Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বন প্রজাদের স্বীকৃতি মেলেনি ৭০ বছরেও

কুয়াকাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল

কলাপাড়া (পটুয়াখালী) উপজেলা সংবাদদাতা : | প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

পটুয়াখালী বনবিভাগের কুয়াকাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ৭০ বছর ধরে বিনা বেতনে কাজ করার পরও স্বীকৃতি দেয়া হয়নি বন প্রজাদের। উল্টো অবৈধ দখলদার আখ্যা দিয়ে ভোগদখলীয় জমি ও বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদে নোটিশ দিয়েছে বনবিভাগ ও ভ‚মি প্রশাসন। পাকিস্তান আমলে ৩৩ বনপ্রজাকে ৪ একর করে জমি বরাদ্দ দিলেও সত্তর বছর পর বনবিভাগ এসব বন প্রজাদের বাড়িঘর ও ভোগদখলীয় জমি থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করছে বলে বন প্রজাদের অভিযোগ। এ নিয়ে বনবিভাগ ও ভ‚মি কর্তৃপক্ষের সাথে বন প্রজাদের বিরোধ চলছে। এমন পরিস্থিতিতে এসব ভুক্তভোগী বন প্রজারা বৈধতা পেতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
কুয়াকাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসবাসকারী বন প্রজা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৪৫ ও ১৯৫০ সালের দিকে পাকিস্তান আমলে কুয়াকাটা সমুদ্র উপক‚লীয় এলাকার বিরাণভ‚মিতে বাগান সৃজন করার লক্ষ্যে কক্সবাজারের মহেষখালীর সোনাদিয়ায় সমুদ্র ভাঙনে সহায়-সম্বলহীন ২৩ পরিবার ও বরগুনার কাকচিরা এলাকার ১০টি পরিবারকে বন সৃজন করার শর্তে ৪ একর করে জমি বরাদ্দ দেয় তৎকালীন মহিপুর বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা গোলাম কাদের সিকদার। এরপর থেকে এসব বন প্রজারা বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাস এবং চাষাবাদ করার মাধ্যমে ভোগদখল করে আসছে এসব বরাদ্দকৃত জমি।
বনবিভাগের শর্তানুযায়ী বন প্রজারা পটুয়াখালী জেলা ও বরগুনা জেলার কুয়াকাটা, লেম্বুর চর, গঙ্গামতির চর, কাউয়ার চর, চর মৌডুবী, চর মোন্তাজ, সোনার চর, ফাতরার বনসহ বিভিন্ন স্থানে বনবিভাগের নির্দেশে কাকড়া চারা, গোলগাছ, কেওড়া, কড়াই, রেইন ট্রি, নারিকেলসহ বিভিন্ন প্রজাতির চারা রোপণ করে আসছে। এ কাজের জন্য বন প্রজাদের কোন পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। বন প্রজাদের সৃজনকৃত বনের বয়স প্রায় ৬০-৬৫ বছর হয়ে গেছে। সৃজনকৃত এসব বনের অধিকাংশই সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে। ৩৩ বন প্রজা থেকে সন্তান ও নাতিসহ এখন ৬৭ পরিবার হয়ে গেছে। বরাদ্দকৃত ৩৩ বন প্রজাদের মধ্যে বেশির ভাগই মারা গেছে। দু’য়েকজন বেঁচে থাকলেও তারা বয়সের ভারে এখন আর চলাফেরা করতে পারছে না।
বন প্রজারা হিংস্র জীবজন্তুর সাথে লড়াই করে বিনা বেতনে বন পাহারা, বাগান সৃজন করার মাধ্যমে জীবণের ঝুঁকি নিয়ে বন বিভাগের নিয়ম মেনে প্রায় সত্তর বছর ধরে স্ত্রী সন্তান ও পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করে আসছে। ১৯৬৫ ও ১৯৭০ সালের জলোচ্ছ¡াসে এসব পরিবারের অনেকেই মারা গেছে। আবার কেউ কেউ বাগান সৃজন করতে গিয়ে বাঘের থাবায়ও মারা গেছে। জীবন যুদ্ধে লড়াই করা বন প্রজারা পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতেই বসবাস করে আসছিলো। এত বছর পর হঠাৎ করেই বনবিভাগ এসব বন প্রজাদের অবৈধ উল্লেখ করে বাড়িঘর ও চাষাবাদের জমি ছেড়ে দেয়ার জন্য বলে। বন প্রজারা কাগজ কলমে বৈধতা পেতে জনপ্রতিনিধি, বনবিভাগ, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দফতরে তাদের অবস্থান তুলে ধরে। দেশের বৈধ নাগরিক হিসেবে নিজেদের মৌলিক অধিকার আদায়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদনও করে বন প্রজারা।
কুয়াকাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসবাসরত বন প্রজারা অবৈধভাবে বন দখল ও বন উজাড় করছে মর্মে উল্লেখ করে তাদেরকে উচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত ৩ মার্চ প্রতিবেদন চেয়ে একটি চিঠি দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় কলাপাড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) জগৎবন্ধু মন্ডল গত ৬ আগস্ট ২০ জনের নাম উল্লেখ করে তাদের ভোগদখলীয় জমির স্ব-পক্ষীয় কাগজপত্র ও স্বাক্ষী প্রমাণসহ ৩ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে তদন্তকালে উপস্থিত থাকার জন্য প্রত্যেককে নোটিশ প্রদান করে। স্থানীয় ভ‚মি প্রশাসন তদন্তও করেন।
বন প্রজাদের হেডম্যান আ. কাদের, বন প্রজা আ. সোবাহান, গনেশ চন্দ্র মিস্ত্রী, মৌলভী মো. জবেদ আলী, মো. মতিউর রহমান, নজীর মাঝিসহ একাধিক বন প্রজারা অভিযোগ করেন, তৎকালীন সময়ে খুলনা বনবিভাগের আওতাধীন মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. গোলাম কাদের সিকদার অবৈতনিক বনপ্রজা হিসেবে ৩৩ জনকে নিয়োগ দেন। এসময় বন সৃজন করার শর্তে বাড়িঘর নির্মাণ ও চাষাবাদ করার জন্য প্রত্যেক পরিবারকে ৪ একর করে জমি প্রদান করেন। বন সৃজন ও পাহারার পাশাপাশি প্রায় ৭০ বছর ধরে বসবাস করে আসছে তারা। ওই সময়ে বনবিভাগ থেকে তাদেরকে একটি টোকেন দেয়া হলেও ১৯৬৫ ও ৭০ সালের জলোচ্ছ¡াসে তা হারিয়ে যায়।
বন প্রজারা বলেন, এতো বছর পর বনবিভাগ তাদেরকে অবৈধ দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করে ভোগদখলীয় জমি ও বাড়িঘর ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। বনপ্রজাদের অভিযোগ একদিকে তাদেরকে অবৈধ দখলদার বলছে অপরদিকে বনবিভাগ তাদেরকে বন প্রজা হিসেবে উল্লেখ করে বন সৃজনের জন্য চিঠি দেয়া হচ্ছে। বন প্রজারা এখনও বন সৃজন করে আসছেন। কাগজ কলমে তাদেরকে বৈধতার দাবিতে একাধিকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে। এ সময় বৈধতা দেয়ার কথা বলে সাবেক রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদসহ একাধিক কর্মকর্তারা দফায় দফায় মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। তারপরও বৈধতা দেয়া হয়নি তাদের। এ সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন ভুক্তভোগী বন প্রজারা।
এ বিষয়ে কথা হয় মাঠ পর্যায়ের তদন্ত কর্মকর্তা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) জগৎবন্ধু মন্ডলের সাথে। তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সরেজমিনে তদন্তে দেখা গেছে বন প্রজারা দীর্ঘ বছর ধরে এখানে বসবাস করে আসছে। বনবিভাগের বৈধ কোন কাগজপত্র দেখাতে না পারলেও নিজেদের বন প্রজা হিসেবে দাবি করেছে তারা। তাদের দাবিনামা সম্মিলিত তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, বন প্রজারা দীর্ঘ বছর বসবাস করে আসলেও তাদের স্বপক্ষে কোন কাগজপত্র নেই। আইন অনুযায়ী তারা অবৈধভাবে বসবাস করছে। বন প্রজারা জেলা প্রশাসক, বনবিভাগ ও প্রধানমন্ত্রী কাছে বৈধতার জন্য আবেদন করেছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বনাঞ্চল

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
২১ মার্চ, ২০২১
১৬ নভেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ