Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

শুধু আশ্বাসেই বিশ্বাস!

পুলিশ হেফাজতে মাসুদ রানার মৃত্যু নিয়ে রহস্য

খলিলুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২১ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০০ এএম

‘আমার ভাই কখনো নেশা করেনি। সে অনেক সহজ-সরল ছিল। তার সাথে কারো শত্রুতা ছিল না। তারপরও পুলিশ আমার ভাইকে আটক করেছে। কি কারণে করেছে; তাও জানতে পারিনি। হঠাৎ পুলিশ আমাদের ভাইয়ের মৃত্যুর খবর দেয়। পরে লাশ নিয়ে গ্রামে আসি। পুলিশের আশ্বাসে মামলাও করিনি আমরা। তাদের আশ্বাসের উপর বিশ্বাস করেই বসে আছি।’ কথাগুলো দৈনিক ইনকিলাবকে বলেছেন, রাজধানীর পল্টন থানায় পুলিশ হেফাজতে নিহত মাসুদ রানার বড় ভাই আব্দুর রফিক।

জানা গেছে, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর পল্টন থানায় পুলিশ হেফজতে মাসুদ রানা (৩৫) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। নিহত মাসুদ রানা নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও থানার কাঁচপুর ইউনিয়নের পশ্চিম বেহাকৈর গ্রামের মৃত জলিল ব্যাপারীর ছেলে। তিনি কাঁচপুরে ফয়সাল রোলিং মিলে কাজ করতেন এবং কাঁচপুরেই পরিবার নিয়ে থাকতেন। তার স্ত্রীর নাম রেহানা আক্তার। তাদের দুই মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে করে এবং ছোট মেয়ের বয়স মাত্র ১৮ মাস। প্রতিদিনের মত গত ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে তিনি কর্মস্থলে যান। কিন্তু দুপুরের খাবারের জন্য কর্মস্থল থেকে বের হলেও আর ফেরেননি তিনি। এক পর্যায়ে ওই দিন রাত ১১টার দিকে ডিএমপির পল্টন থানা থেকে ফোনে পরিবারের সদস্যদের তার মৃত্যুর খবরটি জানানো হয়। তারপর পরিবারের সদস্যরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে তার লাশ নিয়ে যান। তবে তার মৃত্যু নিয়ে রহস্য ঘিরে বসেছে।

পুলিশ প্রথমে গণমাধ্যমে বলছিল, মাসুদকে ইয়াবাসহ আটক করা হয়েছে। থানায় নিয়ে আসার পর নেশা করতে চাইছিল। কিন্তু নেশা না করতে পারায় সে থানা হাজতে পড়ে যায় এবং সেই সময় মাথায় আঘাত পায়। এরপর ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তবে পরবর্তীতে মাসুদের স্বজনদের বলা হয়েছে; গ্রেফতারের পর থানা হেফাজতে থাকাকালে মাসুদ দেয়ালে মাথায় আঘাত করে নিজেই আত্মহত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, এ ঘটনার জন্য মাসুদের পরিবারের কাছে পুলিশ ক্ষমাও চেয়েছে। এমনটাই বলছেন, মাসুদের বড় ভাই আব্দুর রফিক। তিনি বলেন, খবর পেয়ে আমরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যাই। সেখানে থেকে লাশ ময়নাতদন্ত শেষে বাড়ি নিয়ে আসি। তবে পুলিশের আশ্বাসের কারণে আমরা মামলা করিনি।
পুলিশ কি আশ্বাস দিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ঘটনার পর পুলিশ লাশ দাফন করার জন্য কিছু টাকা দিয়েছে। সেই টাকা দিয়ে আমরা লাশ দাফন করেছি। এছাড়া মাসুদের দুই মেয়ে সন্তান রয়েছে। বড় মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। এসএসসি পাস করার পর তাকে একটা সরকারি চাকরি দেয়া এবং তাদের বসবাসের জন্য একটি ঘর নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছে পুলিশ। এই আশ্বাসের পর আমরা মামলা করতে যাইনি। আর মামলা করেও কী লাভ? কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমরা গরীব মানুষ। পরিবারের সবাই পোশাক কারখানায় চাকরি করি। মামলা করার মতো টাকাও নেই। তাই পুলিশের আশ্বাসের উপর বিশ্বাস করেই বসে আছি।

সরেজমিন নিহত মাসুদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তার বড় ভাই ও ছোট ভাইয়ের টিনসেটের দুটি ভাঙা ঘর রয়েছে। তবে তার কোনো ঘর নেই। স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক বছর আগে মাসুদের স্ত্রী রেহানা আক্তার অসুস্থ হয়েছিলেন। তখন তার বসত ভিটাটিও বিক্রি করে দেন। এরপর থেকে তিনি কাঁচপুরে ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। দীর্ঘ দিন থেকে তিনি ফয়সাল রোলিং মিলে কাজ করছিলেন। কখনোই তিনি মাদক সেবন বা ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন না বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। শুধু স্বজনরাই নয়, গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলেই একই তথ্য পাওয়া গেছে। স্বজনরা জানান, এটা পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। তাকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনার বিচার দাবি করেন তারা।

এদিকে, মাসুদের দাফনের পর স্ত্রী রেহেনা আক্তার দুই সন্তানকে নিয়ে তার পিতার বাড়িতে অবস্থান করছেন। তার পিতা সোনারগাঁও থানার কাঁচপুর ইউনিয়নের পশ্চিম বেহাকৈর ১/৩ নম্বর রোডের ১৬৩ নম্বর বাড়িতে বসবাস করেন। সরেজমিন সেই বাসায় যাওয়া হলেও মাসুদের স্ত্রী রেহেনা আক্তারের সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। এসময় মাসুদের শাশুড়ি পরিচয় দিয়ে এক নারী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, এ ঘটনায় আমরা খুব মর্মাহত। আমরা ধৈর্য্য ধারণ করেছি। মামলা করে তো মাসুদকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাই আমরা মামলা করছি না।

তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, মাসুদ কখনোই মাদক সেবন বা ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল না। তারপরও তার উপর এমন অপবাদ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিদিনের মত গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভোরে মাসুদ কর্মস্থলে গিয়েছিল। এরপর আর ফিরে আসেনি। রাতে পুলিশের মাধ্যমে তার মৃত্যুর খবর পেয়ে ঢামেক হাসপাতালে গিয়ে লাশ দেখেছি। এর চেয়ে আর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

এদিকে, মাসুদের কর্মস্থলের অবস্থান কাঁচপুরের যাত্রামুড়া এলাকায়। সরেজমিন সেই কারখানায় গিয়ে জানা যায়, তিনি ওই কারখানার কাটার মিস্ত্রির কাজ করতেন। প্রতিদিনের মত গত ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে তিনি কাজে যান। টানা দুপুর পর্যন্ত কাজ করে খাবারের জন্য কারখানা থেকে বের হন। এরপর আর কারখানায় ফিরে আসেননি।
কামরুল ইসলাম নামের মাসুদের এক সহকর্মী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, মাসুদ খুব পরিশ্রমী ছিল। সে সব সময় দায়িত্ব নিয়ে কাজ করত। কখনোই সে মাদক সেবন বা ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল না। শুধু কামরুলই নয়, ওই কারখানার প্রায় সব শ্রমিকই মাসুদ সম্পর্কে একই কথা বলেছেন। এমনকি দীর্ঘ দিন ওই কারখানায় কাজ করায় আশপাশের দোকানিদের সাথেও ভালো সম্পর্ক ছিল মাসুদের। দোকানিরাও মাসুদ সম্পর্কে ভালো মন্তব্য করেছেন।

ফয়সাল রোলিং মিলের ম্যানেজার মিজানুর রহমান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, মাসুদ নিয়মিত কাজে আসত। সময় মত কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরত। হাজিরা খাতায়ও নিয়মিত স্বাক্ষর করত সে। কাজে কখনো সে ফাঁকি দিত না। এছাড়া তার বিরুদ্ধে কখনোই খারাপ কিছু শুনিনি।
একটি সূত্র জানায়, গত ২৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে মাসুদকে কাঁচপুর এলাকা থেকে ধরে নিয়ে আসেন গুলিস্তানের কয়েকজন যুবক। পরে গুলিস্তানের পুলিশের সোর্স দুলাল ও কবিরের নেতৃত্বে তাকে মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়েন মাসুদ। পরে পল্টন থানার এসআই এনামুল হকের কাছে ইয়াবাসহ মাসুদকে হস্তান্তর করেন দুলাল ও কবির। থানায় নিয়ে যাওয়ার পর মাসুদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। এক পর্যায়ে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে মৃত্যুর সংবাদটি মাসুদের স্বজনদের জানায় পুলিশ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পল্টন থানার এসআই এনামুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, গুলিস্তান থেকে ইয়াবাসহ মাসুদকে গ্রেফতার করা হয়। পরে থানায় নিয়ে আসার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
পল্টন মডেল থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, থানার একটি রুমের দেয়ালের সাথে মাথায় আঘাত করে মাসুদ রানা। এটার একটি ভিডিও ফুটেজও রয়েছে। এরপর তাকে দ্রæত হাসপাতালে নেয়া হয়। তখন চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে এখনো ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। নিহতের সন্তানদের বাড়ি করার আশ্বাসের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে এমন কোনো আশ্বাস দেয়া হয়নি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পুলিশ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ