চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
এক
একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ খুবই বাস্তবধর্মী একটি কথা বলেছেন, মুসলমানরা যখন আঘাতপ্রাপ্ত হয় অথবা সমস্যায় জর্জরিত হয় তখন সর্বদিক থেকেই একটা প্রশ্ন গুঞ্জরিত হয়, ‘মুসলমানদের এখন কী করা উচিৎ।’ এটা একেবারেই অনর্থক একটি প্রশ্ন। এ প্রশ্নের কোনো অর্থ নেই। এটা অনেকটা এ ধরনের প্রশ্ন করার মতো- ‘ডাক্তারদের এখন কী করা উচিৎ, উকিলদের এখন কী করা উচিৎ, ইঞ্জিনিয়রদের এখন কী দায়িত্ব?।’ এটা স্পষ্ট, এ জাতীয় প্রশ্ন কারার প্রয়োজন নেই। ডাক্তারদের ডাক্তারি করা উচিৎ। ইঞ্জিনিয়রদের ইঞ্জিনিয়ারি করা উচিৎ। উকিলদের ওকালতি করা উচিৎ। ঠিক তেমনিভাবে এই উম্মতে মুসলিমাহ -যাদেরকে আল্লাহ তাআলা শ্রেষ্ঠ উম্মত বানিয়েছেন- তাদেরকে পাঠানোর উদ্দেশ্যই হলো দাওয়াত দেয়া। দাওয়াত তাদের নিদর্শন। দাওয়াত তাদের পেশা। তাই এই দাঈ উম্মতকে দাওয়াতের কাজই করা উচিৎ। এখানেও এই প্রশ্ন করার অবকাশ ও অর্থ নেই যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা উচিৎ? উম্মতে মুসলিমাহকে পাঠানোর মূল উদ্দেশ্যই হলো দাওয়াত দেয়া। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোনো মূল্যে আমাদের দওয়াতের কাজই করা উচিৎ। হ্যাঁ, এটা বিষয় যে, কোন্ ময়দানে কোন্ পদ্ধতিতে কাজ করা যেতে পারে; কোন্ পদ্ধতি অবলম্বন করলে সেটা বেশি কার্যকর হবে। তাই এসব চিন্তা-ভাবনার জন্য এবং সঠিকভাবে সারা পৃথিবীকে পথপ্রদর্শনের জন্য সবসময় মাশওয়ারা, মজলিস এবং আলোচনা-পর্যালোচনা ও গবেষণা করা যেতে পারে।
দাওয়াতের কাজ কুরআন এবং হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তবে দাওয়াতের বিশেষ কোনো পদ্ধতি সরাসরি কুরআন এবং হাদীসে বর্ণিত হয়নি। এজন্য তা বুঝাও জরুরী নয়। তারপরও আমি আমার বন্ধু-বান্ধব এবং দাওয়াতের ময়দানে যারা কাজ করছেন তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু পদ্ধতি নিবেদন করছি-
ঈমানের প্রতি দাওয়াত এবং ইসলাম প্রচার
এটা দাওয়াতের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ শাখা যার গুরুত্ব ও তাৎপর্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুদায়বিয়ার সন্ধি-পরবর্তী ভাষণ থেকে উপলব্ধি করা যায়। মসজিদে নববীতে প্রদত্ত সেই ভাষণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘হে লোক সকল! মহান আল্লাহ তাআলা আমাকে সারা পৃথিবীর জন্য রহমত এবং পয়গাম্বার হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আমি সারা পৃথিবীর জন্য আল্লাহর রাসূল হয়ে আগমন করেছি। তাই আসমান এবং জমিনের অধিপতির বার্তা আমি সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই, যেন আল্লার ঐশী বাণীর শ্রেষ্ঠত্ব মানুষের কাছে প্রমাণিত হয় এবং পৃথিবীর কোনো প্রান্তের কোনো মানুষ এই দাওয়াত থেকে বঞ্চিত না থাকে। আল্লাহর ওপর ভরসা করে পৃথিবীর রাজা-বাদশাদের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দাও। মনে রাখবে, তোমাদের অস্তিত্ব এবং পৃথিবীতে তোমাদের বেঁচে থাকা যেন আল্লাহর পয়গাম আল্লাহর বান্দাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যই হয়। ঐ ব্যক্তির ওপর জান্নাত হারাম, যে মানুষের সাথে বসবাস করে এবং লেনদেন করে, কিন্তু মানুষকে ভালো কাজের জন্য উপদেশ দেয় না এবং সৎ কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে না।’
অন্যত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যার হাতে একজন মানুষও ইসলাম গ্রহণ করেছে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব।’ দাওয়াতের কাজকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়-
সাধারণ অমুসলিমদের দাওয়াত দেয়ার পদ্ধতি
অধমের অভিজ্ঞতা হলো, সাধারণ অমুসলিমদের একাকি দাওয়াত দেয়াই বেশি ফলদায়ক। মক্কী জীবনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পদ্ধতিতে দাওয়াত দিয়েছেন সে পদ্ধতি আমরা হিন্দুস্তানেও প্রয়োগ করতে পারি। এর জন্য আমরা সর্বপ্রথম আমাদের নিকটবর্তী ও আশপাশের কিছু অমুসলিম নির্বাচন করব। তারপর এদের ওপর কাজ শুরু করব। দু’একজনকে টার্গেট করে তাদের জন্য দোয়া করতে থাকব। তাদের নাম উল্লেখ করে এভাবে দোয়া করব, হে আল্লাহ! আপনি অমুককে হেদায়াত দান করুন। তমুককে হেদায়াত দান করুন। দোয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমন একটি সুন্নাত যা বর্তমানে উম্মতের নেতৃস্থানীয় লোকদের মাঝ থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে। তাই এই অবহেলিত সুন্নাত আদায় করার মাধ্যমে শুরুতেই একশ’ শহীদের সাওয়াব অর্জিত হয়ে যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আমার উম্মত ফেৎনা-ফাসাদে আক্রান্ত থাকাকালীন আমার সুন্নাত আকড়ে ধরবে, তাকে একশ’ শহীদের সাওয়াব দেয়া হবে।
যখন আমি এই দোয়া করব যে, হে আল্লাহ! আমার অমুক ভাইকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন, তখন এর মাধ্যমে উম্মতের জন্য হৃদয় উজাড় করে দেয়ার মানসিকতা তৈরি হবে। অন্যের হেদায়াতের জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করতে কুন্ঠাবোধ হবে না। দাওয়াতের মধ্যে প্রাণ সৃষ্টি করার জন্য এই হাহাকার অন্যতম হাতিয়ার। এছাড়া বার বার দোয়া করার দ্বারা আল্লাহর জাতের প্রতি এই মর্মে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপিত হবে যে, আমার দ্বারা কিছুই হয় না; সবই আল্লাহর সাহায্যে হয়।
দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা হৃদয়ে একথা ঢেলে দিবেন যে, কাজ কীভাবে কোথা থেকে শুরু করতে হবে। দোয়ার পাশাপাশি যাকে দাওয়াত দেব তার প্রতি নিষ্ঠাপূর্ণ সহানুভূতিমূলক আচরণ এবং দরদ প্রকাশ করতে হবে। তাকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে হবে। এরপর তাকে মুখে দাওয়াত দেব। সংক্ষিপ্ত দাওয়াতি বই-পুস্তক তার সামনে পেশ করব। এর জন্য কিছু উপযোগী বইও বাজারে আছে। জমিয়তে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (ফুলাত) সম্প্রতি কিছু বই প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে অধমের ‘আপকী আমানত আপ কী সেওয়া মে’ আল্লাহর অনুগ্রহে নওমুসলিমদের নিকট খুবই সমাদৃত হয়েছে। হিন্দিতে লিখিত বইটি দ্বারা অগণিত মানুষ উপকৃত হয়েছেন। ‘মরনে কে বাদ কিয়া হোগা’-ও বেশ উপকারী সাব্যস্ত হয়েছে। মুফাক্কিরে ইসলাম সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবী রহ.-এর হিন্দি কিতাব ‘ইসলাম এক পারচে’-ও খুব কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। শিক্ষিত সমাজের সামনে রেসালত এবং নবুওয়াতের মৌলিক বিষয়গুলো তুলে ধরতে ‘খুতবাতে মাদারেসের’ ইংরেজি ভার্সন- The ideal prophet বইটিও বেশ সাড়া জাগিয়েছে। এছাড়া ভেদপ্রকাশ উপাধ্যয়ের ‘ন্রাসন্স আওর অন্তিম ঋশি’সহ অন্যান্য বই ধর্মীয় হিন্দুদের জন্য খুবই উপকারী। ‘ওহী এক একতা কা আধার’ও (হিন্দি) পড়া যেতে পারে। সামান্য আন্তরিকতা দিয়ে এটুকু কাজ করতে পারলেই একসময় আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন যে, আপনি কত মানুষের হেদায়াতের কারণ হয়ে গেছেন, ইনশা-আল্লাহ।
হরিজন এবং দুর্বল শ্রেণির মাঝে দাওয়াত
হিন্দুদের মাঝে কিছু নিন্মশ্রেণি আছে যারা বিভিন্নভাবে অবহেলিত। নিষ্পেষিত। হিন্দু সমাজের উঁচুশ্রেণির কাছে যাদের সামান্যতম মর্যাদাও নেই। তারা শ্রেণি-বৈষম্যের শিকার। এদেরকে অচ্ছ্যুত এবং অস্পৃশ্য নামে ডাকা হয়। এসব হরিজন এবং শূদ্রদের মাঝে ইসলামের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে হবে। ইসলামের সমতানীতি তাদের বুঝিয়ে বলা যে, ইসলামে উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ নেই। ধনী-গরীবের তফাৎ নেই। সাদা ও কালোর পার্থক্য নেই। ইসলাম সবাইকে একচোখে দেখে। এখানে বর্ণ ও শ্রেণি-বৈষম্যের কোনো স্থান নেই। পাশাপাশি এই শ্রেণির মানুষের কাছে ইসলামের ব্যাপারে হিন্দুদের বড় বড় শিক্ষিত পন্ডিতদের উক্তিও তুলে ধরা যেতে পারে। এটাও খুব কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। জমিয়তে শাহ ওয়ালিউল্লাহ প্রকাশনি এ ব্যাপারে ড. অম্বিতকর এবং বিরামা-স্বামী পরিবারের মতামত সম্বলিত কিছু বই প্রকাশ করেছে, সেগুলো থেকেও সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
মুরতাদদের মাঝে কাজ করার পদ্ধতি
হিন্দুস্তানের মুসলমানদের জন্য মুরতাদ শ্রেণির প্রতি মনোযোগী হওয়া খুবই জরুরী। হিমাচল, পাঞ্জাব, হারিয়ানা, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ (ইউপি) এবং রাজস্থানসহ যেসব প্রদেশে আমাদের দাওয়াতি টিম পৌঁছেছে, সেখানে এক জরিপ অনুযায়ী প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ ইরতেদাদ বা ধর্মত্যাগের শিকার। এরা একসময় ইসলাম গ্রহণ করে পরবর্তীতে ইসলাম ছেড়ে মুরতাদ হয়ে গেছে। এদের মধ্যে বড় একটি অংশ দেশ ভাগের আগে এবং কিছু দেশ ভাগের পরে মুরতাদ হয়েছে। প্রিয় নবীজি (সা.)-এর ইন্তেকালের পর অনেক নওমুসলিমের ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়ার যে সয়লাব শুরু হয়, সেটাকে হযরত সিদ্দিকে আকবর (রাযি.) খলিফা হয়ে শক্তহাতে দমন করেন। বর্তমানেও বিষয়টির প্রতি সেভাবে গুরুত্বারোপ করা উচিৎ। মুরতাদদের কেউ হিন্দুধর্ম অবলম্বন করেছে। কেউ শিখ হয়ে গেছে। এভাবেই তারা মূর্তিপূজায় লিপ্ত। এছাড়া কাদিয়ানী, বাহাঈ (ভন্ড মতবাদের উদ্ভাবক বাহাউল্লাহর অনুসারী), রাধাস্বামী ও নারাঙ্করী ইত্যাদি মতবাদের শিকার হয়েও অনেক মুসলমান দীনহারা হয়েছে।
এসব মুরতাদদের মাঝে একটা দল এমন আছে যারা নিজেদের অমুসলিম মনে করে। তারা নিজেরাও জানে যে, তারা ইসলাম থেকে অনেক দূরে। আরেকটি দল হলো, যারা নিজেদের মুসলমান মনে করে; কিন্তু তারা পূজা-অর্চনা, হোলিখেলা ও দেওয়ালীসহ বিভিন্ন ধরনের শিরকি কর্মকান্ডে লিপ্ত। এসব লোকদের মাঝে দাওয়াতী কাজ করার সবচে’ নিরাপদ এবং সহজ পদ্ধতি হলো, প্রাইমারি স্কুলের নামে ওইসব এলাকায় কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। এখানে তালীমের পাশাপাশি বাচ্চাদেরকে দাওয়াতী মেজাজের শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে রাখা। বড়দেরকে যতটুকু সম্ভব তাবলীগ জামাতের পদ্ধতিতে ঈমানের ওপর উঠানোর চিন্তা-ফিকর করা। যেসব বাচ্চা আমাদের তত্ত্বাবধানে ৫ বছর কাটাবে, ইনশা-আল্লাহ তারা আপন পরিবারের চিন্তা-চেতনা এবং ধর্মমতের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে যাবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।