Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলাকারীর আমৃত্যু কারাদন্ড

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৮ আগস্ট, ২০২০, ১২:০২ এএম

গত বছর ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে হত্যাকান্ড চালানো ব্রেন্টন ট্যারান্টকে প্যারোল ছাড়াই যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিলেন নিউজিল্যান্ডের একটি আদালত। তার বিরুদ্ধে গতকাল বৃহস্পতিবার আদালত এ ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেছেন। দেশটিতে হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি আজীবন কারাদন্ড হলেও একটা সময় পর মুক্তি পান অপরাধী। তবে এ অস্ট্রেলীয়র ক্ষেত্রে তা হবে না। তার বিরুদ্ধে ৫১ জনকে হত্যা, ৪০ জনকে হত্যাচেষ্টা ও একটি সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রমের অভিযোগ ছিল। ওই হত্যাকান্ডের পর নিউজিল্যান্ডে বন্দুক আইন আরও কঠোর করে।

বিচারক ক্যামেরন ম্যান্ডারের বেঞ্চে এ বিচারের শুনানি শুরু হয়েছিল সোমবার। রায় পড়তে গিয়ে ট্যারান্টের এ হত্যাকান্ডে ‘অমানবিক’ বলেছেন তিনি। ম্যান্ডার আরও যোগ করে বলেন, তার মনে ‘কোনও দয়া-মায়া ছিল না।’

২০১৯ সালের ১৫ মার্চে ক্রাইস্টচার্চের আল নূর ও লিনউড মসজিদে নামাজ পড়া অবস্থায় গুলি করে ৫১ জন মুসলমানকে হত্যা করা অস্ট্রেলিয়ান শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ব্রেন্টন ট্যারান্টকে গত রোববার আদালতে আনা হয়। ওই হামলায় বেঁচে যাওয়া ও নিহতদের পরিবারের স্বাক্ষ্য দিয়ে সোমবার শুরু হয়েছিল চারদিনের শুনানি।
ওই হত্যাকান্ডের কারণে আজীবনের জন্য কারাদন্ড যে হতে যাচ্ছে ট্যারান্টের তা ছিল নিশ্চিত। তবে সাক্ষ্য দিতে আসা প্রত্যেকের দাবি ছিল যেন কোনোদিন আলোর মুখ দেখতে না পান এই অপরাধী। হলোও তাই।

নিউ সাউথ ওয়েলসের ২৯ বছর বয়সী বাসিন্দা ট্যারান্ট এর আগে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন এবং পরে আত্মপক্ষ সমর্থনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। শুনানিতে ৬০ জনের বেশি লোক সশরীরে সাক্ষ্য দেন। তাদের কেউ বিদেশ থেকে এসেছেন এবং দুই সপ্তাহের করোনাভাইরাস কোয়ারেন্টাইনে থেকেছেন।
রায় ঘোষণার সময় আদালত কক্ষে উপস্থিত টারান্টের উদ্দেশে বিচারক বলেন, ‘আপনি নিজেকে মানসিকভাবে চরম অসুস্থ ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যে কি না নিজের থেকে ভিন্ন মনে করা অন্য মানুষদের ঘৃণা করে।’
‘আপনি যে ক্ষতি করেছেন তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা বা জনসম্মুখে স্বীকারোক্তি দেননি। যদিও আমি আপনার (আদালতের) এই প্রক্রিয়াগুলো প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ ত্যাগ করার প্রশংসা করছি, কিন্তু আপনাকে মোটেও অনুতপ্ত বা লজ্জিত দেখাচ্ছে না।’

শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদে বিশ্বাসী টারান্টের উদ্দেশে বিচারক বলেন, ‘আপনি একটি গণহত্যা চালিয়েছেন। আপনি নিরস্ত্র ও প্রতিরোধবিহীন মানুষদের হত্যা করেছেন।’
দÐের রায় ঘোষণার আগে উচ্চৈস্বরে দীর্ঘসময় ধরে টারান্টের হামলার শিকার ব্যক্তিদের বর্ণনা এবং তাদের স্বজনদের মন্তব্য পড়ে শোনান বিচারক ম্যান্ডার। এসময় আবেগøাপ্লুত হয়ে পড়ায় দু’বার থেমে যেতে হয় তাকে।
ভুক্তভোগী একটি পরিবারের কথা উল্লেখ করে বিচারক বলেন, ‘তাদের ক্ষতি অসহনীয়। আপনার কর্মকাÐ তাদের পরিবার ধ্বংস করে দিয়েছে, যেভাবে ধ্বংস করেছে আরও অনেক পরিবারকে।’ এসময় নিহত প্রিয়মানুষটির নাম শুনে স্বজনদের অনেককেই চোখের পানি মুছতে দেখা যায়।

ক্রাইস্টচার্চ হামলায় সর্বকনিষ্ঠ ভুক্তভোগীর নাম মুকাদ ইব্রাহিম। টারান্টের গুলিতে প্রাণ হারানোর সময় তার বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। মুকাদের কথা উল্লেখ করে বিচারক বলেন, ‘এত ছোট বাচ্চা হারানোর পর কোনও মা-বাবাই স্বাভাবিক হতে পারবে না।’

চলতি সপ্তাহে টানা চারদিন ধরে হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি ও ভুক্তভোগী পরিবারের কয়েক ডজন সদস্য আদালতের শুনানিতে অংশ নেন। তাদের সবাই অস্ট্রেলীয় নাগরিক টারান্টের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন এবং তিনি যেন কোনওভাবেই আর কখনও মুক্ত হতে না পারেন সেই ব্যবস্থা নিতে বিচারকের কাছে অনুরোধ জানান।
শুনানির শেষ দিন আদালতে পবিত্র কোরআন শরীফের আয়াত তিলাওয়াত করা হয় এবং ভুক্তভোগী ও তাদের প্রিয়জনদের ছবি প্রদর্শন করা হয়। তবে রায় ঘোষণার আগপর্যন্ত আদালতে কোনও কথা না বলার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন ব্রেন্টন টারান্ট।

এ মামলার প্রধান প্রসিকিউটর মার্ক জারিফেহ বলেন, ‘বন্দুকধারী টারান্টের জন্য ন্য‚নতম কোনও দÐই যথেষ্ট হবে না। এটি কোনও ধরনের তুলনা ছাড়াই নিঃসন্দেহে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অপরাধমূলক ঘটনা। স্পষ্টতই তিনি (টারান্ট) নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে জঘন্যতম খুনি।’

স্বজন হারানো বাংলাদেশিদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
গত বছরের মার্চে নিউজিল্যান্ডে ক্রাইস্টচার্চের দু›টি মসজিদে বন্দুক হামলা চালানো ব্রেন্টন টারান্টকে যাবজ্জীবন কারাদÐ দেয়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ঐ হামলার ভুক্তভোগী বাংলাদেশি নাগরিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। গত বছরের ১৫ মার্চ জুমার নামাজের সময় ক্রাইস্টচার্চের দু›টি মসজিদে বন্দুক হামলা চালান ২৯ বছর বয়সী ব্রেন্টন টারান্ট, যেই হামলায় নিউজিল্যান্ড প্রবাসী ৫ জন বাংলাদেশি নাগরিকসহ ৫১ জন মারা যান, আহত হন আরো অনেকে।

ঐ ঘটনায় ব্রেন্টন টারান্টকে নিউজিল্যান্ডের আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হয়েছে। তবে আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হলেও সেদেশের আইনে মৃত্যুদÐের বিধান না থাকায় কেউ কেউ কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। যেরকম বলছিলেন বাংলাদেশের নাগরিক বাবুল। তার স্ত্রী আফসানা আক্তার রিতু হামলার দিন একটি মসজিদের ভেতর ছিলেন। তবে তিনি বেঁচে যান।

জনাব বাবুল বলেন, ‘একটা মানুষ ৫১ জনকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করার পরও কীভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ পায়? আমরা এই রায়ে কিছুটা মনক্ষুণ্ণ। তিনি জানান ঐ ঘটনার পর এক মাসেরও বেশি সময় তার স্ত্রী ঘর থেকে বের হননি। সবসময় দরজা জানালা বন্ধ করে রাখতেন। ‘আমার স্ত্রী এখনও পুরোপুরি ঐ আতঙ্ক থেকে বের হতে পারেননি। মনে হয় না কখনো পারবেন। তবে জনাব বাবুলের মত রায়ে অসন্তোষ নেই সব ভুক্তভোগীর।

আল নূর মসজিদে বন্দুক হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন ওমর জাহিদ। এখনও শারীরিকভাবে শতভাগ সুস্থ হতে পারেননি তিনি। তার কয়েকজন সহপাঠী এবং পরিচিত ব্যক্তিও সেসময় হামলায় মারা গিয়েছিলেন। নিউজিল্যান্ডের আইন অনুযায়ী ব্রেন্টন টারান্টের হওয়া শাস্তির সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তিনি বলেন, দোষীকে যদি মৃত্যুদÐ দেয়াও হতো, তাহলেও তো আমার মারা যাওয়া বন্ধুরা, পরিচিতরা ফিরে আসতো না। আমার মত যারা আহত হয়েছেন, তারা তো আর সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে না। যেহেতু নিউজিল্যান্ডের আইনের সর্বোচ্চ সাজাটাই তাকে দেয়া হয়েছে, তাই আমি সন্তুষ্ট। আমার মনে হয় যে সুবিচারই হয়েছে।

রায়ে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন ঐ হামলায় প্রাণ হারানো হোসনে আরা ফরিদের স্বামী ফরিদ উদ্দীন আহমেদ। ঐ ঘটনার কয়েকদিন পরই ফরীদ উদ্দীন আহমেদ গণমাধ্যমের কাছে বলেছিলেন যে হামলাকারী ব্রেন্টন টারান্টকে তিনি এবং তার পরিবার মন থেকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, যেই মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি তিনি করেছেন হামলাকারী টারান্টের যাবজ্জীবন কারাদÐের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরও।

বিবিসিকে ফরিদ উদ্দীন আহমেদ বলেন, হামলাকারীকে আমি এবং আমার মেয়ে ক্ষমা করতে পেরেছি বলেই এখন আমরা মানসিকভাবে শান্তিতে রয়েছি বলে আমার বিশ্বাস। এখন হামলাকারীকে শাস্তি দেয়া হলেও আমার মানসিক পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া জনাব আহমেদ হামলার কিছুদিন পর বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তার এবং অন্যদের জীবন বাঁচাতে সেদিন তার স্ত্রী হোসনে আরা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। নিউজিল্যান্ডের বিচার ব্যবস্থায় মৃত্যুদÐের শাস্তি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই প্রথমবারের মত নিউজিল্যান্ডে প্যারোল ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদÐের শাস্তি দেয়া হলো। হামলাকারী ব্রেন্টন টারান্টকে আমৃত্যু কারাগারে থাকতে হবে। সূত্র : বিবিসি ও দ্য গার্ডিয়ান।



 

Show all comments
  • elu mia ২৮ আগস্ট, ২০২০, ১১:৪৪ এএম says : 0
    এইটা কন ধরনের বিচার?ওরে মৃত্যু দন্ড দেয়া উচিত। এই ফরিদ উদ্দীন আহমেদ মনে হয় বউরে পসন্দ করতনা এর জন্ন রায়ে সন্তস প্রকাশ করসে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিউজিল্যান্ড


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ