Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বছরের শ্রেষ্ঠ দশ দিনে দশ আমল

প্রকাশের সময় : ৯ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাও. এইচএম গোলাম কিবরিয়া রাকিব
॥ এক ॥
যেভাবে আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ১২ মাস সৃষ্টি করার সময়ে রামাদানকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন অন্যান্য মাসের উপরে, তেমনিভাবে দিবস সৃষ্টি করার সময়ে জিলহজের প্রথম ১০ দিনকে আল্লাহ শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন বছরের অন্যান্য দিনগুলোর উপর। কেন এই ১০ দিন বছরের শ্রেষ্ঠ দশ দিন?
১. আল্লাহ তায়ালা এর কমস করেছেন: আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো কিছুর কসম করেন তা কেবল তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাই প্রমাণ করে। কারণ, মহান সত্তা শুধু মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরই কসম করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কসম ভোরবেলার। কসম
১০ রাতের।’ {সূরা আল-ফাজর, /আয়াত; ১-২} আয়াতে ‘কসম ১০ রাতের’ বলে ফিলহজের দশকের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এটিই সকল মুফাসসিরের মতো। ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এমতটিই সঠিক।
২. এসবই সেই দিন আল্লাহ যাতে তাঁর জিকিরের প্রবর্তন করেছেন: আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যেন তারা নিজদের কল্যাণের স্থানসমূহে হাজির হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু থেকে যে রিজিক দিয়েছেন তার ওপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত:২৮) জমহূর উলামার মতে, আয়াতে নির্দিষ্ট দিনসমূহ বলে যিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনকে বুঝানো হয়েছে। এটিই ইবন উমর ও ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহুমার মত।
৩. রাসূলল্লাহ সা. দিনগুলোকে শ্রেষ্ঠ দিন বলে আখ্যায়িত করেছেন: যিলহজের এই দিনগুলোকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন, জাবির রাদিআল্লাহু আনহূ থেকে বর্ণিত ‘পৃথিবীর দিনগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিনগুলো হলো দশকের দিনসমূহ। জিজ্ঞেস করা হলো, আল্লাহর পথে জিহাদে ও কি এর চেয়ে উত্তম দিন নেই? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদে ও হ্যাঁ, কেবল সে-ই যে (জিহাদে) তার চেহারাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে।’ [মুসনাদ বাজ্জার : ১১২৮; মুসনাদ আবী ই’ আলা :২০৯০]
৪. এই দিনগুলোর মধ্যে রয়েছে আরাফার দিন: আরাফার দিন হলো বড় হজের দিন। এটি ক্ষমা ও মাগফিরাতের দিন। জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও নাজাতের দিন। যিলহজের এই দশকে যদি ফযীলতের আর কিছু না থাকত তবে এ দিবসটিই তার মর্যাদার জন্য যথেষ্ট হতো। এ দিনের ফযিলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আরাফা দিবসই হজ।’ [তিরমিযি : ৮৯৩; নাসায়ী : ৩০১৬]
৫. এতে রয়েছে কুরবানির দিন : কোনো কোনো আলিমের মতে কুরবানির দিনটি বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ দিন হলো কুরবানির দিন অতঃপর অস্তিরতার দিন’। (অর্থাৎ কুরবানির পরবর্তী দিন। কারণ, যেদিন মানুষ কুরবানি ইত্যাদির দায়িত্ব পালন শেষ করে সুস্তির হয়।) [নাসায়ী : ১০৫১২; ইবন খুযাইমা, সহীহ: ২৮৬৬]
৬. এ দিনগুলোতে মৌলিক ইবাদতগুলোর সমাবেশ ঘটে: হাফেয ইবন হাজর রহিমাহুল্লাহ তদীয় ফাতহুল বারী গ্রন্থে বলেন, ‘যিলহজের দশকের বৈশিষ্ট্যের কারণ যা প্রতীয়মান হয় তা হলো, এতে সকল মৌলিক ইবাদতের সন্নিবেশ ঘটে। যথা : সালাত, সিয়াম, সাদাকাহ, হজ ইত্যাদি। অন্য কোনো দিন এতগুলো ইবাদতের সমাবেশ ঘটে না।
এই ১০ দিনের আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় : ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘এমন কোনো দিন নেই যার আমল যিলহজ মাসের এই ১০ দিনের আমল থেকে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। সাহাবায়ে কিরাম রা, বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদও নয়? রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি তার জান-মাল নিয়ে আল্লাহর পথে যুদ্ধে বের হল এবং এর কোনো কিছু নিয়েই ফেরত এলো না (তার কথা ভিন্ন)।’ [বুখারি : ৯৬৯; আবু দাউদ : ২৪৪০; তিরমিজি : ৭৫৭]
আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এ ১০ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহুর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তাই তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পড়।’ [মুসনাদ আমহদ: ১৩২; বাইহাকী, শুআবুল ঈমান: ৩৪৭৪ ; মুসনাদ আবী আওয়না: ৩০২৪ অন্য বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যিলহজের (প্রথম) ১০ দিনের মতো আল্লাহর কাছে উত্তম কোনো দিন নেই। সাহাবীরা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহর পথে জিহাদেও কি এর চেয়ে উত্তম দিন নেই? তিনি বললেন, হ্যাঁ, কেবল সে-ই যে (জিহাদে) তার চেহারাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে।’ [সহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব : ২/১৫; মুসনাদ আবী আওয়না : ৩০২৩]
এ হাদীসগুলোর মর্ম হলো, বছরে যতগুলো মর্যাদাপূর্ণ দিন আছে তার মধ্যে এ দশ দিনের প্রতিটি দিনই সর্বোত্তম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিনসমূহে নেক আমল করার জন্য তাঁর উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। তাঁর এ উৎসাহ প্রদান এ সময়টার ফযীলত প্রমাণ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিনগুলোতে বেশি বেশি করে তাহলীল ও তাকবীর পাঠ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন ওপরে ইবন উমর রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ হয়েছে। ইবন রজব রহিমাহুল্লাহ বলেন, উপরোক্ত হাদিসগুলো থেকে বুঝা যায়, নেক আমলের মৌসুম হিসেবে যিলহজ মাসের প্রথম দশক হলো সর্বোত্তম, এ দিবসগুলোয় সম্পাদিত নেক আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। হাদীসের কোনো কোনো বর্ণনায় (‘আহাব্বু’ তথা সর্বাধিক প্রিয়) শব্দ এসেছে আবার কোনো কোনো বর্ণনায় (‘আফযালু’ তথা সর্বোত্তম) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অতএব এ সময়ে নেক আমল করা বছরের অন্য যে কোনো সময়ে নেক আমল করা বছরের অন্য যে কোনো সময়ে নেক আমল করার থেকে বেশি মর্যাদা ও ফযীলতপূর্ণ। এজন্য উম্মতের অগ্রবর্তী পুণ্যবান মুসলিমগণ এ সময়গুলোতে অধিকহারে ইবাদতে মনোনিবেশ করতেন। যেমন আবু ছিমান নাহদী বলেন, ‘তাঁরা অর্থাৎ সালাফ তথা পূর্বসূরীগণ দিনটি দশককে অনেক বেশি মর্যাদাবা জ্ঞান করতেন : রমজানের শেষ দশক, যিলহজের প্রথম দশক এবং মুহাররমের প্রথম দশক।’ এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগানোর ১০ উপায় প্রতিটি মুসলিমের উচিত ইবাদতের মৌসুমগুলোকে সুন্দর প্রস্তুতির মাধ্যমে স্বাগত জানানো। যিলহজ মাসকে আমরা স্বাগত জানাতে পারি নিচের কাজগুলোর মধ্য দিয়ে : এ ১০ দিন যে আমলগুলো বেশি বেশি করা উচিত।
১. এই ১০ টি দিন কাজে লাগাতে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা: শুরুতেই যা করা সবার উচিত তা হল, এই দিনগুলোকে পুণ্যময় কাজ ও কথায় সুশোভিত করার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করা। যে ব্যক্তি কোনো কাজের সংকল্প করে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। তার জন্য সাহায্যকারী উপায় ও উপকরণ প্রস্তুত করে দেন। যে আল্লাহর সঙ্গে সত্যবাদিতা দেখায় আল্লাহ তাকে সততা ও সফলতায় ভূষিত করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন।’ {সূরা আল- আ’নকাবূত, আয়াত : ৬৯}
২. হজ ও উমরা সম্পাদন করা: হজ ও উমরা এ দুটি হলো এ দশকের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। যারা এ দিনগুলোতে হজ আদায়ের সুযোগ পেয়েছেন তারা যে অনেক ভাগ্যবান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ যাকে তাঁর নির্দেশিত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত পন্থায় হজ বা উমরা করার তাওকীফ দান করেন তার পুরস্কার শুধুই জান্নাত। কারণ, আবু হুরায়রা রা. কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এক উমরা থেকে আরেক উমরা এতদুভয়ের মাঝের গুনাহগুলোর কাফফারা এবং মাববূর হজের প্রতিদান কেবলই জান্নাত।’ [বুখারি :১৭৭৩; মুসলিম : ৩৩৫৫]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বছরের শ্রেষ্ঠ দশ দিনে দশ আমল
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ