Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাওয়া প্রান্ত স্পর্শের পথে

পদ্মা সেতুর কাজ করোনা বন্যায় থেমে নেই আগামী বছর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে নির্মাণ শেষ হবে : সেতু বিভাগ সচিব

নূরুল ইসলাম ও মঞ্জুর মোর্শেদ | প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

প্রমত্তা পদ্মার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মা সেতু। শরিয়তপুরের জাজিরা প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন মাওয়া প্রান্ত স্পর্শ করার পথে। সবগুলো পিলার নির্মাণ শেষ। বাকি আছে ১০টি স্প্যান বসানোর কাজ। বর্ষায় এখনও উন্মাতাল পদ্মা। দুপাড়ে ভাঙনের সুর। টগবগ করছে ঢেউ। স্রোতের বেগ কমলে আগামী মাসেই স্প্যান বসানো শুরু হবে। করোনা সংক্রমণে কদিন আগেও শুধু দিনে পদ্মা সেতুর কাজ হতো। এখন রাতেও কাজ চলছে বলে জানান সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, আগামী বছর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হবে। গত শুক্রবার সরেজমিনে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে গিয়ে দেখা গেছে, সড়ক ও রেলের ইন্টারসেকশনে পুরোদমে কাজ চলছে।

পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে ১ কিলোমিটার পূর্বে কুমারভোগে কনষ্ট্রাকশন ইয়ার্ডে এবং পশ্চিমে পুরাতন ফেরিঘাট এলাকায় গত কয়েক বছরে কয়েক দফা ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয়। নদী গতিপথ পরিবর্তন করে ভিতরে ঢুকে পড়ে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাবে কুমারভোগে কনষ্ট্রাকশন ইয়ার্ডে কয়েক দফা ভাঙন দেখা দেয়। ২০১৫ সালে ভাঙনে তিনটি জেটিসহ কোটি টাকার সম্পদ নদীগর্ভে বিলীন হয়। এ বছরও সেতুর প্রায় ১শ’ রোডওয়ে স্ল্যাব ও প্রায় দুশ’ রেরওয়ে স্ল্যাব এবং গার্ডার ক্রেনসহ বিপুল অংকের সম্পদ নদীগর্ভে বিলীন হয়। সংশ্লিষ্টদের দাবি, এতে ক্ষতির পরিমান প্রায় ৪শ’ কোটি টাকা। এবার ভাঙনে নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে প্রায় ৫০মিটার ভিতরে ঢুকে পড়ে। মাওয়ায় পুরাতন ফেরিঘাট এলাকায় দু’দফা ভাঙনে ফেরিঘাট, দোকান পাটসহ বিস্তীর্ণ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়। তবে ভাঙন ঠেকাতে প্রতিনিয়ত জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।

জানা গেছে, নকশায় ত্রুটির কারণে এক দফা জটিলতায় পড়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। সে সময় সেতুটির ২২টি পিলারের নকশা সংশোধন করতে হয়। এতে নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায়নি পদ্মা সেতুর কাজ। এর মধ্যে আঘাত হানে করোনাভাইরাস, যার প্রভাবেও সেতুটির নির্মাণকাজ বিলম্বিত হচ্ছে। এবার নদী ভাঙনের মুখে পড়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণ। গত ৩১ জুলাই মাওয়ায় কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড ভেঙে সেতুটির সংরক্ষিত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও নির্মাণসামগ্রী ডুবে গেছে পদ্মা নদীতে। যদিও কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড এলাকায় আগের দিনও জরিপে ভাঙনের কোনো পূর্বাভাস মেলেনি। তবে পদ্মা নদীর এ ভাঙনের ফলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে সেতুটির নির্মাণকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ও সেতু কর্তৃপক্ষ। নদীতে তলিয়ে যাওয়া বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও নির্মাণসামগ্রী লুক্সেমবার্গ থেকে পুনরায় আমদানি করতে হবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। এতে সেতু নির্মাণে জটিলতা বাড়বে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, হঠাৎ করে পদ্মা সেতুর প্রকল্প এলাকার কাছেই গত ৩১ জুলাই ভাঙন শুরু হয়। এতে সেদিনই প্রকল্প এলাকায় উপস্থিত হন প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে যান সেতু বিভাগের সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব। সে সময় উপস্থিত ছিলেন প্যানেল অব এক্সপার্টের সদস্যরাও। নদীভাঙন নিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, সেতু বিভাগ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বৈঠকও করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রতিবেদনও প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ৩১ জুলাই বেলা ২টায় মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড-১-এর মালামাল খালাস জেটির প্রায় ১০০ মিটার ভাটিতে আকস্মিক নদীভাঙন শুরু হয়, যা রাত ১টায় থামে। এতে মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের তিন দশমিক ৩৭৮ হেক্টর বা প্রায় ১৫ শতাংশ এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এ সময় ১২৫টি রোডওয়ে ডেক স্ল্যাব (যানবাহন চলাচলের জন্য স্প্যানের ওপর বসানোর অবকাঠামো) এবং ৪৮ সেট (১৯২টি) রেলওয়ে স্ট্রিঙ্গাারসহ বেশকিছু আয়রন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি নদীতে ডুবে যায়।

এদিকে ভাঙনের খবর পেয়ে পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী ও নির্বাহী পরিচালক ভাঙন পরিদর্শনে যান ও দ্রুত প্রতিরক্ষামূলক কাজের পরামর্শ দেন। ওইদিনই সেতু বিভাগের সচিব প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। আর পরের দিন ভাঙন এলাকা পরিদর্শনে যান প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, সেতু বিভাগের সচিব ও পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্যানেল অব এক্সপার্টের সদস্য অধ্যাপক আইনুন নিশাত। পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মার আকস্মিক এ ভাঙনের জন্য কোনো ধরনের প্রস্তুতি না থাকায় ঠিকাদারের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড ও নির্মাণসামগ্রীর বিমা করা ছিল। তাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিমা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা ক্ষয়ক্ষতি পর্যবেক্ষণ করে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এছাড়া সেতু কর্তৃপক্ষকেও চুক্তির আলোকে কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়া লাগতে পারে। ডুবে যাওয়া সামগ্রী উদ্ধার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, কংক্রিটের ডেক স্ল্যাব আর ব্যবহার করা যাবে না। তাই নতুন করে ডেক স্ল্যাব নির্মাণ শুরু করা হয়েছে। আর লোহার যেসব নির্মাণসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি ডুবেছে সেগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কোনো কিছু উদ্ধার করা গেলে তা ব্যবহারোপযোগী আছে কি না, তা যাচাই করে দেখা হবে। ব্যবহারোপযোগী না হলে সেগুলো নতুন করে আমদানি করতে হবে। প্রকল্পের কর্মকর্তারা মনে করছেন, এতে সময়ক্ষেপণ হলেও পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে কোনো প্রভাব পড়বে না। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, করোনার কারণে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে কিছুটা স্থবিরতা চলছিল। বিশেষ করে জানুয়ারিতে চীনারা দেশে যাওয়ার পর পরই সেদেশে করোনার প্রভাব শুরু হওয়ায় কাজের গতি কমে যায়। তবে করোনার মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্মাণকাজ চলেছে। সচিব জানান, বর্তমানে প্রায় ২২শ’ দেশি প্রকৌশলী, শ্রমিক ও ৯৮০ জন চীনা প্রকৌশলী ও শ্রমিক পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করছে। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ও কনসালটেন্ট করোনায় আটকে পড়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া থেকে তিনজন কনসালটেন্ট এ মাসের মধ্যেই চলে আসবেন। তিনি বলেন, করোনা ও বন্যায় কাজের গতি কমলেও কাজ যেহেতু থেমে থাকেনি তাই আগামীতে কাজের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। লোকবল বাড়িয়ে সময়ক্ষেপণের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে জানিয়ে সেতু বিভাগের সচিব বেলায়েত হোসেন বলেন, আমাদের টার্গিট ছিল ২০২১ সালের জুনের মধ্যেই সব কাজ শেষ করা। এখন হয়তো সেটা ডিসেম্বর পর্যন্ত গড়াবে। ২০২১ সালের মধ্যেই পদ্মা সেতু চালু করা হবে জানিয়ে সচিব বলেন, আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি বা সুবর্ণ জয়ন্তী ওই বছর। সে কারণেই ডিসেম্বরের মধ্যেই পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হবে বলে টার্গেট ধরা হয়েছে। আশা করছি আমরা সে লক্ষ্যে সফল হবো ইনশাল্লাহ।



 

Show all comments
  • H. Rashid ১৭ আগস্ট, ২০২০, ১২:৩৬ এএম says : 0
    এটা পরম করুনাময় আল্লাহ্‌তা'য়ালার রহমত! প্রকল্প বিলম্বিত হওয়া মানে কাদের ফায়দা তা সহজেই অনুমেয়। গরীবের জন্য পরকালে জান্নাতের আশ্বাস!
    Total Reply(0) Reply
  • Nurur Rahman ১৭ আগস্ট, ২০২০, ১২:৩৬ এএম says : 0
    সেতুর কাজে করোনাভাইরাস ‘প্রভাব’-------- স্বাস্থ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেছেন "গুঞ্জন"
    Total Reply(0) Reply
  • ইয়ারুল আবিদ ১৭ আগস্ট, ২০২০, ১২:৩৭ এএম says : 1
    যে সেতুর প্রতিটি স্প্যান দেশের উন্নয়ন এ-র মাত্রা সেই সেতুর উপরও করোনা ভাইরাসের প্রভাব পড়তে পারে না।
    Total Reply(0) Reply
  • বিপুল ১৭ আগস্ট, ২০২০, ১২:৩৭ এএম says : 0
    পদ্মাসেতু প্রতিকূল অবস্থায় পড়া মানেই অনেকের নষ্ট অপরাজনীতির জন্য 'ভাল' সংবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • Shaikh Hasan Mahmud Api ১৭ আগস্ট, ২০২০, ১২:৪১ এএম says : 0
    পদ্মা সেতুর জন্য আমরা অপেক্ষা করতে পারবো
    Total Reply(0) Reply
  • Saidur Rahman ১৭ আগস্ট, ২০২০, ১২:৪৩ এএম says : 0
    পদ্মা সেতু একমাত্র সেতু যার আলোচনা সবথেকে বেশী হচ্ছে
    Total Reply(0) Reply
  • Md Badsha Mia ১৭ আগস্ট, ২০২০, ১২:৪৩ এএম says : 1
    আল্লাহ তুমি সবাইকে হেফাজত করুন
    Total Reply(0) Reply
  • বিবেক ১৭ আগস্ট, ২০২০, ১২:৪৫ এএম says : 0
    আলহামদুল্লিাহ, খুবই ভালো খবর। দ্রুত শেষ করা হোক।
    Total Reply(0) Reply
  • মাইনুল ইসলাম ১৭ আগস্ট, ২০২০, ১০:১৪ এএম says : 0
    ইনশাআল্লাহ যথাসময়ে পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন হবে
    Total Reply(0) Reply
  • আলামিন ১৭ আগস্ট, ২০২০, ১০:১৫ এএম says : 0
    এই কাজে যাতে কোনো ধরনের দুর্নীতির না হয় সেটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কে খেয়াল রাখতে হবে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পদ্মা সেতু

১১ জানুয়ারি, ২০২৩
৩১ অক্টোবর, ২০২২
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২
২৬ আগস্ট, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ