চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
নবীজী সা. এর প্রতিটি সুন্নত ও শিক্ষাই আমাদের কাছে এই দাবি রাখে যে, আমরা যেন তা গুরুত্বের সাথে অনুসরণ করি। আর সেটা যদি হয় ‘সুন্নাতে মুআক্কাদা’ তাকিদপূর্ণ সুন্নাত তাহলে তা অনুসরণ করা আরো গুরুত্বপূর্ণ। কর্মজীবনে তা চর্চা না করা আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ।
দৈনন্দিন জীবনে বহু সুন্নত এমন রয়েছে, যার উপর আমল করা আমাদের পক্ষে কঠিন কিছু নয়। একটু সচেতন হলে খুব সহজেই আমরা সেগুলো পালন করতে পারি। অনেক সুন্নত আছে, যা অন্য কোনো ফরয বিধানের পরিপূরক হিসেবে অথবা তার আগে পরে আদায় করতে হয়। তাই অতি সহজে আমরা এ সুন্নতগুলো উক্ত ফরযের সাথে আদায় করে নিতে পারি।
যেমন : পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযের আগে-পরের সুন্নত নামায, নামাযের ভিতরের সুন্নতসমূহ, অযুর সুন্নতসমূহ ইত্যাদি। যেগুলো আমরা ফরযের সাথে সাথেই আদায় করে থাকি। ফলে এ সুন্নতগুলো আদায় করা আমাদের কাছে খুব ভারী মনে হয় না। তবে এর মধ্যেই কিছু সুন্নত এমন রয়েছে, অজ্ঞতা বা অবহেলার কারণে যেগুলো আমাদের থেকে ছুটে যায়। এরকম একটি সুন্নত হচ্ছে মিসওয়াক। মিসওয়াক একটি সুন্নত এবং দ্বীনের অংশ। তা শুধুই দাঁতের ময়লা ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য নয়; বরং তার আসল উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। হাঁ, দুর্গন্ধ ও ময়লা দূর হওয়াও এর একটি উদ্দেশ্য। ইসলামের প্রতিটি বিধানই ইহকালীন ও পরকালীন উভয় প্রকার কল্যাণে পরিপূর্ণ।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং সুন্দর ও উত্তমরূপে চলা ইসলামের সর্বব্যাপী শিক্ষা। একটি হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা. পরিচ্ছন্ন থাকা এবং উত্তম বেশ-ভূষা ধারন করাকে একজন মুসলিমের একটি বিশেষ প্রতিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যার মাধ্যমে চেনা যাবে যে, সে একজন মুসলমান। এক সফরে তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে বললেন- যারা নিজেদের ভাইদের সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন- তোমরা তোমাদের ভাইদের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছ। তাই নিজেদের বাহন ও আসবাবপত্র ঠিকঠাক ও পরিপাটি করে নাও এবং সুন্দর ও উত্তম বেশ-ভূষা ধারন কর; যেন মানুষদের মাঝে তোমাদেরকে তিলকের মত মনে হয়। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪০৮৯; মুসতাদরাকে হাকেম ৪/২০৩)।
আম্মাজান আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, একবার কিছু সাহাবী ঘরের দরজায় রাসূলুল্লাল্লাহ সা. এর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। নবীজী তাদের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা করলেন। তখন আমি লক্ষ করলাম, ঘরের একটি বালতিতে রাখা পানিতে তিনি চেহারা দেখছেন এবং নিজের চুল ও দাড়ি পরিপাটি করে নিচ্ছেন। এ দেখে আমি বললাম, হে আল্লাহর প্রিয় রাসূল! আপনিও এমনটি করেন? জবাবে তিনি বললেন, অবশ্যই করি। প্রত্যেক ব্যক্তিরই উচিত, যখন সে তার ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা করে তখন নিজেকে প্রস্তুত ও পরিপাটি করে নেওয়া। কেননা, আল্লাহ পাক সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকেই ভালোবাসেন। (ই‘তিলালুল কুলূব, খারাইতী, পৃ. ১৬৬; আমালুল ইয়াওমি ওয়াললায়লাহ, ইবনুস সুন্নী, হাদীস ১৭৩)।
যে সকল বিষয়ে বিশেষভাবে পরিচ্ছন্নতা কাম্য, এগুলোর মধ্যে আছে, বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, আসবাব-পত্র, লেবাস-পোশাক, শরীর, মাথা, চেহারা ইত্যাদি। এগুলোর প্রত্যেকটির পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আর মুখের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে পঞ্চাশ বা এরও অধিক সাহাবী হতে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আল্লামা ইবনুল মুলাক্কিন রাহ. তাঁর সংকলিত ‘আলবাদরুল মুনীর গ্রন্থে মিসওয়াক সম্পর্কে একশ’র বেশি হাদীস উল্লেখ করার পর বলেন, মিসওয়াকের বিষয়ে হাদীসের এই ভাÐার একটি বিশাল ব্যাপার। হায় আফসোস!! একটি সুন্নত, যার ব্যাপারে এত অধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে আজ বহু মানুষ সে সুন্নত পালনে উদাসীন। (আলবাদরুল মুনীর ২/৬৮)।
মিসওয়াকের প্রতি রাসূলুল্লাহ সা. খুবই যতœবান ছিলেন। যা ইসলামী শরীয়তে মিসওয়াকের বিশেষ মর্যাদার প্রমাণ। হাদীস শরীফে এসেছে, তিনি যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর, বারবার ঠাÐা পানিতে হাত ভিজিয়ে চেহারায় মুছছিলেন, আর বলছিলেন, ‘নিশ্চয়ই মৃত্যুর রয়েছে অনেক যন্ত্রণা।’ তিনি মিসওয়াকের কথা ভোলেননি। এমনকি অন্যের কাছ থেকে মিসওয়াক চেয়ে নিয়ে মিসওয়াক করেছেন। মৃত্যুযন্ত্রণায় তাঁর শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তিনি নিজে মিসওয়াক চিবুতে পারছিলেন না। আম্মাজান আয়েশা রা. তা চিবিয়ে দিয়েছেন। এরপর তিনি তা দিয়ে মিসওয়াক করেছেন। মিসওয়াকের ব্যাপারে ছিল এত যতœ, এত আগ্রহ। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৯০, ৪৪৪৯, ৫৬১০)
শুধু নিজে আমল করেই নয়, অনেক বাণীর মাধ্যমেও তিনি এই সুন্নতটির প্রতি উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। এক হাদীসে ইরশাদ করেছেন, ‘যদি আমার উম্মতের জন্য কঠিন না হত, তাহলে প্রতি নামাযের সময় মিসওয়াক করাকে আমি অপরিহার্য করে দিতাম।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৮৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫২)। অন্য রেওয়ায়েতে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, ‘কঠিন না হলে, প্রতি অযূর সময়ই আমি মিসওয়াকের নির্দেশ দিতাম।’ (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৫৩১; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১৪০)। মুসলিম শরীফের এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, ‘দ্বীন ইসলামের স্বভাবজাত দাবি দশটি, যার অন্যতম প্রধান হল, মিসওয়াক করা।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬১)।
আরেক হাদীসে এসেছে, ‘তোমরা মিসওয়াক কর। কেননা, তা মুখের পবিত্রতার উপায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম। (ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৮৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১০৭০)। ওযু-নামায ছাড়াও যে সময়গুলোতে মিসওয়াকের প্রতি যতœবান থাকা একজন মুমিনের কর্তব্য তা হচ্ছে, নিদ্রা যাওয়ার পূর্বে। নিদ্রা থেকে জাগ্রত হওয়ার পর। কুরআন তিলাওয়াতের সময়। জুমা-ঈদ এবং কারো সাথে সাক্ষাতের সময়। তেমনি এমন কিছু পানাহারের পর, যা মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে। যেমন, পেয়াজ-রশুন। বাইরে থেকে ঘরে ফেরার পর। বাড়ি থেকে কোথাও বের হওয়ার সময়। দাঁতে ক্লেদ বা ময়লা জমলে। দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকা বা ক্ষুধার কারণে মুখে দুর্গন্ধ হলে।
উল্লেখিত সবগুলো সময়ের ব্যাপারেই হাদীসে নির্দেশনা পাওয়া যায়। এক হাদীসে এসেছে- নবীজী সা. রাতে ঘুম থেকে ওঠার পর, মিসওয়াক দিয়ে মুখ পরিষ্কার করতেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৫)। অন্য বর্ণনায় এসেছে- নবীজী সা. রাত-দিনের যখনই ঘুম থেকে জাগ্রত হতেন ওযুর পূর্বে মিসওয়াক করে নিতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫৭)। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, নবীজী সা. ঘরে প্রবেশের পর সর্ব প্রথম মিসওয়াক করতেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৩)। এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, ঘরে পরিবার-পরিজনের কাছে যাওয়ার পর প্রথমে নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নেওয়া উচিত।
যায়েদ বিন খালেদ রা. বলেন- নবীজী সা. কোনো নামাযের জন্য ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মিসওয়াক করে নিতেন। (আল মুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৫২৬১; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ২৫৬৯)। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরই উচিত, জুমার দিন গোসল করা, মিসওয়াক করা এবং সাধ্যানুযায়ী সুগন্ধি ব্যবহার করা। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৮০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৪৬)। এক বর্ণনায় এসেছে- তোমরা মিসওয়াক করার মাধ্যমে মুখ পরিষ্কার ও সুন্দর রাখো। কেননা মুখ কুরআন (উচ্চারিত হওয়ার) মাধ্যম। (শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ১৯৪০)।
হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার দুজন লোক নবীজীর কাছে এল। তাদের উভয়ের প্রয়োজন ছিল অভিন্ন। একজন নবীজীর সাথে কথপোকথন শুরু করল। তখন নবীজী তার মুখ থেকে দুর্গন্ধ পেলেন। তাই জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি মিসওয়াক কর? সে বলল করি, তবে তিন দিন যাবৎ আমি অনাহারে (তাই এ দুর্গন্ধ)। তখন নবীজী সা. এক সাহাবীকে (তার প্রয়োজন পুরা করার) নির্দেশ দিলেন। তিনি ঐ ব্যক্তির মেহমানদারি করলেন এবং তার প্রয়োজন পূর্ণ করলেন। (আলমুজামুল কাবীর, তবরানী, হাদীস ১২৬১১; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ১৬৮)। আরো বহু হাদীসে মিসওয়াকের ব্যাপারে তাকিদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।