পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রায় মাস দেড়েক আগেই সরকারের তরফ থেকে শীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, শীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হতে পারে এবং এ বাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আগাম প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেখা যাচ্ছে, শীত পুরোপুরি শুরু না হলেও অনুভূত হওয়ার মধ্যেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুহার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি হিসেবে যে তথ্য দেয়া হচ্ছে, বেসরকারি হিসেবে প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি বলে স্বাস্থ্যবিদরা বলছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, পরিসংখ্যান সবসময় প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না। এটা একটা ধারণা মাত্র। দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়া নিয়ে যে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় তা ধীরে ধীরে জোরালো হচ্ছে। পত্র-পত্রিকার প্রতিদিনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঘরে ঘরে করোনা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশপাশের লোকজন এবং আত্মীয়-সজনদের খোঁজ নিলেই দেখা যায় তাদের কেউ না কেউ করোনায় আক্রান্ত। তাদের বেশিরভাগ রোগীই ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেকে করোনার উপসর্গকে শীতকালীন সাধারণ সর্দি-কাঁশি ও জ্বর বিবেচনা করে সাধারণ চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং ঘর থেকে বের হয়ে অন্যদের সাথে মেলামেশা করছেন। জ্বর-কাঁশি না কমায় তাদের কেউ কেউ করোনা টেস্ট করিয়ে পজেটিভ হলেও ঘর থেকে বের হয়ে তারা যে অন্যদের সাথে মেলামেশা করে ইতোমধ্যে করোনা ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা বুঝতে পারলেও কিছু করার থাকছে না। এ বিষয়টি এখন বিপদ এবং করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পুরোপুরি শীত শুরু হলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ভেবে দুঃশ্চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। সরকারের পক্ষ থেকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলার কথা শোনা গেলেও তার প্রস্তুতি কতটুকু তা দৃশ্যমান নয়। শুধু মাস্ক পরতে বাধ্য করার জন্য ভ্রম্যামান আদালত পরিচালনা এবং জরিমানা করার কিছু ঘটনা আমার দেখেছি। সরকারি বেসরকারি কার্যালয়ে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ নিয়ম চালু করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা পরিলক্ষিত হয় না। এছাড়া তেমন প্রস্তুতির কথা শোনা যায় না। হাসপাতালগুলো প্রস্তুত করা, পর্যাপ্ত আইসিইউর ব্যবস্থা এবং যেগুলো রয়েছে, সেগুলো কার্যকর করে তোলা হচ্ছে কিনা তার কোনো সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমও দৃশ্যমান নয়। ফলে দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি অমান্য ও মাস্কবিহীন অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে চলাচল করছে।
করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ হচ্ছে, সামাজিক দূরত্ব বা শারিরীক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মাস্ক পরা। জটলা বাঁধা বা জনসমাগম এড়িয়ে চলা। ইতোমধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা এবং তা জোরালো হওয়ার বিষয়টি সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারেনি। ইউরোপ-আমেরিকায় এখন দ্বিতীয় ঢেউ যেমন চলছে, তেমনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে তৃতীয় ঢেউ শুরুর আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছে। আমাদের দেশে দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর বিষয়টি আঁচ করা গেলেও এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অথচ দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর প্রবল আশঙ্কা রয়েছে এবং তা ভয়াবহ উঠতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। আমরা যদি শুধু রাজধানীর কথাই ধরি তাহলে দেখব, এখানে শীতের সাথে ভয়াবহ বায়ূ দূষণ যুক্ত হয়ে করোনা সংক্রমণের সহায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনিতেই স্বাভাবিক সময়ে শীতে রাজধানী ধুলিধূসরিত হয়ে থাকে। আর এখন অলিগলি থেকে শুরু করে এমন কোন রাজপথ নেই যেখানে বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থা খোঁড়াখুঁড়ি করেনি। রাস্তা খুঁড়ে মাসের পর মাস ফেলে রাখা হয়েছে। সংস্কারের কোনো নামগন্ধ নেই। খোঁড়াখুঁড়ি করা এসব সড়ক এখন ধুলা উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছে। এছাড়া মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়েসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের কর্মযজ্ঞ থেকে ধুলাবালি রাজধানীর বায়ু দূষিত করে ফেলেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে রাজধানীর আশপাশের ইটভাটা এবং হাজার হাজার যানবাহন ও কলকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর এই ভয়াবহ বায়ু দূষণ করোনা সংক্রমণ বাড়িয়ে দিতে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ করে যারা অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, ডায়বেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগসহ অন্যান্য জটিল রোগে ভুগছেন, তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স অনুযায়ী, মানুষের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার ক্ষেত্রে বায়ুর মান শূন্য থেকে ৫০ থাকতে হয়। বর্তমানে রাজধানীসহ বায়ুর এই মান গড়ে ১৫০ থেকে ২০০। শীত পুরোপুরি শুরু হলে এই হার যে আরও বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। এর সাথে করোনার সংক্রমণ যুক্ত হলে কি অবস্থা হবে তা ভাবা যায় না। গত সোমবার একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীতে প্রতিদিন ২৮২ টন করোনাবর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এসব বর্জ্য যেখানো-সেখানে, যত্র-তত্র ফেলা হচ্ছে। রাস্তা-ঘাটে, ফুটপাতে, বাজারসহ এমন কোনো স্থান নেই যেখানে এ বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখা যায় না। অথচ ব্যবহৃত এসব বর্জ্যও করোনা সংক্রমণের অন্যতম কারণ। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এসব বর্জ্য সাধারণ গৃহস্থালি বর্জ্যরে সঙ্গে মিশিয়ে অপসারণ করা হচ্ছে। করোনাবর্জ্য যে সাধারণ কোনো বর্জ্য নয়, এ বিষয়টি সরকারের কোনো সংস্থাই আমলে নিচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরা বারবার বলেছেন, এ বর্জ্য বিশেষ ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করে আলাদা শোধন করতে হবে। সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষকে এদিকে খেয়াল আছে বলে মনে হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে কোনো সচেতনতা নেই। ফলে যত্রতত্র ব্যবহৃত মাস্কসহ করোনার অন্যান্য বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। করোনা প্রতিরোধে করোনাবর্জ্য যে অন্যতম প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে, তা বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই।
আমাদের দেশের মানুষ সামাজিকতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। তারা উৎসব মুখর এবং অনেক সময় হুজুগের সাথে তাল মেলাতেও দ্বিধা করে না। করোনা এসে এবং লকডাউনের কারণে কিছুকাল তাদেরকে সামাজিকতা থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হলেও লকডাউন উঠে যাওয়ায় তারা চিরায়ত রীতি অনুযায়ী সামাজিক হয়ে উঠে এবং অবাধে মেলামেশা শুরু করে। দেশে যে ভয়াবহ করোনা বিদ্যমান তা ভুলে গিয়ে নতুন স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করে। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। করোনা দেশের কোটি কোটি মানুষকে বেকার করে দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে কর্মরত মানুষকে কর্মহীন এবং আয় কমিয়ে দেয়াসহ জীবনযাপন দুঃসহ করে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে তাদের নামতে হয়েছে। এই নামতে গিয়ে তাদের কাজকর্ম শুরু এবং মেলামেশা বৃদ্ধি ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না। চাকরিজীবীদের কর্মস্থলে যেতে হয়েছে, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষকে বাণিজ্য ও কেনাকাটার জন্য মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থানে গমন করতে হয়েছে ও হচ্ছে। লকডাউনে আটকে থাকা অনেকে সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-সজনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণেও যেতে হয়েছে। বিয়ে-সাদীরও আয়োজন করতে হয়েছে। এসব করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই অবাধ মেলামেশা ও সামাজিক কর্মকান্ড চালেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি ও মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে দেখা যায়নি। ফলে করোনার সংক্রমণ নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। এখন আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, শীতের সাথে করোনার সম্পর্ক নিয়ে। ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, শীত বা অতি ঠান্ডায় করোনা বেশ সক্রিয় হয়ে উঠে এবং বিস্তার লাভ করে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো শীত প্রধান হওয়ায় সেখানে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়া এবং তৃতীয় ঢেউ শুরুর আশঙ্কার পেছনে এই শীতই কারণ হয়ে রয়েছে। আমাদের দেশ নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এবং শীতের সময় কখনো কখনো তীব্র শীত অনুভূত হয়। এখনো শীত পুরোপুরি শুরু হয়নি। তার আগেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আলামত ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শীত যদি তীব্র হয়ে উঠে কিংবা স্বাভাবিক শীতের মাত্রায় থাকে তখন পরিস্থিতির যে অবনতি হতে পারে তা আশঙ্কা করা অমূলক নয়। এ অবস্থায় সরকারের সার্বিক প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা জোরদার করা ছাড়া বিকল্প নেই। সরকারের নেয়া সব ধরনের পদক্ষেপ দৃশ্যমান করে তুলতে হবে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার যেসব নিয়মকানুন জনসাধারণকে অবহিত করা হয়েছে, তাদের তা স্মরণ করিয়ে দিতে নতুন করে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা, নিয়মিত হাত ধোয়াসহ জনসমাগম এড়িয়ে চলার বিষয়গুলো নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া এবং টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমে অনতিবিলম্বে ব্যাপক প্রচার করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সাধারণত শীত মৌসুমে বিয়ে-সাদীসহ অন্যান্য জনসমাগমমূলক অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করা হয়ে থাকে। এসব অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। রাজধানীর ধুলা নিয়ন্ত্রণে খোঁড়াখুঁড়ি করে ফেলে রাখা সড়ক মেরামতের দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। করোনা থেকে রক্ষা পেতে জনসাধারণকেও সচেতন ও সতর্ক হয়ে চলতে হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।