Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুসল্লিদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বাস্তবোচিত আহবান

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০৯ এএম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বাস্তবতাকে সব চাইতে অধিক মূল্য দেন, তার প্রমাণ তিনি আবারও দিলেন। তিনি শুধু দেশের প্রধানমন্ত্রী নন, একটি রাজনৈতিক দলের সভানেত্রীও। সেই নিরিখে তিনি তাঁর নিজ দলের নেতা-নেত্রীদের যে দায়িত্ব দিতে পারতেন তা না দিয়ে দায়িত্ব দিলেন দেশের মুসল্লিদের ওপর, দেশের জনগণকে তথা বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করতে বললেন তাদের।

এর হেতু কী? হেতু অবশ্যই আছে। একটা কথা প্রথমেই বলা দরকার, বাংলাদেশ আসলে একটি বড় গ্রাম। প্রকৃত বাংলাদেশের সন্ধান পেতে হলে আমাদের অবশ্যই এটা মনে রাখতে হবে। প্রকৃত বাংলাদেশের একটি বৈশিষ্ট্য হলো মানুষ কি হিন্দু কি মুসলমান- তারা ধর্মকে জীবনে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। যদিও সকল মানুষ সব সময় বাস্তব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেরা ধর্মীয় বিধান সঠিকভাবে পালন করে না, তবুও ধর্মকে সব সময়ই শ্রদ্ধা করে থাকে।

যেহেতু বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। তাই এদেশের মানুষের মধ্যে যারা বাস্তব ক্ষেত্রে ধর্ম পালনে অধিক আন্তরিক এবং নিয়মিত তাদের সম্মান ও মর্যাদাই আলাদা। সে কারণে বলা চলে, বাংলাদেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে যারা নিয়মিত নামাজ আদায় করেন, তাদের মর্যাদা সর্বোচ্চ। তাই প্রধানমন্ত্রী যে বলেছেন, মুসল্লিরা যেন সাধারণ মানুষকে সচেতন করে, প্রধানমন্ত্রীর এ উপদেশ গভীর তাৎপর্যব্যঞ্জক ও বাস্তবতা ভিত্তিক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ধর্মনিরপেক্ষতা হলেও এ বৈশিষ্ট্যের অর্থ কোনক্রমেই ধর্মহীনতা নয়। বরং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মানুষের নিজ নিজ বিশ্বাস অনুসারে ধর্মীয় বিধান পালনের নামই ধর্মনিরপেক্ষতা। এখানে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই।

কয়েক বছর আগের কথা। প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা সংঘটিত হচ্ছিল। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে কয়েকজন ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে এসেছিলেন এদেশের বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে। তাদের আশঙ্কা ছিল, হিন্দুপ্রধান ভারতে যখন মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা হচ্ছে, তখন মুসলিম প্রধান বাংলাদেশেও নিশ্চয়ই তার প্রতিক্রিয়ায় হিন্দুবিরোধী দাঙ্গার পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।

তারা অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, ভারতের ঐ মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার কোনো প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি হয়নি বাংলাদেশে। এর কারণ আবিষ্কার করতে গিয়ে এদেশের সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠির সাথে আলাপ-আলোচনা করে তারা বুঝতে পারলেন, ভারতের এক শ্রেণির দাঙ্গাবাজ হিন্দু সে দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে জুলুম-অত্যাচার চালালেও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধিবাসীরা তার প্রতিক্রিয়ায় এদেশের অসহায় হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কোনোরূপ অন্যায় আচরণ করা সমর্থন করেন না। এব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত জীবনেও কিছু অভিজ্ঞতা আছে, যার একটি এখানে উল্লেখ করছি।

১৯৭১ সালের কথা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমি তখন নিজ গ্রাম রাজবাড়ী জেলার দাদপুরে অবস্থান করছিলাম। সেই বিশেষ দিনটির কথা এখনও আমার মনে আছে। ভোর বেলায় আমার বাড়িতে কয়েকজন হিন্দু তরুণ এসে হাজির। আমি তাদের কাছে এত ভোরে বাড়িতে আসার কারণ জানতে চাইলে তারা সে কথার উত্তর না দিয়ে বলতে লাগল স্যার, আপনি আমাদের মুসলমান বানিয়ে দেন।

বলা বাহুল্য, এরা সকলেই ছিল ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে আমার অধ্যাপনাকালীন ছাত্র। তারা আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শুধু বারবার তাদেরকে মুসলমান করে দেয়ার অনুরোধ জানাতে লাগল। অনেক পরে জানতে পারলাম, তাদের এই পুনঃ পুনঃ মুসলমান করে দেয়ার আবেদনের পেছনে রয়েছে একটি দুঃখজনক ঘটনা। আমাদের গ্রামের পশ্চিম পাশে যে এলাকায় তাদের বসবাস, সেখানে বিহারীরা আক্রমণের হুমকি দিয়েছে।

আমি তখনি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলাম। আমার বেশ মনে আছে, সেদিন ছিল শুক্রবার। আমাদের সাপ্তাহিক হাটের পাশে যে মসজিদ ছিল সেখানে আমার বড় ভাই মৌলভী আবদুস শুকুর জুমআর নামাজ পড়াতেন। আমি তাঁকে বলে ঐ শুক্রবারের জন্য আমি ঐ জুমআর নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব নিলাম। জুমআর নামাজের পূর্বে আলোচনায় আমি হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিহারীরা যে আক্রমণ করতে চাচ্ছে তা যে ইসলামবিরোধী কাজ তা ব্যাখ্যা করলাম।

এরপর হাট শুরু হলে হাটের মাঝখানে একটা চৌকির উপর চেয়ার বসিয়ে হাটে উপস্থিত জনগণের কাছে জোর বক্তৃতা দিয়ে বললাম, বিহারীরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে যে আক্রমণ চালানোর পাঁয়তারা করছে তা ইসলামী আদর্শের বিরুদ্ধে। আসুন, আমরা এতে বাধা দিয়ে ইসলামী আদর্শের মর্যাদা রক্ষা করি। এই বলে হাটের লোকদের প্রতি আহবান জানিয়ে হিন্দু পাড়ার দিকে রওনা দিলাম। এর মধ্যেই খবর পেয়েছিলাম বিহারীরা হিন্দুপাড়া আক্রমণ করেছে। আমার সাথে সাথে হাটের অনেকে গেল। আমাদের হাতে অস্ত্র নেই, অথচ বিহারীদের কাছে অস্ত্র আছে এই কথা জানিয়ে অনেকে আমার এভাবে যাওয়াটা কতটা সঠিক হবে, প্রশ্ন তুললেও আমি এসবের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে আক্রান্ত হিন্দু মহল্লার দিকে রওনা দিলাম।

আমাদের আসার খবর পেয়েই আক্রমণকারী বিহারীরা হিন্দু পাড়া ছেড়ে চলে যায়। তবে তাদের ধ্বংসাবশেষের কিছু চিহ্ন রেখে যায়। আমি সেখানে গিয়ে পাশের মহল্লার মুসলমানদের নিয়ে রিলিফ কমিটি গঠন করে দিলাম এবং যে কোনো মূল্যে অসহায় হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাকিদ দিলাম। পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হলো।

এখানে একটা অবাক হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করতে হচ্ছে। এরপর আমি অনেক দিন বাড়ি যাইনি। এলাকার পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত ছিল। তাই গ্রামে যাওয়ার গরজ অনুভব করিনি। সেই পরিস্থিতিতে যেসব ছাত্রের অনুরোধে আমি স্বপ্রণোদিত হয়ে বিহারীদের দাঙ্গাবাজি ঠেকাতে গিয়েছিলাম, তাদের অনেকেই নাকি বলাবলি করে যে, কী গফুর স্যার তো এখন আর আসে না ইসলামের আদর্শ নিয়ে বড় বড় বক্তৃতা দিতে। বলা বাহুল্য ততদিনে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। এখন অনেক হিন্দুর ধারণা, যেহেতু পাকিস্তান ভেঙে গেছে, তাই এখন আর হিন্দুদের কোনো ভয় নেই। তাছাড়া পাকিস্তান ভাঙতে ভারতের সাহায্য ছিল। এখন হিন্দুদের জয় আসবে।

এসব দেখে মনে হয়, বাংলাদেশ যে শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে অন্যতম মুসলিম দেশ হিসাবে স্বীকৃত হবে? তা তখনও অনেক সাম্প্রদায়িকমনা হিন্দু বুঝতে পারেনি। এ মনোভাবের সমর্থন মেনে পশ্চিমবঙ্গের এক শ্রেণির হিন্দুর কিছু মন্তব্য থেকেও। তারা বলেন, ইন্দিরা গান্ধীর পিতা জওহরলাল নেহরু একটা পাকিস্তান করেছিলেন। আর তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী তৈরি করেছেন দু’টি পাকিস্তান। একটি আসল পাকিস্তান। আরেকটি বাংলাদেশ।

আজকের লেখা শুরু করেছিলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য দিয়ে। যে বাংলাদেশ প্রধানত গ্রামভিত্তিক সে বাংলাদেশের মুসল্লিরা যেন সাধারণ মানুষকে সামনে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ধর্মপরায়ণ মুসল্লিদের প্রতি সাধারণ মানুষদের আস্থা অধিক।
যেহেতু দেশের সাধারণ মানুষ ধর্মের খুঁটিনাটি পালন করুক বা না করুক, তারা সবাই ধর্মপরায়ণ মুসল্লিদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাশীল তাই তাদের উপদেশ অনুসারে চললে দেশে শান্তি বিরাজ করবে এবং একই সাথে তারা উপকৃত হবে। বাংলাদেশের মেজরিটি মানুষদের যে ধর্ম ইসলাম তা কোনোদিনই সাম্প্রদায়িকতাকে বিশ্বাস করে না। বরং সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় যারা সংখ্যালঘু তাদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণকে নিশ্চয়তা দেয়। সুতরাং বাংলাদেশ যেহেতু একটি মুসলিম প্রধান দেশ, তাই এদেশের সংখ্যালঘুরা সব সময়ই নিরাপদ প্রতিবেশী দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক আচরণ ও মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা সত্তে¡ও তারা পাল্টা এদেশে কোনো সংখ্যালঘু হিন্দু বা অন্যদের ধর্মীয় স্বাধীনতার পথে কোনো বাধা সৃষ্টি করে না। কারণ, এটাই ইসলামের নীতি ও আদর্শ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রধানমন্ত্রী


আরও
আরও পড়ুন