূন্য বিশাল জনগোষ্ঠী। দেশের সর্বত্রে আজ মক্তবের সময় বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল, কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে মর্নিং শিফট চালু হওয়ায় একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী মক্তবের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। একশ্রেণির অভিভাবক মক্তব শিক্ষার ব্যাপারে উদাসীন হওয়ায় শিশুদের কচি মনে ইসলামী মূল্যবোধের পরিবর্তে বিজাতীয় সংস্কৃতি প্রথিত হচ্ছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিপদজনক। মক্তব শিক্ষার সে মূল্যবান সময়টুকু যদি পুনরুদ্ধার করা না যায়, তাহলে এটা নিশ্চিত যে, ঈমান-আক্বিদায় সমৃদ্ধ মুসলমান জাতি ভবিষ্যতে একটি দুর্বল জনগোষ্ঠিতে পরিণত হবে। বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি মসজিদে মক্তব চালু রয়েছে।
শিশুদেরকে ইসলামি বুনিয়াদি শিক্ষা দেয়া না হলে চিরতরে হারিয়ে যাবে অদূর ভবিষ্যত। এ জাতি মদ, জুয়া, যিনা, ব্যভিচার ও নানা অপকর্মে জড়িয়ে ধ্বংসের মুখে পতিত হবে। মক্তব শিক্ষাকে বিলুপ্তির পথ থেকে পুনরায় চালু রাখা সর্বমহলের নৈতিক দায়িত্ব।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।