পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্বব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করেছে। এই পরিবর্তন একদিকে যেমন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা, সামাজিক যোগাযোগ, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বদলে দিচ্ছে। অন্যদিকে মানুষের জীবনদর্শন, আধ্যাত্মবোধ থেকে শুরু করে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিকেও প্রবলভাবে প্রভাবিত করছে। একটি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে বাঁচতে আমাদের সভ্যতা হাজার বছরে অর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিকিৎসা ব্যবস্থা, ব্যক্তিগতও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা যখন শুধুমাত্র বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোঁয়া, মুখে মাস্ক পরা আর সামাজিক দূরত্বের উপর নিবদ্ধ হয়, তখন বুঝতে কারো বাকি নেই যে এই মহামারীর বিরুদ্ধে আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি কোনো কাজে আসছে না। অতি ক্ষুদ্র একটি জীবাণুর বিরুদ্ধে সভ্যতার অহংকারী মানুষের এই অসহায়ত্ব পুরো মানব জাতির জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। মানব সভ্যতা শেষবার এমন প্রাণঘাতি বৈশ্বিক মহামারীর সম্মুখীন হয়েছিল ১৯১৮-২০ সালে। স্পেনিশ, ফ্লুতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর সে অভিজ্ঞতা আজকের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত বিশ্বায়ণের মত বিশ্বের সব দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে না পড়লেও ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে সৈন্য ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তাদের উপনিবেশিত অঞ্চলেও সেই প্রাণঘাতী ফ্লু ছড়িয়ে পড়েছিল। এর পর বিশ্ব আরোর বেশ কয়েকটি মহামারীর সম্মুখীন হওয়ার পর চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা যক্ষা, ম্যালেরিয়া, কলেরার মত প্রাণঘাতী মহামারীর টীকা বা প্রতিষেধক উদ্ভাবন এবং উন্নত জীবন যাপন প্রণালী অবলম্বনের মধ্য দিয়ে সে সব মহামারীর পুনরাবৃত্তি রোধে সক্ষম হয়েছে। তবে একেকটা মহামারীর পর সফল ভ্যাকসিনের জন্য বিশ্বকে বছরের পর বছর( কয়েক দশক পর্যন্ত) অপেক্ষা করতে হয়েছে।
গত বছর (২০১৯) ডিসেম্বরে চীনের ওহানে প্রথম কভিড-১৯ ভাইরাসের পেন্ডেমিক শুরুর পর এখনো এক বছর পার হয়নি। চীন থেকে ইউরোপের ইতালি, বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে প্রবল মানব বিদ্ধংসী আকারে ছড়িয়ে না পড়লে এশিয়া বা আফ্রিকার কোটি কোটি মানুষ প্রাণ হারালেও বিশ্ব এতটা আলোড়িত হত কিনা সন্দেহ আছে। চীনে এই অতি সংক্রামক ভাইরাসের প্রাণঘাতী রূপ প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে প্রতিদ্বন্দী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের বেকায়দা অবস্থা থেকে ফায়দা হাসিলের আকাঙ্খা প্রকাশ করেছিল। ভাইরাস পেন্ডেমিকের শুরুতেই কালক্ষেপণ না করে চীনের ওহান শহরকে লকডাউন করে দেয়া এবং আশপাশের সব শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, গণপরিবহন, কলকারখানা বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে মানুষকে ঘরবন্ধি করে ফেলার অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব প্রস্তুত ছিল না। ইতালির রোম বা লন্ডনের রাস্তায়-হাসপাতালে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের অসহায় মৃত্যুর দৃশ্য দেখার পর নিউ ইয়র্কে তা আরো ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করার পরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তা অগ্রাহ্য করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড অব্যাহত রাখতে গিয়ে মহামারীকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঠেলে দেন। অবস্থা এক সময় ট্রাম্পের জন্য ট্রমাটিক হয়ে পড়ে। তিনি আবোল তাবোল বকতে শুরু করেন। সিডিসি এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সাথেও ব্যক্তিগত দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে পড়েন। মাস্ক ব্যবহার না করা, শরীরে ডিজ-ইনফ্যাক্ট্যান্ট ব্যবহার, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের অব্যর্থতা নিয়ে উচ্ছাস ইত্যাদি একেকবার একেক ওষুধ এবং একেক রকম মনগড়া ফর্মুলা দিয়ে তিনি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বার বার আলোচনায় আসেন। এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী নির্বাচনে নিজের ভরাডুবি ঠেকাতে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনকে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ খুঁজছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
চীনের ওহানে করোনাভাইরাস সংক্রমন ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে চীনা গবেষকরা রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় করোনার ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে লেগে পড়েছিলেন। চীনা বেশ কয়েকটি গবেষকদল একই সময়ে ভ্যাকসিনের পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করে সফল হওয়ার খবর আসতে থাকে। একই সময়ে অক্সফোর্ড, অস্ট্রাজেনেকা, জনসন এন্ড জনসন সহ যে সব কোম্পানী ও প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিনের দৌড়ে এগিয়ে ছিল তাদের মধ্যে রাশিয়ার গ্যামালিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তৈরী করা ভ্যাকসিন সবাইকে টেক্কা দিয়ে বাজারে আনার সব প্রস্তুতি চুড়ান্ত করেছে রাশান প্রশাসন। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের মেয়ের শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার ভ্যাকসিন প্রথম ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের যাত্রা শুরু করে। সেই সাথে তারা কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে ডিসেম্বর নাগাদ তা বাজারে আনার ঘোষণা দেয়। এটা রাশিয়ার পক্ষ থেকে বিশ্বকে আবারো তাক লাগিয়ে দেয়ার ঘটনা। স্মরণ করা যেতে পারে, ¯œায়ুযুদ্ধের সময় দুই পারমানবিক শক্তি রাশিয়া ও আমেরিকা যখন বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণে তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন, ঠিক তখন হঠাৎ ১৯৫৭ সালের ৪ঠা অক্টোবর কাজাখস্তানে অবস্থিত সোভিয়েত মহাকাশ গবেষনা সংস্থার উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে স্পুৎনিক-১ সেটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনে সক্ষম হয়। মানুষের মহাকাশ জয় এবং কক্ষপথে মানুষের তৈরী কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিমা দুনিয়ার জন্য বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। এবার কোভিড-১৯ মহামারীতে বিশ্ব যখন অসহায়, অর্থনীতি যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে, বিশ্বের প্রায় সব মানুষ একটি সফল ভ্যাকসিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, তখন রাশিয়া যেন মহাকাশে প্রথম উপগ্রহ স্থাপনের সাফল্যের মত বিশ্বকে প্রথম ভ্যাকসিন উপহার দেয়ার গৌরব অর্জন করল। বিগত শতাব্দীতে বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য মহামারীর তুলনায় কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দাবি সবচেয়ে স্বল্প সময়ে ঘটেছে। তবে রাশিয়ার গ্যামালিয়া ইনস্টিটিউট, চীনের সিনোভ্যাক, অক্সফোর্ড বা অস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনসহ কোনো ভ্যাকসিনের চুড়ান্ত সাফল্যের দাবি নিশ্চিত করার সময় এখনো হয়নি। ভ্যাকসিনগুলো দ্বিতীয়, তৃতীয় বা শেষ ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে চলমান ট্রায়ালের ধাপ শেষ হওয়ার পর এ চুড়ান্ত সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
ওহান থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই এ নিয়ে রাজনীতি, বেøইমগেম এবং ভূ-রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা চলছে। আটমাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও দেশে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। দোকানপাঠ, শপিংমল, রেস্তোঁরা ও অবকাশকেন্দ্রগুলো আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করলেও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে, এখনো প্রতিদিন আড়াই লক্ষাধিক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর সংখ্যা আট লক্ষাধিক। মে-জুন মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ মানুষের করোনা শনাক্ত হলেও বর্তমানে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। আর বাংলাদেশে সীমিত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এখনো বলবৎ রয়েছে। তবে পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্তের হার এবং মৃতের সংখ্যা খুব বেশি কমেনি। জুনমাসের মধ্যভাগে করোনায় মৃতের সংখ্যা ছিল গড়ে প্রতিদিন ৪০ জন, দুইমাস পেরিয়ে এসেও সংখ্যা ও আনুপাতিক হার প্রায় একই রকম আছে। কয়েকটি করোনা হাসপাতালকে নন কোভিড হাসপাতালে পরিনত করার সিদ্ধান্তের পর চলতি সপ্তাহে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে যাওয়ার তথ্য দিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক।
এখনো দেশের স্কুল-বলেজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সরকার। সেপ্টেম্বরে স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার একটা জল্পনা শোনা গেলেও দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পরিবেশ এখনো সৃষ্টি হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের একজন সিনিয়র সচিব। আস্তে আস্তে সবকিছু খুলে গেলেও স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার সামাজিকÑঅর্থনৈতিক ক্ষতি কোভিডের ক্ষতির চেয়ে বেশি বলে মনে করেন যুক্তরাজ্যের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ক্রিস হুইটি। এ কারণে এবং কোভিডে শিশুদের ঝুঁকি তুলনামুলক কম থাকায় চলতি সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের স্কুলগুলো খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। করোনাভাইরাস পেন্ডেমিকের শুরুতে আমাদের সরকার বিভিন্ন সেক্টরে হাজার হাজার কোটি টাকার সহায়তা, ঋণ ও প্রণোদনার ঘোষণা দিলেও শিক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ খাতে তেমন কোনো প্রণোদনা বা সহায়তা বরাদ্দ রাখা হয়নি। বেসরকারি,ননরেজিষ্টার্ড শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাখ লাখ শিক্ষক অভিভাবক এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। বছরের অর্ধেকের বেশি সময় ধরে বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেকয়া বেতনের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। কোভিডের জন্য কর্মসংস্থান হারানো লাখ লাখ অভিভাবকের পক্ষে বিদ্যালয়ের বকেয়া পরিশোধ করা অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ন্যুনতম একটা ভতুর্কি প্রদান সাপেক্ষে বেতন বকেয়ার একটি অংশ মওকুফের নির্দেশনা জারি করার প্রয়োজনীয়তা সরকার এড়াতে পারে না। যে কোনো শিল্পখাত রক্ষার চেয়ে শিক্ষাখাতের গুরুত্বকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। প্রায় সবগুলো পাবলিক পরীক্ষা বন্ধ থাকা, বছরজুড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকা, পরিবারের উপার্জনের রাস্তা বন্ধ বা সঙ্কুচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে কোটি কোটি শিশু-কিশোরে মনস্তাত্তি¡ক সংকটের বিষয়টি অবশ্যই সরকারের বিবেচনায় আনতে হবে।
করোনার কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় এর প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিনই হচ্ছে বিশ্বের সব মানুষের প্রধান প্রত্যাশা। একটি কার্যকর ভ্যাকসিন বাজারে না আসা পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব মেনে ভীড় এড়িয়ে চলা, জনসমাবেশ থেকে বিরত থাকা এবং হাত ধোঁয়া, মাস্ক পরা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই সংক্রমন কমিয়ে আনার মূল পন্থা। তবে বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে করোনা ভ্যাকসিন তৈরীতে সাফল্যের ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ নিয়ে এক প্রকার ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়ে গেছে। এ কথা এখন মানতেই হচ্ছে, করোনা পেন্ডেমিকের আগের এবং পরের বিশ্বব্যবস্থায় কিছু পার্থক্য দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী বলয় থেকে চীন-রাশিয়ার এগিয়ে থাকা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। বিশ্বের ৭০০কোটি মানুষ করোনাভাইরাস ঝুকিতে রয়েছে। একাধিক ভ্যাকসিনের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলেও সবার জন্য একই সময়ে ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা অসম্ভব। একেকটি কোম্পানী কোটি কোটি ডোজ উৎপাদনের নতুন নতুন প্লান্ট স্থাপনের পরও সবার জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। এরপর রয়েছে কর্পোরেট বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা এবং আমলাতান্ত্রিক কমিশন বাণিজ্যসহ নানাবিধ গোপণ খেলা। তবে অগ্রাধিকার ভিত্তিক করোনা ভ্যাকসিন প্রাপ্তির উপর আগামী দিনের অনেক কিছুই নির্ভর করছে। স্কুল-কলেজ, কল-কারখানা, বিনোদন-পর্যটন কেন্দ্র, সামাজিক-অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি চালু করে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ভ্যাকসিনই হচ্ছে একমাত্র রক্ষাকবচ। অতএব ভ্যাকসিন নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক গেমচেঞ্জিং, টানা হেঁচড়া, ষড়যন্ত্র এবং বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা এখন বিশ্বের রাজনৈতিক অর্থনীতির নতুন বাস্তবতা।
করোনা পেন্ডেমিক সময়ে বিশ্বরাজনীতি যখন স্থবির হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার কপোর্রেট প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে কোটি কোটি মানুষ মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। তখনো বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে চলছে ক্ষমতার অপরাজনীতি। সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন এবং আধিপত্যবাদের আস্ফালন। ফিলিস্তিন ও কাশ্মিরের মুসলমানরা একদিনের জন্যও শান্তির অবকাশ পায়নি। করোনাভাইরাসের মত একটি বৈশ্বিক মহামারী নিয়েও ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করেছে। তারা শুধু ভারতের আভ্যন্তরীন রাজনীতিকেই কলুষিত করেনি, প্রতিবেশি দেশগুলোতেও আধিপত্যবাদী হস্তক্ষেপ, হুমকি ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। এমনকি চীন সীমান্তে জবরদস্তি চালাতে গিয়ে চীনা সেনাদের হাতে মার খেয়ে ভ‚মি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এরপর থেকে চীনের সাথে ভারতের আঞ্চলিক রাজনৈতিক বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। জুনমাসে চীনের সাথে যুদ্ধাবস্থা তৈরী হলেও বাস্তবতা আঁচ করে রণেভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়েছে। চীন-পাকিস্তান তো বটেই, হিন্দু প্রধান নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ক্ষুদ্র ভ‚টান এমনকি মালদ্বীপ পর্যন্ত এখন ভারতের আধিপত্যবাদী মোড়লিপনা মানছেন না। সব নিকট প্রতিবেশি যখন ভারতকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছে, তখনো বাংলাদেশ ভারতের সাথে একপেশে সদ্ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। ভারতের শাসকরা বাংলাদেশকে যেন করদ রাজ্য ভেবে বসে আছে। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সবকিছু উজাড় করে দেয়ার পরও ভারতীয়রা বাংলাদেশের প্রাপ্য ও প্রত্যাশিত কোনো কিছুতেই ছাড় দেয়নি। ভারতের ফারাক্কা ও গজলডোবা বাঁধ এবং বর্ষায় এসব বাঁধের সব ¯øুইস গেট খুলে দিয়ে বন্যায় ডুবিয়ে দেয়ার ভূ-রাজনৈতিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে চীনের সাথে বাংলাদেশের বাণিজিক-কূটনৈতিক সম্পর্ক হাজার বছরের পুরনো।দুই হাজার বছর আগে প্রাচীন সিল্করুটের সাথে বাংলাদেশ যুক্ত ছিল। ইতিহাসের প্রাচীন –আধুনিক সব কালেই চীন বাংলাদেশের পরম বন্ধু, উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক অংশীদার। বাংলা উইকিপিডিয়ায় লেখা হয়েছে-‘প্রাচীনকাল থেকে চীন নৌ ও স্থলশক্তিতে অত্যন্ত বলবান হওয়া সত্বেও সমগ্র ইতিহাসে চীন অন্য কোনো দেশে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করেনি, অন্য কোনো দেশ দখল করে নেয়নি। বরং সব দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এসেছে।’ অন্যদিকে স্বাধীনতার মাত্র ৭ দশকের মধ্যে ভারতের ইতিহাস দখলদারিত্ব ও আধিপত্যবাদী হিংসায় কলঙ্কিত। এটা এখন পরীক্ষিত সত্য যে,ভারত তার প্রতিবেশিদের উন্নয়ন-অগ্রগতি মেনে নিতে পারে না। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে প্রতিবেশিদের দাবিয়ে রাখাই ভারতের বিদেশনীতি।
করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের উপর করোনা পরবর্তি বিশ্বব্যবস্থায় রাষ্ট্রসমুহের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থান নির্ভর করছে। এ ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান সর্বাগ্রে। সে চীন বাংলাদেশের প্রতি নানাভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আছে তবে বাংলাদেশ সে সহায়তা গ্রহণ করতে পারছে কিনা তার উপরই নির্ভর করছে অনেক কিছু। করোনাভাইরাস মহামারীতে সব দেশ নিজেদের সংকট মোকাবেলায় ব্যস্ত থাকলেও সম্ভাব্য সবকিছু নিয়ে চীন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। পিপিই, মাস্কসহ কোভিড-১৯ চিকিৎসা সামগ্রী এবং একটি চিকিৎসক দল বাংলাদেশে এসে সামগ্রিক অবস্থার মূল্যায়ন ও পরামর্শ দিয়েছেন। চীনা ভ্যাকসিনের অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের কথা থাকলেও অবশেষে অজ্ঞাত কারণে সিদ্ধান্তহীনতার মোড়কে বাংলাদেশ তা থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতা সত্বেও করোনা মোকাবেলার দৌড়ে বাংলাদেশ একটি সম্মানজনক অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হলেও ভ্যাকসিনের বিষ্ময়করভাবে দৌড়ে পিছিয়ে পড়ার বাস্তবতা মেনে নেয়া যায় না। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে আকষ্মিকভাবে অনানুষ্ঠানিক সফরে ঢাকায় আসলেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। তার এই সফরকে বলা হল ভ্যাকসিন কূটনীতি। তিনি বললেন, অক্সফোর্ডের সাথে যৌথভাবে ভারতের তৈরী ভ্যাকসিন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাবে বাংলাদেশ। বোধ্যা মহলের ধারণা এটা হচ্ছে বাংলাদেশকে চীনের ভ্যাকসিন প্রাপ্তি এবং চীনের সাথে নতুন নতুন উন্নয়ন অংশীদারিত্ব থেকে বাংলাদেশকে দূরে সরিয়ে রাখার চানক্য কূটনীতি। ভ্যাকসিনের মত অতি জরুরী অনুসঙ্গকে সিদ্ধান্তহীনতার মোড়কে যারা পিছিয়ে দিতে পারছে ভারতের প্রভাব বলয়ে থাকা সে সব আমলা ও রাজনৈতিক নেতারা সব কিছুই করতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে চিনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, বাংলাদেশের কাঁধে কাঁধ রেখে এগিয়ে যেতে চায় চীন। আর ভারত বাংলাদেশকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে, পিছিয়ে পড়া অনুগত রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। কোনপথে যাবে সে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী ও জনগণের।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।