Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২৭ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০১ এএম

গ্রাম-বাংলায় একটা কথা বহুল প্রচলিত রয়েছে। মাচার তলে কেরে? -আমি কলা খাই না। একথার একটা পটভূমি আছে। একটা দুষ্টু ছেলে মাচার তলে বসে গোপনে কলা খাচ্ছিল। মা জিজ্ঞাসা করছিলেন, মাচার তলে কেরে? ধরা পড়ার ভয়ে থতমত খেয়ে ছেলে বোকার মত জবাব দিল: মা, আমি কলা খাই না। অর্থাৎ ধরা পড়ার ভয়ে সে কিছু না বুঝে যা বলল তাতে বোঝা গেল, সে কলা খাচ্ছিল। কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে সে এমন কথা বলল, যাতে প্রমাণ হলো সে মাচার তলে গোপনে কলা খাচ্ছিল।

কথাটা মনে পড়ে গেল, কয়েক দিন আগে ধর্ষণবিরোধী লং মার্চে ফেনীতে ছাত্রলীগ, যুবলীগের আক্রমণের ঘটনায়। এতে প্রমাণ হলো, ছাত্রলীগ, যুবলীগের সাথে সংশ্লিট কিছু লোক ধর্ষণ প্রভৃতি অপকর্মের সাথে জড়িত। সুতরাং ধর্ষণবিরোধী লংমার্চকে তারা সহ্য করে উঠতে পারছিল না। যদিও লংমার্চটি ছিল ধর্ষণ অপকর্মের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই লং মার্চে হামলা চালিয়ে তারা প্রমাণ করলো যে, এটা তাদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হচ্ছিল। অর্থাৎ এই অপকর্মে তারা নিজেরা জড়িত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে বলেই তারা ধারণা করছিল। নইলে এই লং মার্চে তাদের ক্ষিপ্ত হবার কোনই কারণ ছিল না।

এবার আমরা দেশের বর্তমানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে যে দলটি তাদের সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। এই দলটির বর্তমান নেত্রী শেখ হাসিনা নিজে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সরকার পরিচালনা করছেন। তিনি নিজে প্রায়ই বলে থাকেন, অন্যায় যেই করুক, তাকে শাস্তি পেতে হবেই। শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নন, শাসক দলের দ্ইু নম্বর নেতা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও মাঝে মাঝেই বলে থাকেন, অপরাধ যেই করুক, তাকে তার জন্য শাস্তি পেতেই হবে। এমনকি সে যদি আওয়ামী লীগের সমর্থকও হয়ে থাকে, তাকে রেহাই দেয়া হবে না।

আওয়ামী লীগের এই দুই শীর্ষ নেতাকে তাদের এই সুন্দর কথার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, ফেনীতে ধর্ষণবিরোধী লং মার্চের উপর আওয়ামী লীগ সমর্থক, ছাত্রলীগ, যুবলীগের সমর্থক যারা আক্রমণ চালিয়েছে তাদের অবিলম্বে যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু তারা ছাত্রলীগ, যুবলীগের সদস্য, তাই তারা তাদের সাত খুন মাফ- নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। সরকার যদি এদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়, তবে তাদের এই নীতি থেকে সরানো যাবে না। অন্যদিকে, সরকার জনমনে যে সুনাম কুড়িয়েছে, তা ¤øান হয়ে যাবে। যদিও তারা মাঝে মাঝে লোকদেখানো নির্বাচন দিয়ে জনগণের সমর্থন লাভে ধন্য, এটা প্রমাণ করতে চান। কিন্তু তাতে তাদের প্রতি দেশের জনগণের প্রকৃত মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে না। কারণ, এসব নির্বাচন নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের অধীনে অনুষ্ঠিত না হওয়ায় জনগণের কাছে এর কোন বাস্তব মূল্য থাকে না।

এ প্রসঙ্গে দেশের নির্বাচনের ইতিহাস দিয়ে কিছু কথা বলতে চাই, যাতে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তারা জানেন, এদেশে একবার একটি নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে ক্যু করে ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্তন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তখন সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে ঐ ক্যুর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বসেন দেশের প্রাচীনতম দল আওয়ামী লীগ। এর কারণ ছিল, ঐ উৎখাত হওয়া নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি

এরপর চলতে থাকে জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর শাসন। পাশাপাশি চলতে থাকে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আন্দোলন। প্রথম প্রথম আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এসব আন্দোলন থেকে দূরে থাকলেও আপোসহীন নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠলে এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যোগ দেন। দেশের দুই প্রধান নেত্রী আন্দোলনে যোগ দেয়ায় এক পর্যায়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। তখন দাবি ওঠে নতুন নির্বাচনের। তবে সে নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় সেজন্য দুই প্রধান দল একমত হয় যে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে নিরপেক্ষ কোন সরকারের অধীনে।

কিন্তু নিরপেক্ষ সরকার পাওয়া যাবে কীভাবে? এ প্রশ্নের জবাবে প্রস্তাব আসে যে, এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ। তাঁর অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন চলাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বলা হয়, নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হচ্ছে। লক্ষ রাখবেন, ভোটে হেরে গিয়ে যেন কেউ আবার কারচুপি না আবিষ্কার করেন।

এরপর সারাদেশে ভোট গণনা শেষ হলে জানা গেল, নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ নয়- বিএনপি। সাথে সাথে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ বলা হয়, নির্বাচনে সূ² কারচুপি হয়েছে। কিন্তু স্ববিরোধী বক্তব্য কেউ গুরুত্ব না দেয়ায় স্বাভাবিক নিয়মে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়। সংসদে বিরোধীদলের আসনে বসে আওয়ামী লীগ।

এরপর প্রধানত বিরোধীদলের নেত্রী শেখ হাসিনার দাবির মুখেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সকল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান সংসদে গৃহীত হয়। এর ফলে পালাক্রমে দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে সরকার গঠনের পালা চলে।

এরপর একবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের আমলে দেশের সংবিধান সংশোধন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা গৃহীত হলো। যুক্তি দেখানো হলো, জনগণের সমর্থন লাভে ধন্য হয়নি এমন কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান মেনে নেয়া যায় না। তাছাড়া গণতান্ত্রিক বিশ্বের সর্বত্র নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেটাই গণতন্ত্রের বিধান। বাংলাদেশ এর বাইরে কোন ব্যতিক্রম হতে পারে না।

এরপর থেকে সেই যে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন শুরু হয়, তার আর কোন ব্যতিক্রম হচ্ছে না এবং নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হওয়ায় আওয়ামী লীগের শাসন থেকে জনগণ আর মুক্তি পাচ্ছে না। এখন নির্বাচনে মানেই আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং নির্বাচনের মহড়া। ফলে বাংলাদেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের কোন বিকল্পের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারছে না।

আমরা বাংলাদেশের নির্বাচনের যে ইতিহাস উল্লেখ করেছি, তাতে গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপ যে অনুপস্থিত এটা সত্যের খাতিরে স্বীকার করতেই হবে। আমরা আশা করি, সরকার এই ব্যবস্থার আশু পরিবর্তনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের বিশেষ পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে কীভাবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সে লক্ষ্যে বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠর লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। তাতে যদি দেশে পুনরায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় তার জন্য সরকার প্রধানকে সবাই কৃতিত্ব দিতে বাধ্য হবে।



 

Show all comments
  • Jack Ali ২৭ অক্টোবর, ২০২০, ১১:১৯ এএম says : 0
    American social scientist said:Marvin Simkin: “Democracy is not freedom. Democracy is two wolves and a lamb voting on what to eat for lunch. So our so called government eating every things as such majority we are poor and oppressed by these government and they are committing every kind of crime. Human being is the Creation of Al-Mighty Allah and He knows what is good and what is bad for human being.. as such He Legislated how to rule a country by His Law. Those who believe and rule by democracy are they powerful than Allah?? If that is the case then don't eat, Allah don't eat, don't sleep, Allah don't sleep.. Still there is time .. repent to Allah and hand over power to a honest Muslim who will rule our Beloved country by the of Allah then we will be able to live in our country in peace, prosperity with human dignity.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন