চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
প্রতিটি পশু-পাখি মানবজাতির ন্যায় আল্লাহ তাআলার পরিবারের সদস্যভূক্ত ও নিরন্তরভাবে তারা আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, “তুমি কি দেখনা যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যারা আছে, তারা এবং উড়ন্ত পক্ষীকুল তাদের পাখা বিস্তর করতঃ আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষনা করে? প্রত্যেকেই তার যোগ্য ইবাদত এবং পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা ও পদ্ধতি জানে-(আল-কুরআন, ২৪:৪১)।
পশু-পাখি মানবজাতির খাদ্য-পুষ্টি, পোষাক-পরিচ্ছেদ, পরিবহন, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণসহ বিভিন্ন উপকারে ব্যবহার করে থাকে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন “তারা কি লক্ষ্য করে না যে, তাদের জন্যে আমি নিজ হাতে সৃষ্ট বস্তুদের মধ্যে সৃষ্টি করেছি গৃহপালিত জন্তু এবং তারাই এগুলোর অধিকারী। আমি এগুলোকে তাদের হাতে অসহায় করে দিয়েছি, ফলে এদের কতক তাদের বাহন এবং কতক তারা ভক্ষণ করে। তাদের জন্যে এগুলোতে আছে বহু উপকারিতা আর আছে পানীয় বস্তু। (আল-কুরআন, ৩৬:৭১-৭৩)।”
পশু-পাখি আল্লাহর নির্দেশে মানবজাতির বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ করার পাশাপাশি জীবন পর্যন্ত দিয়ে থাকে। কিন্তু মানবজাতি বিভিন্ন সময়ে তাদের সাথে অমানবিক আচরণ করে। তাদের প্রজনন, লালন-পালন, পরিবহণ, মালামাল বহন, ক্রয়-বিক্রয়, জবাই ও জবাই এর পরবর্তী পর্যায়েও তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করে থাকে। ইসলামী শরি‘আহ মানবজাতিকে পশু-পাখির সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর তাদের থেকে উপকার গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেছে।
মানবজাতি পশু-পাখি লালন-পালন ও মোটা-তাজা করতে গিয়ে তাদের অমানবিক আচরণ করে থাকে। অনিরাপদ বাসস্থান,অপর্যাপ্ত ও ভারসাম্যহীন খাদ্য প্রদান, সু-চিকিৎসার অভাবসহ নানাভাবে তারা নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা পশু-পাখিকে স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার দিয়েছেন। ইসলামী বিধানে পশু-পাখি লালন-পালন করতে হলে তাদের সার্বিক নিরাপত্তার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং তাদের অধিকার লংঘন ও অমানবিক আচরণে জন্য শাস্তির হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “সামুদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই সালেহকে। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর। তিনি ব্যতিত তোমাদের কোন উপাস্য নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে একটি প্রমাণ এসে গেছে। এটি আল্লাহর উষ্টী তোমাদের জন্যে প্রমাণ। অতএব একে ছেড়ে দাও, আল্লাহর ভুমিতে চড়ে বেড়াবে। একে অসৎভাবে স্পর্শ করবে না। অন্যথায় তোমাদেরকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি পাকড়াও করবে।(আল-কুরআন, ৭:৭৩)
মানবজাতির ন্যায় পশু-পাখিও খাদ্য-পানিয়সহ আল্লাহর অন্যান্য নিয়ামতের অংশীদার। আল-কুরআনে তাদের প্রাপ্য অংশ প্রদানের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে বিছানা বানিয়েছেন এবং তাতে তোমাদে জন্য চলার পথ করে দিয়েছেন। আর আসমান থেকে তিনি পানি বর্ষণ করেন; অতঃপর তা দিয়ে আমি সবিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ উৎপন্ন করি। তোমরা নিজেরা খাও এবং তোমাদের গবাদিপশু চরাও। অবশ্যই এতে বিবেকসম্পন লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে (আল-কুরআন ২০:৫২-৫৩)। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, একদা নবী করীম সাঃ এমন একটি উটের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যার অনাহারে পেট ও পিঠ একত্র হয়ে গিয়েছিল। তা দেখে মহানবী সা. বললেন, তোমরা এসকল বোবা পশুদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। এদেরকে দানাপানি দিয়ে সুস্থ্য সবল রাখ ও সুস্থ্য সবল পশুর পিঠে চড় এবং খাওয়ার সময়ও সুস্থ্য সবল প্রাণীর গোশত খাও।(সুনানে আবু দাউদ- ২৫৩৯)
ইসলাম পশু-পাখি লালন-পলনে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দিতে নিষেধ করেছে। আল্লাহ তাআলা আল-কুরআনে পশু-পাখির অমানবিক আচরণ করতে নিষেধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে,“(শয়তান বলে)তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব, তাদেরকে আশ্বাস দেব; তাদেরকে পশুর কর্ণ ছেদন করতে বলব এবং তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্ট আকৃতি পরিবর্তন করতে আদেশ দেব। যে কেউ আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরুপে গ্রহণ করে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়” (আল-কুরআন, ৪:১১৯)। হযরত আবূ সাইদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম সা. এক ব্যক্তির নিকট দিয়ে যাচ্চিলেন। লোকটি তখন একটি বকরীর কান ধরে হেচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তিনি বলেন: তুমি এর কান ছেড়ে দাও এবং ঘাড় ধর(ইবনে মাজাহ-৩১৭১)। পশু-পাখির শারিরিক নিরাপত্তা বিধানে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত মুজাহিদ বর্ণনা করেন যে, হযরত ইবনে উমর রা. চতুস্পদ জন্তুসমূহকে পরস্পরে লড়াই করিতে উদ্বুদ্ধ করাকে অত্যন্ত অপছন্দ করিতেন (আল-আদাবুল মুফরাদ-১২৪৯)
পশু-পাখি পরিবহনের সময় অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচারণ করা হয়ে থাকে। এ সময় তাদের দাঁড় করানো অবস্থায় গাদাগাদি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে স্থানান্তর করা হয়। দীর্ঘ যাত্রায়ও তাদেরকে খাদ্য-পানীয় থেকে দূরে রাখা হয়। ইসলাম পশু-পাখি পরিবহনের সময় পর্যাপ্ত খাদ্য, বিশ্রাম, শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের নির্দেশনা দিয়েছে। হযরত মূসা আ. মাদয়ান থেকে তার পরিবার বর্গ ও পশু পাল নিয়ে মিশরের দিকে যাওয়ার পথে তার লাঠির মাধ্যমে পশুপালের খাদ্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, (আল্লাহ তাআলা মূসা আ.কে জিজ্ঞাসা করলেন) হে মূসা তোমার ডান হতে হাতে ওটা কী? তিনি বললেন, এটা আমার লাঠি, আমি এর উপর ভর দেই এবং এর দ্বারা আমার ছাগপালের জন্য গাছের পাতা ঝেড়ে ফেলি এবং এতে আমার অন্যান্য কাজও চলে। ( আল-কুরআন, ২০: ১৮)
ইসলাম পশু-পাখি পরিবহনের সময় সকল প্রকার অনিষ্ট থেকে তাদের নিরাপত্তার নির্দেশনা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, “রাসূল সা. বলেছেন: যখন তোমরা উর্বর ভূমি দিয়ে চলাচল কর তখন উটকে ভূমি থেকে তার পাওনা আদায় করতে দিও। আর যখন দুর্ভিক্ষগ্রস্থ ভূমি দিয়ে পথ চল তখন তাড়াতাড়ি পথ অতিক্রম করবে এবং যখন কোথাও রাত যাপনের জন্যে অবতরণ করবে তখন পথে মঞ্জিল করবে না। কেননা, তা হচ্ছে জন্তুদের রাতে চলার পথ এবং ছোট ছোট অনিষ্টকর প্রাণীদের রাতের আশ্রয়স্থল” (মুসলিম-৪৮২৫)
ইসলাম পশু-পাখি পরিবহনের সময় মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে তাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করে তাদের শারীরিকি সুস্থ্যতার প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে আরেকটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, “হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন, আমরা দুপুরের সময় যখন কোন মনযিলে বিশ্রাম নেযার জন্যে ঘোড়া বা উটের পৃষ্ঠ হতে নামতাম,তখন এর পিঠ হতে মালপত্র ও গদি অপসারণ করে ভারবাহী পশুকে আরাম দানের পূর্বে নিজেরা কোন নামায পড়তাম না।”(সুনানে আবু দাউদ-২৫৪৩)
পশু-পাখি জবেহ করার সময়ও তাদের প্রতি অমানবিক আচরণের কারণে তাদের মৃত্যু যন্ত্রণা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এক পশুর সম্মুখে অন্যপশু জবাই করে শারীরিক মৃত্যুর পূর্বেই মনাসিক মৃত্যু ঘাটানো হয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পশু-পাখি জবাই, অদক্ষ কসাইয়ের মাধ্যমে জবাই, ধারহীন অস্ত্র দ্বারা জবাই, খুচিয়ে খুচিয়ে জবাই ইত্যাদি কারণে মানুষের জন্য জীবন দেয়া প্রাণীটির মৃত্যু যন্ত্রণা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ইসলামের নির্দেশ হলো: পশু জবেহ করতে হলে অবশ্যই তাকে যতটা কম সম্ভব কষ্ট দিয়ে পূত-পবিত্রতার সাথে জবেহ করা এবং জবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে হবে। আল-কুরআনে ইরশাদ করা হচ্ছে, “আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানী র্নিধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে অতএব তাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগনকে সুসংবাদ দাও” (২২:৩৪) এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত শাদ্দাদ ইবনে আস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমি আল্লাহর রাসূল সা. কে বলতে শুনেছি: আল্লাহ তা’আলা সকল বস্তুর উপর ইহসান ফরজ করেছেন। অতএব যখন তোমরা হত্যা করবে, তখন উত্তম পন্থায় হত্যা করবে আর যখন যবেহ করবে, তখন উত্তম পন্থায় যবেহ করবে। আর তোমাদের প্রত্যেকেরই ছুরিতে ধার দিয়ে নেওয়া উচিত এবং যবেহকৃত জন্তুকে ঠান্ডা হতে দেওয়া উচিত (নাসায়ী)।
ঈদুল আজহাসহ সারা বছরই পশু-পাখি দ্বারা মানববজাতি নানা কল্যাণ লাভ করে থাকে। আল্লাহর দেয়া এ বিশেষ নিয়ামত পশু-পাখির প্রতি সকল প্রকার নিষ্ঠুরতা পরিহার করে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের ইসলামী বিধানানুযায়ী পশু কুরবানির মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ ও সার্বিক কল্যাণ হাসিলের তাওফীক দান করুন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।