পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ঠিক করেছি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনে তিনজন স্টলওয়ার্ট বা রাঘব বোয়ালের দক্ষিণ এশিয়া সফর সম্পর্কে লিখবো। এই তিন স্টলওয়ার্ট হলেন, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালেয়র দ্বিতীয় ব্যক্তি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আস্থাভাজন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বেইগান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ড. ক্যাসপার। উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বেইগান কয়েক দিন আগে প্রথমে দিল্লী এবং তারপরে ঢাকা সফর করেন। চলতি মাসের শেষে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্যাসপার দিল্লী সফর করবেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও কলম্বো সফর করবেন। (আজ ২৭ অক্টোবর। জানি না এর মধ্যে তারা দিল্লী এবং কলম্বো এসেছেন কিনা।) তিন মন্ত্রীরই সফরের উদ্দেশ্য মূলত এক। আর সেটি হলো ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে (আইপিএস) এই তিনটি দেশকে শরীক করা। ভারত অবশ্য ইতোমধ্যেই আইপিএসে যোগ দিয়েছে। শুধু যোগ দেওয়া নয়, আইপিএসে বড় শরীক এবং এই জোটে আমেরিকার দক্ষিণহস্ত। আর দুই সদস্য হলো জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া। এই বিষয়টি নিয়ে লেখা যখন এগিয়ে নেব তখন আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো দৈনিক ইনকিলাবের একটি সংবাদে। সংবাদটি ছাপা হয়েছে ২৩ অক্টোবর শুক্রবার পঞ্চম পৃষ্ঠায়, যার শিরোনাম, ‘ভারত সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে মিয়ানমারকে উস্কে দিচ্ছে। বিবৃতিতে আসম রব।’
স্টাফ রিপোর্টার পরিবেশিত ঐ খবরে বলা হয়েছে, গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত মিয়ানমারকে ভারতের সাবমেরিনসহ সামরিক সরঞ্জাম দেওয়া বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতার জন্য গভীর উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন জে এস ডি সভাপতি আসম আব্দুর রব। গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, সম্প্রতি খবর প্রকাশিত হয়েছে যে ভারত মিয়ানমারকে সাবমেরিন এবং সামরিক সরঞ্জাম দিতে যাচ্ছে, যা উস্কে দেওয়ার নামান্তর। মিয়ানমার প্রায়শই তার সামরিক শক্তিতে বাংলাদেশকে উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। এ বাস্তবতা বিবেচনায় ভারতের এ সিদ্ধান্ত কোনোক্রমেই বাংলাদেশ ভারত ‘রক্তের বন্ধনযুক্ত সম্পর্কের’ সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ভারতের সাবমেরিনসহ সামরিক সরঞ্জাম দেওয়া বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নে গভীর উদ্বেগজনক।
জনাব রব আরও বলেন, মিয়ানমার তার দেশের ১১ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে হত্যা, ধর্ষণ এবং অস্ত্রের মুখে জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই মহা সঙ্কটেও ‘রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ’ ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উচিত, নতজানু নীতি পরিহার করে অবিলম্বে সরকারী পর্যায়ে ‘রাখিবন্ধন’ যুক্ত সম্পর্কের দেশ ভারতের কাছে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা।
এই খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর আমি বিষয়টি নিয়ে আরো অনুসন্ধান করি। অনুসন্ধানে জানা যায় যে, ভারত সোভিয়েট ইউনিয়ন থেকে যে সব সাবমেরিন সংগ্রহ করেছিল তারই একটি মিয়ানমারের কাছে বিক্রি করেছে। এছাড়া সোভিয়েট নির্মিত টি-৭২ ট্যাঙ্ক এবং পদাতিক বাহিনীর জন্য ভারী অস্ত্র মিয়ানমারের কাছে বিক্রয় করার জন্য ভারত এবং মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনা চলছে।
এব্যাপারে কয়েকটি প্রশ্ন মনে উদিত হয়। পাঠকদের হয়তো স্মরণ আছে যে, বাংলাদেশ যখন চীনের নিকট থেকে দুটি সাবমেরিন ক্রয় করে তখন ভারত বাংলাদেশের ওপর খুব নাখোশ হয়েছিল। এই নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ায় লেখালেখি কম হয়নি। ভাবখানা এই যে, এই বুঝি বাংলাদেশ চীনের পকেটে ঢুকে গেল। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, ভারত মিয়ানমারকে একটি সাবমেরিন দিয়েছে। অথচ ভারত ভালো করেই জানে যে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের সম্পর্ক তিক্ত। সেই মিয়ানমারকে ভারত সাবমেরিন দিয়েছে। চীনের নিকট থেকে বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনা যদি ভারতের চোখে খারাপ হয়ে থাকে তাহলে মিয়ানমারের নিকট ভারতের সাবমেরিন বিক্রয় বাংলাদেশের চোখে খারাপ হবে না কেন?
প্রশ্ন হলো, মিয়ানমারকে ভারত অস্ত্র সজ্জিত করছে কেন? সেটি কি মিয়ানমারকে চীনের প্রভাববলয় থেকে বের করে এনে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে ভিড়াবার জন্য? যদি ভারতের মনের গোপন অলিন্দে এই ধরনের কোনো বাসনা থেকে থাকে তাহলে সেটি আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। কেনা জানে যে, মিয়ানমারের প্রায় সমগ্র সশস্ত্র বাহিনীই চীনা অস্ত্রে সজ্জিত। তাহলে ভারত প্রদত্ত সাবমেরিন এবং ট্যাঙ্ক মিয়ানমার কার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে? মিয়ানমারের চারধারে আর কোনো শত্রুদেশ আছে কি? যদি সে রকম কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে তাহলে মিয়ানমারের সমরভান্ডারের এসব অস্ত্র কি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না?
দুই
আমরা ফিরে যাচ্ছি তিন মার্কিন রাঘব বোয়ালের দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশ, অর্থাৎ ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা সফর নিয়ে আলোচনায়। আজকের আলোচনার শুরুতেই আমরা বলেছি যে, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কাকে আইপিএসে যোগদান করানোর জন্যই ট্রাম্প প্রশাসনের নেতৃবৃন্দের এই শেষ মুহূর্তের দৌড়ঝাঁপ। কিন্তু এই অন্তিম মুহূর্তে কেন? আজ মঙ্গলবার, ২৭ অক্টোবর। আর ৭ দিন পর মার্কিন সময় ৩ নভেম্বর এবং বাংলাদেশ সময় ৪ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হন তাহলে এক কথা। আর যদি তিনি হেরে যান এবং জো বাইডেন জয়লাভ করেন তাহলে কী হবে? বিশ্বব্যাপী মার্কিন উপস্থিতি বা প্রভাববলয় গুটিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার পররাষ্ট্রনীতির সমগ্র ফোকাস এক জায়গায় কেন্দ্রীভ‚ত করেছেন। সেটি হলো প্রচন্ড চীন বিরোধিতা। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলে তিনিও কি ট্রাম্পের প্রচন্ড চীন বিরোধিতার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবেন? এ ব্যাপারে এই মুহূর্তে কিছু বলা সম্ভব নয়। কারণ বাইডেন তাঁর ভবিষ্যত পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে তেমন একটা আলোকপাত করেননি।
বাইডেন তাঁর নির্বাচনী প্রচারণাকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন, তাঁর ভাষায়, ‘করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্পের সম্পূর্ণ ব্যর্থতার’ মধ্যে। ট্রাম্পকে তিনি বলেছেন একটি বিপর্যয়। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর আমেরিকার ৭০ বছরের ইতিহাসে এতবড় বিপর্যয় আর আসেনি বলে তিনি প্রচারণা চালাচ্ছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিন্টন বাইডেনের নির্বাচনী প্রচারণায় গতি সঞ্চার করেছেন।
চলতি বছরের শুরুতে আমেরিকায় যখন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটিকে ‘হোক্স’ বা প্রহসন বলে উড়িয়ে দেন। এরপর করোনা সেখানে যখন মহামারী রূপ গ্রহণ করে তখন ট্রাম্প বলেন, এটি একটি ‘ফ্লু’। এটি এমনিতেই চলে যাবে। এজন্য ভ্যাকসিনের প্রয়োজন নাই। তিনি মাস্ক পরা, হাত ধোয়া বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর কোনো গুরুত্ব আরোপ করেননি। করোনার বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশ শুরু থেকেই যে সাবধানতা অবলম্বন করেছিল, সেটা যদি আমেরিকাতেও করা হতো তাহলে হয়তো সেখানে সোয়া ২ লক্ষ মানুষ মারা যেতেন না। ইতোমধ্যে আমেরিকাতে যে নির্বাচনী জরিপ হচ্ছে সেই জরিপে দেখা যাচ্ছে যে ট্রাম্প নির্বাচনে শুধু হারবেন না, তার এই নির্বাচনী পরাজয় হবে, ‘ল্যান্ড স্লাইড ডিফিট’ বা ‘ভূমিধস পরাজয়’। সে জন্য পর্যবেক্ষকরা মনে করেন যে, নির্বাচনের এক বা দুই সপ্তাহ আগে চীন বিরোধী জোট গঠনের দিকে মনোযোগী না হয়ে ট্রাম্পের উচিত ছিল সমগ্র টিম নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে মনোযোগী হওয়া।
তিন
রিপাবলিক্যান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ তাঁর দুটি মেয়াদেই আফগানিস্তান এবং ইরাক নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সামরিক শক্তির জোরে তিনি ঐ দুটি দেশ দখল করলেও দুটি দেশেরই মানুষ চরম মার্কিন বিরোধী হয়ে ওঠে। শুধু ঐ দুটি দেশের মানুষ নয়, এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার মানুষও এই সাম্রজ্যবাদী জবরদস্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। আমেরিকা যখন ইরাক এবং আফগানিস্তান নিয়ে ব্যস্ত তখন চীন ধীরে ধীরে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এটি টের পেয়ে আমেরিকা গঠন করে প্যাসিফিক পাইভট স্ট্র্যাটেজি (Pacific Pivot Strategy) বা পিপিএস। এটিকেই বিস্তৃত রূপ দেওয়ার জন্য ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গঠন করেন Trans Pacific Partnership(TTP).. প্যাসিফিক পাইভট স্ট্র্যাটেজি বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ ছিল মূলত অর্থনৈতিক সহযোগিতা কেন্দ্রিক। সামরিক সহযোগিতা ছিল সেখানে গৌণ। ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৭ সালে বারাক ওবামার টিপিএস থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে আনেন এবং টিপিএসকে সম্পূর্ণরূপে চীনবিরোধী একটি সামরিক জোটে রূপ দেন। নাম দেন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস)। এই নামকরণের মাধ্যমে আমেরিকা ভারতকে অসাধারণ গুরুত্ব দেয়।
চার
সেই মুহূর্তে আইপিএস হালে পানি পায় কয়েকটি কারণে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তাইওয়ান চীনের অংশ, এই দাবির ওপর জোর দেওয়া, হংকংয়ের ব্যাপক গণবিক্ষোভকে চীন কর্তৃক বল প্রয়োগে দমন, পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সার্বভৌমত্বের দাবি প্রভৃতি। এসব কারণে জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া আইপিএসে যোগ দেয়। কিন্তু হিমালয় অঞ্চলে চীন-ভারত সর্বশেষ বিরোধ ভারতকে আইপিএসের শক্তিশালী অংশীদার হিসাবে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করে।
কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশ আইপিএসে কেন যোগ দেবে? চীন তো কোনো দিক দিয়েই বাংলাদেশের প্রতি হুমকি নয়। বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবকাঠামোগত অনেক মেগা প্রজেক্টে চীন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বাংলাদেশ যদি আইপিএসে যোগদান করে তাহলে নিশ্চিতভাবে চীন নাখোশ হবে। কেউ কেউ যুক্তি দিচ্ছেন যে, বাংলাদেশ আইপিএসে যোগদানে যদি সরাসরি না করে দেয় তাহলে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এছাড়া এখন পর্যন্ত আমেরিকা বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী।
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বিচক্ষণতার কাজ হবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করা। কারণ, আইপিএসে যোগ দেওয়ার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের ওপর যে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছে, জো বাইডেন জিতলে সেই চাপের প্রচন্ডতা অনেক কমে আসবে। জো বাইডেন আইপিএসকে পেছনের আসনে ঠেলে দিয়ে অন্য কোনো বিষয়কে সামনে আনতেও পারেন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সঠিক পথেই আছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।