চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
অনেকের ধারনা ও বিশ্বাস যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের তেমনকোন অবদান নেই। এ বিশ্বাস ও চেতনা সম্পূর্ণ ভুল। জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলমানদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। রসায়ন, পদার্থ, চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে মুসলমানদের অবদান অবিস্মরণীয় যা আমরা অনেকে জানিনা। নিম্নে মুসলিম মনীষীদের জ্ঞানবিজ্ঞানে যে অপরিসীম অবদান রয়েছে তার ধারবাহিক বিবরণ দেওয়া হলো:-
ওমর খৈয়াম : অ্যানলিক্যাল জ্যামিতির জনক বলা হয় ওমর খৈয়ামকে।সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তিনি জন্মগ্রহন করেন। শৈশবের কিছু সময় কেটেছে আফগানিস্তানের বলখ শহরে। দিনের বেলায় তিনি জ্যামিতি ও বীজগণিত পড়াতেন এবং রাতে ইমাম মোয়াফেফ্ক নিশাপুরির দরবারে পরামর্শ প্রদান করতেন। জীবদ্দশায় ওমর খৈয়ামের খ্যাতি ছিল গণিতবিদ হিসেবে। তিনি প্রথম উপবৃত্ত ও বৃত্তের ছেদকের সাহায্যে ত্রিঘাত সমীকরনের সমাধান করেন। ওমর খৈয়ামের বড় অবদান ইউক্লিডের সমান্তরাল স্বীকার্যের সমালোচনা যা পরবর্তী সময়ে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সূচনা করে। ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে তার পুস্তক ‘মাকালাত ফি’ আল জার্ব আল মুকাবিলা প্রকাশিত হয়। এ পুস্তকে তিনি দ্বিঘাত সমীকরনের সমাধানের নিয়মাবলি লিপিবদ্ধ করেন।
আল বিরুনি : বিশ্বের সেরা ভু-গোলবিদ আল বিরুনি পারস্যে জন্মগ্রহণ করেন। ২০ বছর বয়সে তিনি জ্ঞান অজর্নের জন্য সারাবিশ্ব ভ্রমন করেন। ৯৯৮ খৃষ্টাব্দে তিনি উত্তর ইরানের জুরজান নামক শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এ শহরেই তিনি তার গবেষনা চালিয়ে যান বই লেখেন এবং জ্ঞান অর্জনে রত থাকেন। আল বিরুনি ভু-বিদ্যার একজন পথ প্রদর্শক। তিনি শতাধিক বিভিন্ন প্রকার ধাতু ও রত্নপাথর সংগ্রহ করে সেগুলো পরীক্ষা করেন। একাদশ শতাব্দীতে পৃথিবী কীভাবে এর কক্ষপথে ঘূর্নায়মান এর প্রমাণ দেন। তিনি স্থিতি বিদ্যা ও গতিবিদ্যাকে একত্রিত করে বলবিদ্যা নামক গবেষনার নতুন ক্ষেত্রের প্রবর্তন করেন।
আল রাজি : গুটি বসন্ত আবিষ্কারক আবু বকর মুহাম্মদ ইবন জাকারিয়া আল রাজি ৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের তেহরানে জন্মগ্রহন করেন। আল রাজি ছিলেন একজন দক্ষ পারশিয়ান চিকিৎসক ও দার্শনিক। তিনি চিকিৎসাবিদ্যা, পদার্থ বিদ্যা, আলকেমি ও অন্যান্য বিষয়ের উপর ১৮৪ টিরও বেশী বই লিখেছেন। তিনি সালফিউরিক এসিড ( ঐ২ঝঙ৪ ) আবিষ্কার করেন। তিনি ইথানল উৎপাদন, বিশোধন ও চিকিৎসায় এর ব্যবহার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন।
আল ফারাবি : বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আল আরাবির আসল নাম আবু নাসের মুহাম্মদ ইবনে ফারাখ আল ফারাবি। তার পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন পারস্যের অধিবাসী। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় ফারাবায়। সেখানে শিক্ষাজীবনের কিছুদিন পর তিনি বোখরায়। তার পর উচ্চ শিক্ষা লাভেরে জন্য বাগদাদে চলে যান। সেখানে তিনি সুদীর্ঘ ৪০ বছর অধ্যয়ন ও গবেষনা করেন। পদার্থ বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। তবে বিজ্ঞান ও দর্শনে তার অবদান ছিল সর্বাধিক। পদার্থ বিজ্ঞানে তিনিই ‘শূন্যতার’ অবস্থান প্রমান করেছিলেন।
আল বাত্তানি : ৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মোসোপটেমিয়ার অন্তর্গত বাত্তান নামক স্থানে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ছিলেন একজন অঙ্কশাস্ত্রবিদ ও জোতির্বিদ। তিনি সর্বপ্রথম নির্ভুল পরিমাপ করে দেখিয়েছেন যে, এক সৌর বছর ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে হয়। তিনি প্রমান করে দেখিয়েছেন সূর্যের আপাত ব্যাসার্ধ বাড়ে ও কমে। সূর্য ও চন্দ্র গ্রহন সম্পর্কেও তার বক্তব্য ছিল সুস্পষ্ট। আল বাত্তানি তার নিজস্ব উদ্ভাবিত যন্ত্র দিয়ে প্রমান করেছিলেন যে, সূর্য তার নিজস্ব কক্ষপথে গতিশীল। আল বাত্তানি ছিলেন একজন মশহুর জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞ। তিনি বহু বছর ধরে জ্যোতির্বিদ্যায় প্রচলিত ভূলগুলো সংশোধন করে এই শাখায় অনেক সংস্কার ও উন্নতি সাধন করেন। এই মহান মনীষী ৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ৭২ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।
ইবনে সিনা : ইবনে সিনা ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে বোখারা শহরে জন্মগ্রহন করেন। ইবনে সিনা দর্শন, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে শুরু করে যুক্তি বিদ্যা, হিসাব বিজ্ঞান, অঙ্ক ইত্যাদি বিষয়ে গবেষনা করেন। তিনি ১৬ বছর বয়সে সমকালীন জ্ঞানী গুণী, চিকিৎসক ও মনীষীদের পড়িয়েছেন। ফলে বুঝা যায় তিনি ছিলেন সে সময়কার বড় চিকিৎসক। কথিত আছে ইবনে সিনা যখন ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তেন তখন অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর উত্তর মাসসপটে স্বপ্নের মত ভাসত। তার জ্ঞানের দরজা খুলে যেত। বিখ্যাত চিকিৎসক হিসেবে সর্বত্র তার নাম ছড়িয়ে পড়ল। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি মুজমুয়া নামে একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন। ইবনে সিনা পদার্থ বিজ্ঞান দর্শন, ধর্মতত্ত¡, জ্যামিতি, গণিত, চিকিৎসা বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি তার সময়ের সেরা চিকিৎসক।
মুসা আল খাওয়ারিজমি : মুসা আল খাওয়ারিজমি পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারিজমি। তিনি মধ্য এশিয়ার খাওযারিজম নামক শহরে ৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন। তিনি পাটিগণিত, বীজগণিত, ভূ-গোল, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যামিতিতে প্রভূত ভূমিকা রাখেন। বীজগনিতে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তার “আলজাবর ওয়াল মুকাবিলা” বই থেকে জানা যায় তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠ মুসলিম। তিনি ছিলেন একজন জগৎবিখ্যাত গণিতবিদ। তার সময়ে গণিতে অনেক উন্নতি হয়। ভূ-গোল বিষয়ে ছিল তার বিরাট অবদান। তিনি তার প্রথম একটি বইয়ে অ্যালজেবরার নাম উল্লেখ করেন। তার এ বইটির নাম হলো আল জাবর ওয়াল মুকাবিলা। পাটিগণিত বিষয়ে তিনি একটি বই রচনা করেন, যা পরে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। বতর্মান যুগ পর্যন্ত গণিতের যে উন্নতি তার মূলে রয়েছে আল খাওয়ারিজমির অবদান। তার রচিত বই আলজাবর ওয়াল মুকাবিলা থেকে বীজগথিতের ইংরেজী নাম অ্যাল জেবরা উৎপত্তি লাভ করে।
ইবনুন নাফিস : ইবনুন নাফিস একজন বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞাননী। চিকিৎসা বিজ্ঞান ও আইনশাস্ত্রে তার অবদান অবিস্মরনীয়। ইবনুন নাফিস মানবদেহে রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি, শাশ্বনালি, হৃৎপিন্ড শরীরে শিরা উপশিরায় বায়ু ও রক্তের প্রবাহ ইত্যাদি সম্পর্কে বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেন। তিনি মানবদেহে রক্ত চলাচল সম্পর্কে গ্যালেনের মতবাদের ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন এবং এ সম্পর্কে নিজের মতবাদ সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন।
জাবির ইবনে হাইয়ান : বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান আল আজদি আস সুফি আল ওমাবি আরবের বাসিন্দা আজদি গোত্রের হাইয়ান ছিলেন তার পিতা। চিকিৎসক পিতার সন্তান হলেও সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারনে তার পিতাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করলে বাল্যকালে তিনি চরম দুঃখেকষ্টে পতিত হন। শৈশবে তিনি কুফায় বাস করে। তার পিতার মৃত্যুর পর তিনি আরবে ফিরে আসেন। কুফায় থাকাকালীন অবস্থায় তিনি রসায়ন শাস্ত্রে গবেষনা করেন এবং তথায় একটি রসায়ন গবেষনা গার প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিক ইতিহাস বিদরা ইহাকে পৃথিবীর প্রথম রসায়নাগার বলে অভিহিত করেন। রাসায়নশাস্ত্রের পাশাপাশি তিনি চিকিৎসা, খনিজ পদার্থ, দর্শন, যুদ্ধবিদ্যা, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি অবদান রাখেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ৫০০ সহ প্রায় ২ হাজার বই রচনা করেন এই মনীষী।
আল বলখি : জাফর ইবনে মুহাম্মদ আবু মাশার বলখি ছিলেন পারস্যের অধিবাসী। মুসলিম জ্যোতির্বিদদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। তিনি ছিলেন একই সাথে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক, গণিতবিদ। তার কাজ ও অবদান এখনো সর্বমহলে প্রশংসনীয়।
আল কিন্দি : আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল কান্দি ছিলেন কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইতিহাস, দর্শন ভাষাতত্ত¡, রাজনীতি, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে অবস্মরনীয় বিশারদ। আল কিন্দি ছিলেন গ্রিক, হিব্রু, ইরানি, সিরিয়াক ও আরবী ভাষায় পন্ডিত ছিলেন। তার বহুল পঠিত নানা বিষয়ে ২৬৫ খানা গ্রন্থ রচনা করেন।
আল সাইগ : প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ, যুক্তিবিদ, দার্শনিক, পদার্থবিদ মনোবিজ্ঞানী কবি এবং বিজ্ঞানী আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহিয়া ইবনে আল সাইগ। তিনি ইবনে বাজ্জাহ নামে বেশি পরিচিত। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে অভূতপূর্ন ভূমিকা রাখেন। উদ্ভিদ বিজ্ঞানে তার যথেষ্ঠ সুনাম ছিল।
আ’লা হযরত ইমাম আহমেদ বেরলভী (রহঃ) : আ’লা হযরত ইমামে আহমেদ বেরলভী ১০ ই শাওয়াল ১২৭২ হিজরী ১৪ই জুন ১৮৫৬ সনে ভারতের বেরলভীতে জন্মগ্রহন করেন। আ’লা হযরত ইমাম বেরলভী যুক্তিবিদ্যা, গণিত, জ্যোর্তিবিদ্যা ও জ্যামিতিতে যথেষ্ট অবদান রয়েছে। বীজ গনিতে, ত্রিকোনোমিতি ছাড়াও তিনি লগারিদমের ধারনাকে সুবিন্যস্ত করেন। ধর্মীয় বিষয়াবলীতে গভীর ব্যুৎপত্তি অজনের পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতিসহ সকল বিষয়ে তাঁর অবদান সমসাময়িক ভারত ও পশ্চিমা বিজ্ঞানের হতবাক করে দিয়েছে। তাই জ্ঞানীরা তাকে জ্ঞানী নয় জ্ঞান বলেই মেনে নিয়েছে। আ’লা হযরত শব্দতত্ত্বের উপর ১৩৩৬ হিজরীতে, আল-বারানু শাফিয়া সিফনোগ্রাফিয়া কিতাবটি রচনা করেন। আ’লা হযরত পদার্থ বিজ্ঞানে আলোক রশ্মিতত্ত্ব নিয়ে গবেষনা করে রিফ্লেকশন অব লাইট, টোটাল ইনটারনাল রিফ্লেকশন, থিত্তরিস অব লাইট, লস অব লাইট জিওমেট্রিক অবটিকস, অ্যাটমস্ফিয়ার রিফ্রেকশন, রিভারসাল রেইস অব লাইট এন্ড ফরমেশন ইমেজ ইত্যাদি বিষয়ে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।